• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৩)


সাহিত্য-সংস্কৃতি ডেস্ক আগস্ট ৮, ২০১৬, ০৫:৫৯ পিএম
মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৩)

দ্বিতীয় কিস্তির পর...

নলীনির চোখে পানি আসে। হারু মাঝির বৌ কিছু বুঝতে পারে না। অবাক চোখে দেখে নলীনিকে। হারু মাঝির বৌ নিজেও লক্ষ্য করেছে স্বামীর দুর্দিনে স্ত্রীর যতটা ভেঙ্গে পরার কথা নলীনির মাঝে সে রকম কোনও কষ্টের প্রকাশ নেই। মাঝি পাড়ার সবাই রতন মাঝির দুর্দিনে সহমর্মিতা জানাতে এসেছে। কিন্তু নলীনি কারো সামনেই কেঁদে কেটে আকুল হয়নি।

হারু বৌ অবাক হয়ে জানতে চায় :
-কি এমন সুখ বুজান তোমার, এত কষ্ট সইবার ক্ষমতা দিছে।
-স্বামীর সুখ। বিয়ার কথা পাকা হওনের পর স্বামীর মুখ না দেইখ্যাই যে সুখ কল্পনা করছিলাম, যে সুখ বিয়ার রাইতে স্বামী আমার মাথার ঘোমটা ফালানোর পর থেইক্যাই মিছা হইয়া গেছিল, সেই সুখ।
নলীনি আবেগে আপুত হয়।
-জানস্ বৌ, কাইল সারা রাইত আমি মাঝির বুকে মাথা রাইখ্যা ঘুমাইছি। মাঝি দুই হাত দিয়া এমন কইরা জড়াইয়া ধইরা রাখছে আমারে, আমার অহনও মনে অইতাছে পিরথিবীর সব মিছা। খালি হেই সুখ-টুকু সত্যি।
হারুর বৌ কিছু বলে না। খানিক চুপ থেকে নলীনি আবার বলে :
-বিয়ার পর থেইক্যা স্বামীর সাথে ঐ একটা চৌকির মইধ্যেই ঘুমাইছি আইজ পাঁচ ছয় মাস। এই পাঁচ বছরে হাজার বারেরও বেশী স্বামীর শরীরের লগে আমার শরীরডা এক হইছে। কিন্তু কোনদিন মনে কোন সুখ পাই নাই। মনে হইছে এইডাই মাইয়া মাইনষের জীবন। কর্তব্য। স্বামীরে খুশী করন লাগবো এই সত্যিডারে সামনে রাইখ্যাই মাইআ মানুষ ঘোমটা টাইন্যা স্বামীর ঘর করতো যায়। স্বামীর তিয়াস যতণ না মিটছে ততণ নিজের শরীরডারে কুত্তার শরীরের মত মনে হইছে।
আর ঐ একই ডেরার মাঝে একই চৌকিতে আইজ কয়ডা দিন কাটতাছে। খাইয়া না খাইয়া। তারপরও আমার কোন কষ্ট অয় না। বিশ্বাস কর হারু বৌ, আমার কোন কষ্ট অয় না। আমার কেবলি মনে অয়, এই সুখটার মইধ্যেই যদি বাকী জীবনডা শেষ হইত।

হারু বৌ লুকিয়ে একটা আর্তশ্বাস ফেলে। মনে মনে বলে :
হায়রে মাইয়া মানুষ!
নিজের কথাও মনে পরে। হারুর বৌ নিজেও কি কম কাঙ্গাল স্বামীর ভালবাসার। তবে হারু মাঝি লোকটা রতন মাঝির থেকে ভাল। আজ পর্যন্ত কোনওদিন বৌয়ের গায়ে হাত তোলেনি। মুখ খারাপ করে কথা বলে তবে মারে না। সকালবেলা কোনদিন পান্তা, কোনদিন গরম ভাত যা বৌ এনে সামনে দেয় তা খেয়েই নাও ভাসিয়ে দেয় মেঘনায়। সারাদিন মেঘনার পানিতে ভেসে ভেসে মানুষ পার করে। এরপর সন্ধ্যায় কান্ত শরীরে ঘরে ফিরে বৌ-বাচ্চা নিয়ে সুখে রাত কাটায়।
বেলা তো অনেক অইল, খাইছ কিছু বুজান? হারুর বৌ জানতে চায় :
নলীনি ম্লান হাসে।
-ভাবতাছি আইজ কামে যামু। মাঝিরেও কইছি, এমনে সারাণ মন খারাপ কইরা না থাইক্যা অন্যের নৌকায় ভাড়া খাটত।

