• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০২)


সাহিত্য-সংস্কৃতি ডেস্ক আগস্ট ৬, ২০১৬, ০২:৩০ পিএম
মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০২)

প্রথম পর্বের পর...

নিমিষে নলীনির সব স্বপ্ন হাওয়ায় মিশে গিয়েছিল। বিমূঢ়ের মত শুধু তাকিয়েছিল স্বামীর মুখের দিকে। বিয়ের কথা পাকা হবার মূহূর্ত থেকেই না দেখা স্বামীর মুখ নিয়ে কত কল্পনা করেছিল নলীনি। পুতুল খেলার মত কত ঘর গড়েছিল কতঘর ভেঙ্গেছিল সেই কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই। পাড়ার ছোট বড় অনেকেই দেখতে এসেছিল বৌ সেজে বসে থাকা নলীনিকে।

নলীনির বরকে দেখে তার ভাগ্য নিয়ে হিংসে করেছিল অনেকেই। বলিষ্ঠ পুরুষ রতন মাঝি। স্বামীকে তখনও দেখেনি নলীনি। ঘোমটার আড়ালে থেকে স্বামীর প্রসংশার মাঝে নিজের সৌভাগ্যের কানাঘুষায় স্বামীর মুখ দেখার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিল নলীনি। প্রতীার সময় শেষ হয় না। শেষে যখন শেষ হল প্রতীার, তখন নলীনি এক্কেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। অসম্ভব কঠিন এক মুখ। সে মুখের কোথাও কোন কোমলতা, সহানুভূতির চিহ্ন মাত্র নেই। খালি চৌকিটায় সেদিন ফুল ছাড়াই ফুলশয্যা হয়েছিল নলীনির। এক্কেবারে রতন মাঝির নিজের মত করে। সেখানে নলীনির ভাললাগা-নালাগার কোন ব্যাপার ছিল না। দু’দিন বাদেই বাপের বাড়ি গিয়ে নাও নিয়ে তবে এসেছিল নলীনি। 

নলীনির বাবা কয়েকদিন পর নাও দেবে বললে নলীনি পিঠ থেকে কাপড় ফেলে দিয়ে বলেছিল : দেহ, ভালা কইরা দেহ। তোমাগ জামাই আমার পিঠে নাও এর ছবি আইক্কা দিছে। নাও দিবার পারবানা তয় বিয়া দিছিলা ক্যান। খাওয়াইতে পারবানা কইলেই পারতা মইরা যাইতাম।

বলেই ডুকরে কেঁদে উঠেছিল নলীনি। মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে শেষে নলীনির বাবা ঘরের টিনের চাল খুলে বিক্রি করে দিয়েছিল। সেই টাকায় নাও কিনে নাও সহ মেয়েকে পাঠিয়েছিল স্বামীর ঘরে। সেই যে নাও নিয়ে এসেছে নলীনি আর ফিরে যায়নি বাবার বাড়ি। রোজ আজানের সময় উঠে গরম ভাত রান্না করে স্বামীর পাতে বেড়ে দেয়। সে ভাত খেয়ে মাঝি কাকডাকা ভোরে মেঘনার বুকে নাও ভাসিয়ে দেয়। একটানা সারাদিন মেঘনার বুকে ভেসে ভেসে সন্ধ্যায় ডেরায় ফিরে আসে। আবার সকালে গরম ভাত খেয়ে নাও ভাসিয়ে দেয় মেঘনায়। নলীনির দিকে নজর দেয়ার মুহূর্ত সময় হয়না তার। 

এরই মাঝে একদিন সন্ধ্যায় ভাত খেতে খেতে মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছিল : ঘর বইয়া বইয়া খাবি আর কত? গতর খাইট্যা কামাই কইরা খা। তার দু’দিন পরেই নলীনি কাজের খোঁজে গ্রামে বেরিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে মিয়াদের বাড়ি এসে ঠিকা ঝি এর কাজ পেয়েছিল। তারপর থেকেই রুটিন ধরা জীবন শুরু হয়েছে নলীনির। রোজ সকালবেলা মাঝিকে বিদায় করে যায় মিয়াদের বাড়িতে। কাজশেষে দুপুরের আগে আঁচলের তলায় ভাত ঢেকে নিয়ে ডেরায় ফিরে আসে। ভাতের থালা ঘরে রেখে যায় মেঘনার ঘাটে। হাজার ডুব দিয়ে শরীরের, মনের সব যন্ত্রণা ভাসিয়ে দেয় মেঘনার জলে। তারপর ডেরাঘরটায় ঢুকে আরাম করে খেতে বসে।

এরপর থেকে আজ এতটা দিন। নিয়ম বাঁধা জীবনের সাথে এগিয়ে এসেছে নলীনি। কোথাও কোনদিন নিয়মের এতটুকুও হেরফের ঘটেনি। সেখানে আজ হঠাৎ করে মাঝির অবেলায় ফিরে আসা, বাচ্চাদের মত তার কান্না, তার স্নেহ কাতর হাতের ছোঁয়া, বিধ্বস্ত কন্ঠস্বর নলীনিকে একেবারে অভিভূত করে দেয়। মাঝির কোমল স্নেহ কাতর হাতের ছোঁয়া নলীনির সারা শরীরে ভাললাগার শিহরণ জাগায়। নলীনি ভুলে যায় কি এমন সর্বনাশের কথা মাঝি বলতে চায়। কি এমন সর্বনাশ হয়েছে মাঝির। যা মাঝিকে এমন করে নলীনির কাঁধে হাত রাখার মত উচ্ছাস এনে দেয়। মাঝির সর্বনাশের কথা ভেবে নয়, স্বামীর ভালবাসার এক অদ্ভুত অনুভূতিতে চোখে পানি আসে নলীনির।

চোখ বন্ধ করে নলীনি গভীর ভাবে উপলব্ধি করে স্বামীর স্নেহকাতর হাতের ছোঁয়া। মনে মনে বলে : ধ্বংস হইয়া যাক সব। ধ্বংস হইয়া যাক পৃথিবী। চরম সর্বনাশ হইয়া যাক আমার স্বামীর। খালি এই সুখটুকু বাইচ্যা থাকুক। খালি এই সুখটুকু বাইচ্যা থাকুক।
দু’গাল বেয়ে কান্না গড়িয়ে পরে নলীনির।

ilstason

মেঘনা ঘাটের ধার ঘেঁষে তিরিশ পয়ত্রিশ ঘর মাঝির একটানা বসতি। মাঝিপাড়া বলে পরিচিত এদের সুখ দুঃখ এদের নিজেদের মাঝেই সীমাবদ্ধ। বিয়ে-পালা-পার্বণ সবকিছুই এরা নিজেরাই একে অন্যের সাথে মিলে মিশে করে। মাঝি পাড়ার বাইরের মানুষগুলো এদের মানুষ বলে ভাবে না। এদের নৌকোয় বসে নদী পার হয়ে এদের পাড়ার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেও তাদের নাকে লাগে। পচা দুর্গন্ধের মত। তাদের উপরে ফেলা আবর্জনার মত।
মাঝি পাড়ার সুখের দিনে যেমন তারা মাথা ঘামায় না তেমনি দুঃখের দিনেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না। 

সুখে দুখে এরা নিজেদের মাঝেই নিজেরা কোলাকুলি করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালায় প্রতিনিয়ত। কাক ডাকা ভোরে মাঝি পাড়ার প্রতিটি ডেরাঘরের পুরুষেরা মেঘনায় নাও ভাসায়। মানুষ পার করে। সারাদিন মেঘনার বুকে ভেসে ভেসে সন্ধ্যায় ডেরায় ফিরে আসে। ঘরে আগুন জ্বেলেই গোগ্রাসে ভাত খেয়ে চৌকিতে গা এলিয়ে দেয়। কারো তাও নেই। মেঝেতে খরকুটো বিছিয়ে কেউ বা পাটি বিছিয়ে তার উপর কান্তি ভুলার চেষ্টা করে। বৌ-ঝিরা পাড়ার বাইরে এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে সংসারের হাল ধরে। স্বামীর সাথে। বাবার সাথে।

বৃষ্টির দিনে প্রকৃতির সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে এরা। কাদার ভেতর চপ চপ আওয়াজ তুলে এ ঘর ও ঘর করে। ডেরাঘরের একচালা ছনের ছাউনীর ফাঁক ফোঁকর দিয়ে গড়গড়িয়ে বৃষ্টি পরে গর্ত গর্ত হয়ে যায় মেঝে। তার মাঝেই বেঁচে থাকে এরা।
আজ দু’দিন ধরেও অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। তার ভেতর দিয়েই রতন মাঝির একচিলতে উঠোন, ছোট্ট ডেরাঘর সারাণ লোকে লোকারণ্য থাকে। মাঝি পাড়ার সব মানুষের ভিড় লেগেই আছে। একজন যায় একজন আসে। সে যায় আবার অন্যজন আসে। 