নলীনি আজ সকাল করে ঘুম থেকে উঠে। দরজার ঝাপ টেনে বাইরে এসে আড়মোড় ভাঙ্গে। এখনও পুরোপুরি ফর্সা হয়নি চারপাশ। ঘরের ধার থেকে ঝাড়– টেনে নিয়ে উঠান বাড়ি ঝাড়– দেয়। তারপর শাড়ীটাকে গুছিয়ে পরে নিয়ে আবার ডেরায় ঢুকে। রতন মাঝি শুয়েই আছে।
-হুনছেন।
-ক। হুনতাছি।
-উঠেন। উইঠ্যা কাম খুঁজেন। ভালা লাগবো।
-মাঝি কিছু বলে না। তেমনি শুয়ে থাকে।
-আমি অহন মিয়াগর বাড়িত যামু।
-যা।
নলীনি ঘর ঝাড়– দেয়া হলে ঝুলন্ত শিকা থেকে মাটির হাড়ি নামিয়ে আনে। তার থেকে চিড়া মুড়ি আর একটু গুড় শাঙ্কিতে রেখে আরেকটা শাঙ্কি দিয়ে ঢেকে রেখে বলে :
চিরা মুড়ি রাইখ্যা গেলাম। উইঠ্যা খাইয়া লইয়েন।

নলীনি গিয়েছে অনেকক্ষণ। তেল চিটচিটে বালিশটায় মাথা রেখেই খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকায় মাঝি। সুর্যটা বেশ উপরে উঠে এসেছে। গত দুদিনের একনাগারে বৃষ্টিতে পুরো মাঝি পাড়াটাই ডুবে গিয়েছিল কাদার নিচে। এখনও পুরোপুরি কাঁদা শুকিয়ে যায়নি, তবে আজ সারাদিন যদি সুর্যটা একনাগাড়ে তাপ দিয়ে যায়, তাহলে হয়ত শুকিয়ে যাবে।
মাঝি উঠে দাওয়ায় এসে বসে। সুর্যটার দিকে তাকায়। এখন বেলা কত হবে? নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে তা অনুমান করতে চেষ্টা করে। দরজার ঝাপ টেনে দিয়ে মাঝি আস্তে আস্তে ডেরা ঘরটার সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে চলে আসে। আজ ছ’দিনের মধ্যে এই প্রথম মাঝি বাড়ির বাইরে আসে। ছ’দিন আগে যে দিন কাকডাকা ভোরে গরম ভাত খেয়ে মাঝি ছুটে এসেছিল নৌকা ঘাটায় নদীতে নাও ভাসাবে বলে। তখনও ঘাটে কোন মাঝি আসেনি। রতন মাঝির আগে কেউ কখনো নদীতে নাও ভাসাতে পারেনা। সবারই আসতে অল্প বিস্তর দেরী হয়। কিন্তু রতন মাঝির সময়ের কোন হেরফের হয়নি।

সারি বেঁধে নৌকাগুলো ঘাটে বাঁধা হয়েই ছিল। রতন মাঝি নিজের নৌকার কাছে গিয়ে প্রথমেই কিছু ঠাওর করতে পারেনি। নৌকার তলা ঝাঝড়া করে খুঁটি দিয়ে নৌকাটাকে ভাসিয়ে রাখা হয়েছিল। মাঝি যেই বাঁধন শূন্য করে নৌকাটাকে পানির দিকে ধাক্কা দিয়েছিল ভাসানোর জন্যে অমনি নৌকাটা ধপাস করে খুঁটি থেকে পরে পানির নীচে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়েছিল।