বদমেজাজী রতন মাঝিকে মাঝি পাড়ার অনেকেই পছন্দ করেনা। তারপরও তার এই দুর্দিনে দু’কথা সান্ত্বনার বাণী এসে শুনিয়ে যেতে কেউ কার্পণ্য করছেনা। মানুষের পায়ের চাপে রতন মাঝির ছোট ঘরটার মেঝে কাদার নীচে ঢাকা পড়েছে। ছনের ছাউনির এদিক ওদিক দিয়ে ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পরে সেই কাদাকে আরো গভীর করে দিয়েছে। তার উপরই পিঁড়ি পেতে বসে আছে রতন মাঝি।

রতন মাঝির মুখে বিষন্নতা গাঢ় আন্তরণ। বদমেজাজী মাঝির মুখে এই বিষন্নতার ছোঁয়া মাঝি পাড়ারও অনেককে ভাবিয়ে তোলে। বৃষ্টির ভেতর দিয়েই হারু মাঝি, রহিম মাঝি, মতিন মাঝি আরও কয়েকজন মাঝি এসে ঢুকে রতন মাঝির ডেরায়। নলীনি ওদেরকে দেখে চৌকিটার অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ওরা চৌকিটার উপর পা ঝুলিয়ে বসে। 

ilas

অত ভাব কেন মাঝি। আল্লার কাম সব ভালা। হারু মাঝি বলে।
রহিম মাঝি : আবার হাল ধর। এইডাই জীবন।
মতিন মাঝি : রতন মাঝির এত বড় একটা সর্বনাশ কেডা করল আমরা কেউ বুঝবারই পারতাছিনা।
হারু মাঝি : চোরে চুরি করলে মাইনষে দেইখ্যা রাখবো কতণ।
রহিম মাঝি : যাউগ্যা মাঝি। এই ভাবে ঘরে বইসা থাইক্যা আর মন ভার কইরো না।
রতন মাঝি কিছু বলে না। গোপনে আর্তশ্বাস চেপে যাবার নিষ্ফল চেষ্টা করে শুধু।
সবাই চলে গেলে নলীনি আরেকটা পিঁড়ি টেনে বসে স্বামীর পাশে। 
বলে : আপনে খুব কষ্ট পাইতাছেন?
-হ বৌ।
-এত কষ্ট পাইয়েন না।
-খামু কি?
-আল্লায় খাওয়াইবো।
-তর কষ্ট অয়না বৌ।
-না। নলীনির শান্ত উত্তর।

রতন মাঝি করুণ চোখ তুলে তাকায় নলীনির দিকে। মাঝি ল্য করেছে তার এত বড় সর্বনাশে নলীনির মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে সে যেন আগের চেয়ে অনেক উচ্ছল। একটা আর্তশাস ফেলে মাঝি। 
বলে : তর কষ্ট হয় না কেন?
এবার নলীনিও একটা আর্তশ্বাস ফেলে। তারপর আস্তে আস্তে বলে : আমার মনে অয় আমাগ এই সর্বনাশ আমাগরে অনেক সুখ আইন্যা দিছে। আমাগ বিয়া অইছে আইজ পাঁচ বছর ছয় মাস। এই পাঁচ বছর ছয়মাসের মইধ্যে আমি কোনদিন এত্ত সুখ পাই নাই। আইজ দুইদিন ধইরা মনে হইতাছে আমাগ এই সর্বনাশ আরো অনেক আগেই হওনের কাম আছিল। তাইলে আরো অনেক আগেই আমি আপনের বৌ হইতাম। আপনি আমার স্বামী হইতেন।

ilas

এমন করে কথাগুলো বলে নলীনি যে রতন মাঝির বুকের ভেতরটা একেবারে এলোমেলো করে দেয়। দুই হাতে বৌয়ের মুখটা তুলে ধরে রতন মাঝি।
-আমরা অহন বাঁচমু কেমনে বৌ?
-আল্লায় বাঁচাইবো। অত চিন্তা কইরেন না।
-তর বাবার কাছ থেইক্যা যৌতুক লইয়া আমি বাঁচবার চাইছিলাম। আল্লায় তার........
-নলীনি রতন মাঝির মুখে হাত চাপা দেয়।
-এমুন কইরা কইয়েন না। আমার সুখের লাইগ্যা আমার বাবায় ঘর বেইচ্যা আপনেরে নাও দিছে। আইজ পাঁচ বছর ছয়মাস পরে হইলেও আমিতো সুখী হইছি। এই সুখেই আমার বাবার শান্তি হইব।
-বৌ।
-কি।
-তুই এত বালা কেনরে বৌ!
-নলীনি কিছু বলে না। বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টির গতি বাড়ে আস্তে আস্তে।
একসময় ঝপ ঝপ কওে অঝোড় ধারায় ঝড়ে পরে সে বৃষ্টি। নলীনি উঠোনে অঝোর ধারায় ঝড়ে পরা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে : জানেন, আমার যে কতদিন ইচ্ছা হইছে এমুন এক বৃষ্টির দিনে আপনের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে। বৃষ্টির মইধ্যে দিয়া আপনের হাত ধইরা হাঁটতে।
-কস নাই কেন?
রতন মাঝি নলীনির হাত ধরে কাদায় পানিতে ভরা একচিলতে উঠানটায় নেমে আসে। বৃষ্টির ভেতর দিয়ে নলীনির হাত ধরে হেঁটে হেঁটে মেঘনার ঘাটে চলে আসে। ঘাট বেয়ে নীচে নেমে আসে। যেখানে ক্ষীণ অস্তিত্ব নিয়ে মাঝির নৌকাটা ভেসে আছে সেখানে এসে দাঁড়ায়। রতন মাঝি নলীনির হাত ছেড়ে দিয়ে নৌকাটার গায়ে হাত বুলায়। ছোট্ট ছেলের মত হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। 
কাঁদতে কাঁদতে বলে : বৌ, এ আমার পাপের শাস্তি। এ আমার পাপের শাস্তি বৌ। তর বাবার কাছ থেইক্যা যে যৌতুক লইছি হেই শাস্তি।

রতন মাঝির সর্বনাশ ঘিরে এখন পুরো মাঝি পাড়ায় আতংক ছড়িয়ে পরেছে। রাস্তা, ঘাটে, ঘরে, বাইরে সব জায়গাতেই আলোচনার বিষয় এখন রতন মাঝির সর্বনাশ। নিজেদের নৌকা রণাবেণেও সব মাঝিদের মাঝে এখন তদারকি বেড়ে গেছে। আগে সন্ধ্যায় ঘাটে নৌকা বেঁধে সব মাঝিরাই ডেরায় চলে আসত। কুপি জ্বালিয়ে ভাত খেয়েই বৌ বাচ্চা নিয়ে শুয়ে পরত। সারাদিনের কান্তি ভুলে শ্রান্তি খুঁজে ফিরত ঘুমের কোলে ঢলে পরে। এখন খেয়ে-দেয়ে মাঝিরা সব নৌকার ভেতরে শুয়ে পরে। কে জানে আবার কে এসে কার নৌকার তলা ঝাঝড়া করে দিয়ে যায় কখন। সেই ভয়ে মাঝিরা এখন ঘাটে নৌকা বেঁধে রেখে কোন রকমে নাকে মুখে ভাত ঢুকিয়ে আবার নৌকায় ফিরে যায়। 

নৌকার ছই এর ভেতর আটশাট হয়ে শুয়ে পরে। নৌকাই যাদের দিন যাপনের একমাত্র রাস্তা, ওদের নৌকার তলাই যদি না থাকে তবে তাদের দিন কাটবে কেমন করে, এই ভয় সদাই কাজ করে তাদের মাঝে। মাঝি পাড়ায় রতন মাঝির করুণ অবস্থা এখন সবারই আলোচনার বিষয়। পাশের ডেড়ার হারু মাঝির বৌ নলীনির দুর্দিনে এক্কেবারে ঝড়ঝড় করে কেঁদেই ফেলে।
ভাতের থালা থেকে মুখ তুলে হারু মাঝি বলে : তুই কান্দস কেন? নলীনি বুজানের লাইগ্যা পরানডা খালি পুড়ায়।

রতন মাঝির ডেরার দুই ঘর পরেই হারু মাঝির ডেরা। নলীনি রতন মাঝির বউ হয়ে আসার ছ’মাস পর হারু মাঝি বিয়ে করে। মাঝি পাড়ায় হারু মাঝির বউ এর সাথেই নলীনির বড় ভাব। সুখের দুঃখের কথা বলে দুজন দুজনকে। হারু মাঝির বৌ ফাঁক পেলেই ছু'টে আসে নলীনির কাছে। তার চেহারায় চীনাদের আদল।
তা এইডা কান্দনের কি অইল? ভাত খেতে খেতে হারু মাঝি বলে।