দৃশ্যটা দেখে বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠেছিল শুধু রতন মাঝির। কাঁদতে পারেনি। কান্নারা সব প্রতারণা করেছিল মাঝির চোখের সাথে। মূর্তির মত দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিল শুধু ক্ষীণ অস্তিত্ব নিয়ে ভেসে থাকা নৌকার দিকে। একে একে সব মাঝিরা ঘাটে আসে নৌকা ভাসাতে। মাথার উপর বাজ পড়ারা মত থমকে দাঁড়ায় সবাই। সেদিন সবমাঝিরই নাও ভাসাতে দেরী হয়েছিল অনেক। রতন মাঝির সর্বনাশ নিয়ে ওরা দুঃখ করেছে, মাঝিকে সান্ত্বনা দিয়েছে। পাশাপাশি নিজের নৌকার কথা ভেবেও বুক কুকরে গিয়েছে ওদের।

এক সময় হতাশা চেপে ঝটলা ভাঙতে শুরু করে। পেটের দায়ে এক এক করে সব মাঝিরাই নাও ভাসিয়ে দেয় মেঘনায়। শুধু রতন মাঝি পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে নিজের ডুবে থাকা নৌকার দিকে তাকিয়ে। মাঝি পাড়ায় কোনও ঘটন-অঘনের কথা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে। রতন মাঝির সর্বনাশের কথাও ছড়িয়ে পড়ে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো রতন মাঝির তলা ঝাঝড়া নৌকাটা দেখার জন্য ছুটে এসে ঝটলা করে পারে দাঁড়ায়। বৌ-ঝিরাও এসে দাঁড়ায় পারে। ক্ষীণ অস্তিত্ব নিয়ে ভাসমান নৌকার গায়ে রতন মাঝির সর্বনাশের চিহ্ন দেখে ওরাও এক সময় যে যার ডেরায় ফিরে যায়।

সূর্যটা উদ্ভ্রান্তের মত হয়ে উঠছে। প্রচণ্ড তেজ নিয়ে তার উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। সেই উত্তাপকে সহ্য করেই মেঘনার বুকে ভেসে বেড়ায় মাঝি পাড়ার এককুড়ি ছ’জন মাঝির নৌকা। আর রতন মাঝি তখন কান্ত বিষন্ন শরীরটাকে টেনে টেনে এনে দাঁড়ায় নিজের ডেরা ঘরটার সামনে একচিলতে উঠোনটার মাঝে। এধার ওধার পেরিয়ে রতন মাঝি এসে দাঁড়ায় নৌকা ঘাটায়। যেখানে ছ’দিন আগের প্রতিদিন সন্ধ্যায় এককুড়ি সাতটা নৌকা সারিবদ্ধ গয়ে বাঁধা পরতো। আবার সূর্য উঠার আগেই পাগলা ঘোড়ার মত ভেসে যেতো মেঘনার বুকে। হারিয়ে যেতো দূরে বহুদূরে।

ছ’দিনের ব্যবধানে চারপাশের সবকিছুই কেমন নতুন মনে হয় রতন মাঝির কাছে। মেঘনার পানিগুলোকেও অন্যরকম লাগছে। মাঝির দুঃখে এরাও কি বিষন্ন। তা না হলে এত স্থির কেন পানি? মাঝি ঘাটায় নেমে আসে। ঘাটায় এখন একটা নৌকাও নেই। সব ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘনার বুকে। মাঝিরা দাঁড় টানছে শরীরের সব শক্তিকে মেলে ধরে।

প্রকৃতির কিছু নিজস্ব সুন্দরের সামনে দাঁড়ালে কষ্টরা সব মিশে যায় প্রকৃতির মাঝে। বেঁচে থাকার এক অদম্য আগ্রহ জাগিয়ে দেয় অনেক কষ্টের ভীরেও। প্রকৃতির এই অসাধারণ মতা সম্ভবত পৃথিবীর কিছু কিছু মানুষ খুব দুঃখী হবে ভেবেই আল্লাহ দিয়েছেন। হয়ত প্রকৃতির এই অসাধারণ মতার বলেই মাঝিরা তাদের নিত্য নৈমিত্তিক সব কষ্ট ভূলে গিয়ে পাল উড়িয়ে দিয়ে মনের সুখে গান ধরে। ছই এর ভেতর বসে যাত্রীরা সম্মোহনগ্রস্ত হয়ে শোনে সে গান। ভাবুক কোন যাত্রী ছই এর ভেতর থেকে উত্তপ্ত রোদের মাঝেও বাইরে বের হয়ে আসে। দাঁড়িয়ে দেখে কিভাবে নৌকাটা পানি ঠেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। পানির উপর সূর্যের আলো পড়লে কি অদ্ভুত মোহময় হয় নদীর রূপ তা দেখে তন্ময় হয়ে।

শুধু রতন মাঝির নৌকাটা ক্ষীণ অস্তিত্ব নিয়ে ভেসে আছে পানির উপরে। রতন মাঝি নৌকার গায়ে হাত রেখে ছোট্ট ছেলের মত কাঁদে। পাগলের মত নৌকার চারদিক ঘুরে ঘুরে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে নৌকাটা। আর বলে : খোদা! কোন পাপে তুই আমারে এত্ত বড় শাস্তি দিলি। বাঁচমু কেমনে খোদা! কইয়া দে বাচঁমু কেমনে!

তিন পুরুষের মাঝি হয়ে রতন মাঝি বড় হয়েছে এই মাঝি পাড়াতে। রতন মাঝির দাদা সোনা মাঝি একদিন মেঘনার ভাঙ্গনে সব হারিয়ে বউ আর এক ছেলে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে আশ্রয় পেয়েছিল এই মাঝি পাড়াতে। বউ এর সোনার একটা নাকফুল, রূপার দু’গাছি চুরি আর একটা রূপার গলার চেইন বিক্রি করে সেই টাকায় নাও কিনে ভাসিয়েছিল মেঘনায়। শুরু করেছিল বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম। সোনা মিয়া নতুন নামে পরিচিতি পেয়েছিল সোনা মাঝি রূপে। প্রথম প্রথম নৌকার ভেতরেই বউ ছেলে নিয়ে কাটাত সোনা মাঝি। এভাবে প্রায় বছর কেটে যায় সোনা মাঝির। তারপর মাঝি পাড়ার এক মাঝির দয়ায় সোনা মাঝি উঠে আসে মেঘনা পারের এই মাঝি পাড়ায়। সুখে দুঃখে দিন কাটে সোনামাঝির। একমাত্র ছেলে করিম মাঝি একটু বড় হতেই হাতে বৈঠা গুজে দেয়। দিনে দিনে বড় হয় করিম মাঝি।

যে মাঝি সোনা মাঝিকে আশ্রয় দিয়েছিল সে মাঝিরই মেয়ের সাথে বিয়ে হয় করিম মাঝির। কন্যাদায়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মাঝি পাড়ার শেষ প্রান্তে একচিলতে জায়গার উপর ঘর তুলে দিয়েছিল মেয়ে, মেয়ে জামাইকে। আর সেখানেই জন্ম হয় রতন মাঝির। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত ধীর, স্থীর, গম্ভীর, একরোখা হয়ে বড় হয় রতন মাঝি। রতন মাঝির বয়স যখন দশ তখন একদিন পাড়ার অন্য ছেলেদের সাথে মেঘনার পানিতে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছিল রতন মাঝি। বাবা করিম মাঝি তখন অন্য পার থেকে নৌকায় মানুষ বয়ে নিয়ে এপারে এসেছে। ঘাটে মানুষ নামিয়ে দিয়ে রতন মাঝিকে নৌকায় ডেকে হাল ধরতে বলেছিল। রতন মাঝি হাল ধরবে না বললে করিম মাঝি ঠাস করে ছেলের গালে থাপ্পর মেরে বলেছিল : -মাঝির পোলা মাঝিই হইব। এইডাই নিয়ম। আর মাঝিই যহন হওন লাগবো তহন আর দেরী কইরা লাভ কি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেন্দে কেটে রতন মাঝিকে সেদিন বৈঠা ধরতে হয়েছিল। আর সেই যে ধরা তা আজ এক্কেবারে নিয়মে পরিণত হয়েছে। মাঝি পাড়ায় একমাত্র সুঠাম দেহের বলশালী পুরুষ রতন মাঝি। তার রক্ত চুকে পরোয়া করেনা এমন মানুষ নেই মাঝি পাড়ায়। তবে রতন মাঝি কখনো কারো সাতে পাঁচে থাকে না। মুখের উপর রুতার ছাপ সারাণই লেপ্টে থাকে তার। মাঝি পাড়ার ছেলে- মেয়েদের মাঝি পাড়াতেই বিয়ে হয়। এটাই মাঝি পাড়ার অলিখিত নিয়ম।