 
ials
 
নমুনা?
-কাইন্দা হেগ নাও ফিরাইয়া দিতি পারবি?
-তা পারমুনা। তয় নলীনি বুজানের লাইগ্যা পরানডা খালি পোড়ায় যে। রতন মাঝি তো মানুষ না, জানোয়ার। যহন দুইবেলার খাওন যোগাইতে পারত তহনই বৌডারে মানুষ বইলা ভাবে নাই। অহন তো না জানি ঘর থেইক্যা বাইর কইরা দেয়।
-দেয় দিব। হেল্যাইগা তর এত দরদ কেন ?
-দরদ তো মাইনসের লাইগ্যাই মাইনসের অয়।
হারু মাঝি আর কিছু বলে না। ভাত খাওয়া শেষ হলে প্লেটের মধ্যেই হাত ধুয়ে কোমরে গামছাটা বেঁধে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বৌ সবকিছু গুছিয়ে রেখে যায় রতন মাঝির দাওয়ায়। নলীনি দাওয়ায় মাঝেই পিঁড়ি পেতে বসে আছে। হারু মাঝির বউ এসে মাটিতেই বসে পরে নলীনির পাশে। 
বলে : তোমার মাঝি কই বুজান?
-শুইয়া আছে।
হারু মাঝির বৌ ঘাড় ফিরিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর তাকায়। দেখে রতন মাঝি তেল চিটচিটে বালিশটায় মাথা রেখে উপরের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। একটা আর্তশ্বাস চেপে হারু মাঝির বৌ বলে : বুজান, অত মন খারাপ কইরা বইয়া থাইক্যো না। আল্লায় সর্বনাশ দেয় আবার আল্লায়অই তা মিটাইয়া দেয়। নলীনি ম্লান হাসে।
-ঠিকঅই কইছসরে হারুর বৌ। আল্লায় সর্বনাশ দেয় আবার আল্লায়অই তা মিটাইয়া দেয়। তয় যেদিক দিয়া দেয় হেদিক দিয়া মিটায় না। অন্যদিক দিয়া মিটায়।
হারু মাঝির বৌ-এর নলীনির সাথে খুব ভাব থাকলেও মাঝে মাঝেই নলীনির অনেক কথা বুঝতে পারে না সে। তখন বোকার মত তাকিয়ে থাকে। এখনও তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল : বুজান, কি কইলা সহজ কইরা কও। বুঝবার পারি নাই। সর্বনাশ লইয়া আমি অত ভাবি না। স্বোয়ামীই ভাইব্যা ভাইব্যা শরীরডা ভাইঙ্গা ফালাইতাছে। বুঝাও মাঝিরে।
-বুঝে না।
-এইভাবে ভাইঙ্গা পড়লে চলবো কেমনে। কামে যাইতে কও।
নলীনি একটা আর্তশ্বাস ফেলে বলে : তরে একটা কতা কমু হারু বৌ?
-কও।
-আইজ তিনদিন ধইরা মাঝির নাও নাই। মাঝির মন খারাপ তাই আমিও কামে যাই না। তিনদিনে তিন বেলা খাইয়া না খাইয়া কাটছে আমাগ। তারপরেও মনে অয় কি জানস্ বৌ, মনে অয় এই পিরথিবীর বেবাক মাইনসের থেইক্যা সুখি আমি। যে সুখ বিয়ার পর থেইক্যা পাই নাই আমি। এত্ত সুখ! বৌ এত্ত সুখ।

রিটা আশরাফের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মধ্য রাতের নদী-এর তৃতীয় পর্ব আসছে... চোখ রাখুন সোনালীনিউজ-এ

কথাসাহিত্যিক ড. রিটা আশরাফ
নরসিংদী জেলার সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় স্বরচিত কথাসাহিত্য প্রতিযোগিতায় বহুবার প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। কথাসাহিত্য রচনায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকেও। 
ড. রিটা আশরাফ বর্তমানে বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এইউবি) বাঙলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং একই সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন থেকেই। 
তাঁরই সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা। পেয়েছেন ভারতের বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন সম্মাননা (২০১৪), ভিন্নমাত্রা সাহিত্য সম্মাননা (২০১০), গঙ্গা-গোবিন্দ সাহিত্য সম্মাননা (২০১৫), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি সহিত্য পত্রিকা সম্মাননাসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সন্মাননা।
রিটা আশরাফের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বালুচরে বসতি (উপন্যাস), নৈবেদ্যর নারী (উপন্যাস), বিবর্ণ স্বাধীনতা (উপন্যাস), একটু ভুলের অনুভূতি (উপন্যাস), তুতুলের খড়গোশ শিকার (শিশুতোষ গল্প), মামদোভূতের পুত (শিশুতোষ গল্প সংকলন) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনলো যাঁরা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে তৎকালীন বিশ্ব (গবেষণা), নজরুলের কুহেলিকা : একটি সার্বিক পর্যালোচনা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে উপমা (গবেষণা) ইত্যাদি।

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০১)

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি
 

Wordbridge School
Link copied!