রতন মাঝিই প্রথম নিয়ম ভাঙ্গে মাঝি পাড়ার। পাড়ার সব মুরব্বীদের নাকের ডগায় পা রেখে নিজের ইচ্ছেয় পাল উড়িয়ে চলে। অন্যগ্রামে বিয়ে করায় মাঝি পাড়ার সবাই আসন্তোষ হয় রতন মাঝির উপর। কিন্তু সামনে এসে কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি কখনো। তারপর এক সময় সে ক্ষোভ আস্তে আস্তে ভুলে যায় সবাই। নলীনিও এর ভেতর মাঝি পাড়ারই একজন হয়ে উঠে। ঘাটে অর্ধ ডুবন্ত নৌকাটার গা ছঁয়ে ছুঁয়ে বাচ্চা মানুষের মতো কাঁদে রতন মাঝি।

রুশনী অনেকণ ধরে ঘাটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে রতন মাঝির ছেলে মানুষের মতো কান্না। খুব ইচ্ছে করে রতন মাঝির কাছে যায়। রতন মাঝির হাতটা চেপে ধরে দু’টা সান্ত্বনার কথা বলে। কিন্তু পারে না। মাঝি পাড়ার অন্য প্রান্তে ছলিম মাঝির ছোট্ট মেয়ে রুশনী। উচ্ছল, প্রাণ চঞ্চল, আড্ডাবাজ তরুণী রুশনী। রতন মাঝির থেকে অন্তত দশ বছরের ছোট রুশনী। পাড়ার সব মুরুব্বীরা মিলে রুশনীর সাথে রতন মাঝির বিয়ে ঠিক করেছিল। রুশনীর বাবা রতন মাঝিকে নৌকা দিবে এই শর্তে বিয়ে ঠিক হয়েছিল রতন মাঝির সাথে রুশনীর। রশনী হাতে মেন্দি পড়েছিল, গায়ে হলুদ পড়েছিল। রতন মাঝি বর সেজে রুশনীদের বাড়িও গিয়েছিল। বউ সেজে বসেছিল রুশনী।


মাঝি পাড়ার অন্য প্রান্তে ছলিম মাঝির ছোট্ট মেয়ে রুশনী। উচ্ছল, প্রাণ চঞ্চল, আড্ডাবাজ তরুণী রুশনী। রতন মাঝির থেকে অন্তত দশ বছরের ছোট রুশনী। পাড়ার সব মুরুব্বীরা মিলে রুশনীর সাথে রতন মাঝির বিয়ে ঠিক করেছিল। রুশনীর বাবা রতন মাঝিকে নৌকা দিবে এই শর্তে বিয়ে ঠিক হয়েছিল রতন মাঝির সাথে রুশনীর।

রশনী হাতে মেন্দি পড়েছিল, গায়ে হলুদ পড়েছিল। রতন মাঝি বর সেজে রুশনীদের বাড়িও গিয়েছিল। বউ সেজে বসেছিল রুশনী। বিয়ে পড়ানোর সময় হলে মাঝি নৌকা দেখতে চেয়েছিল। রুশনীর বাবা তখন হাত জোড় করে মাঝির সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল : -বাবাজি সামনের সপ্তাহেই আপনেরে নৌকা দিমু!

মুর্হুতেই রতন মাঝির চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল। উত্তেজিত হয়ে বলেছিল :
-নৌকাতো আইজই দিবার কতা আছিল।
-অনেক চেষ্টা করছি! পারলাম না বাবাজি!
-পারলেন না তয় মাইয়া বিয়া দেওনের এত্ত সখ কেন?
-বাবাজি একটা সপ্তাহ সময় দেন। আমার কথার খেলাপ হইব না।
-খেলাপ কইরা অহন কন খেলাপ হইব না।
-যাইয়েন না বাবাজি। মাইয়াডা কষ্ট পাইব।

রতন মাঝি কারো কোন কথা শোনেনি। সে দিনই সখিনাপুর গ্রাম থেকে গরুর গাড়ির ছই এর ভেতর বসিয়ে বউ বানিয়ে নিয়ে এসেছিল নলীনিকে। বালুর টিবির মত রুশনীর সব স্বপ্নকে সেই যে ভেঙ্গে দিল রতন মাঝি সেই থেকে রুশনীকে জোড় করেও আর কেউ পারেনি বিয়েতে রাজী করাতে। রুশনীর সমস্ত উচ্ছলতা সেই যে হারিয়েছে তাও আর ফিরে আসেনি।
যেদিন নলীনি রতন মাঝির বউ হয়ে এলো তার পরদিন পা টিপে টিপে রুশনী গিয়েছিল রতন মাঝির দাওয়ায়। রতন মাঝি তখন নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছে মেঘনায়। নলীনি চৌকির উপর বসেছিল। রুশনী গিয়ে বসেছিল নলীনির পাশ ঘেঁষে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল নলীনির আপাদমস্তক। দেখতে চেষ্টা করেছিল ওখানে রতন মাঝির ভালবাসার চিহ্ন কতটুকু লেগে আছে।
নলীনির মুখের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল : ঐ মুখটার মইধ্যে যার ছোঁয়া পড়ছে কাল রাইতে, সেতো পড়ার কথা আছিল আমার মুখে। রুশনী নলীনির মেন্দিপরা হাত দু’টো টেনে নিয়ে নিজের মেন্দিপরা হাত দু’টোর পাশে বিছিয়ে তাকিয়েছিল অনেকণ। মনে মনে বলেছিল :
খালি একটা নৌকার জন্যি এক হাতের মেন্দি মিছা হইয়া গেল।

একটা আর্তশ্বাস চেপে নলীনির মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই হঠাৎ প্রশ্ন করেছিল রুশনী:
-নাও লইয়া আইছো বৌ? নলীনি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল রুশনীর মুখের দিকে। ভেবেছিল :
তাইলে কি সবাই জানে মাঝি নলীনিরে বিয়া করে নাই। নাওরে বিয়া করছে ।
করুণ চোখ তুলে আস্তে আস্তে নলীনি বলেছিল : -আনি নাই। তবে আনতে অইব।
-জলদি কইরা নাও নিয়া আস বৌ! নাইলে :
-নাইলে কি? প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চেয়েছিল নলীনি। খানিক চুপ থেকে রুশনী অস্বাভাবিক ভাবে হেসে উঠে বলেছিল : - না কিছুনা। এমনি কতার কতা। তুমি খুব সুন্দর বৌ।

নলীনির বুকের ভেতরটা অজানা আশংকায় ধক্ করে উঠেছিল। রুশনীর কৃত্রিম হাসিতে সেই ধুকপুক আরো দ্বিগুণ হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিল : - নাও না নিয়া আইলে কি মাঝি আমারে ছাইড়া দিব। কাইল রাইতে মাঝি নিজেওতো পরথম এইটাই কইল। তারপর পশুর মত ঝাপাইয়া পরল আমার শইলডার উপর। যতণ তিয়াস না মিটল ততণ ছাড়ল না।

স্বামীর কাছে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে নলীনি সারারাত ভেবেছিল, এই ভোগের মাঝে যদি কোন সন্তান আসে নলিনীর পেটে তবে সে কি তাদের ভালবাসার সন্তান হবে! সে সন্তান বড় হয়ে কি মানুষকে ভালবাসতে শিখবে! সে কি তার বউকে ভালবেসে বুকে জড়িয়ে ধরবে কখনো! কিন্তু কিভাবে! রতন মাঝির সাথে আজ আমার যে সম্পর্ক তৈরি হইল সেতো কোন ভালবাসার সম্পর্ক না। বিয়ে হইলেই সে সম্পর্ক ভালবাসার সম্পর্ক হ্ইতে পারে না।
রুশনী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা। ভয়ে ভয়ে পা টিপে টিপে পার বেয়ে নেমে আসে নিচে। কাদা পানিতে পা ডুবে যায়। কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকে :
-মাঝি। রতন মাঝি পেছন ফিরে তাকায় শুধু। কিছু বলে না।
কাঁপা কাঁপা গলায় রুশনী আবার বলে : -ঘরে যাও মাঝি। এইভাবে রইদে পুইরা কষ্ট আর বাড়াইও না মাঝি।

বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর আজ পাঁচ বছর ছ’মাস শেষ হয়ে এলো প্রায়। এর মাঝে রতন মাঝির সাথে রুশনীর একদিনও কথা হয়নি। রুশনি নিজেই সামনে পড়লে দ্রুত আড়াল হয়ে গিয়েছে? আড়ালে গিয়ে কেঁদে ভাসিয়েছে বুক। আর রু মেজাজের মাঝির বুকে তো রুশনীর জন্য কোন অনুভূতিই নেই। নিয়মের ছাঁচে বাঁধা রতন মাঝি সকালবেলা গিয়ে নাও ভাসায় মেঘনায়। সারাদিন নদীর ওপর ভেসে ভেসে মানুষ পার করে। তারপর সন্ধ্যায় ডেরায় ফিরে নাকে-মুখে গো গ্রাসে ভাত খেয়ে চৌকির উপর শুয়ে কান্তি ভুলে। একটা মেয়েকে বউ সাজিয়ে অন্য একটা মেয়েকে ঘরে তুলে এনেছে এ পাপ বোধ মুহুর্তের জন্যও নাড়া দেয়নি কখনো রতন মাঝিকে। সেখানে রুশনী সামনে পরলেই কি আর না পরলেই কি।

রুশনীর কথার কোন উত্তর দেয় না রতন মাঝি। রুশনীর পাশ কেটে আস্তে আস্তে নদীর পার বেয়ে উপরে উঠে আসে রতন মাঝি। কান্ত শরীরটাকে টেনে টেনে হেঁটে চলে নিজের ডেরার দিকে। দাওয়ায় এসে দাঁড়ায়। তারপর ঝাপ সরিয়ে ডেরার ঢুকে তেল চিটচিটে বালিশটায় মাথা রেখে উপরের দিকে মুখ করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে চৌকিটার উপর। এই প্রথম তার বুকের ভেতরে কোন এক জায়গায় ছোট্ট একটা ব্যথা চিনচিন করে জেগে উঠে। সেখানে অনুভব করে রুশনীকে।

মিয়াদের বাড়ির কাজগুলো এখন আগের চেয়ে আরো অনেক যত্ন করে করে নলীনি। কয়েকদিন কাজে না আসার জন্য নলীনি মনে মনে ভয় পেয়েছিল। ভেবেছিল মিয়া বৌ হয়ত কাজে রাখবে না আর। কিন্তু মিয়া বৌ কিছুই বলেনি। মাতব্বরের বৌরাও মাতব্বরের মতই হয়। কিন্তু হাসিব মিয়া মাতব্বরের বৌকে নলীনির বেশ অন্যরকম বলেই মনে হয়। শান্ত, নিরীহ, দয়াশীল। কাউকে কিছু দিতে মন চায়তো তা উদ্দেশ্যহীন ভাবেই দিয়ে দেয়। নলীনি কাজে এলে প্রায় সময়ই নলীনির পাশে বসে ওদের দুঃখের কথা শোনে।

রতন মাঝির সর্বনাশের কথা মাঝি পাড়া ছাড়িয়ে কেশবপুর গ্রামেও ছড়িয়ে পরে। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের প্রতি মানুষ নির্মাতার পপাতিত্ব থাকে। আর যার উপর থাকে তখন সে যত অপরাধই করুক না কেন, যত দোষীই হউক না কেন সাধারণের চোখে তারপরও সে নির্দোষ। রতন মাঝির প্রতি আল্লাহর সে রকম কিছুটা পপাতিত্ব আছে। রু বদমেজাজী রতন মাঝিকে বেশীরভাগ মানুষই ভেতরে ভেতরে পছন্দ করে খুব। নদী পার হতে গিয়ে রতন মাঝির নৌকাটাই আগে খোঁজে।

রিটা আশরাফের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মধ্য রাতের নদী-এর চতুর্থ পর্ব আসছে... চোখ রাখুন সোনালীনিউজ-এ

কথাসাহিত্যিক ড. রিটা আশরাফ
নরসিংদী জেলার সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় স্বরচিত কথাসাহিত্য প্রতিযোগিতায় বহুবার প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। কথাসাহিত্য রচনায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকেও।
ড. রিটা আশরাফ বর্তমানে বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এইউবি) বাঙলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং একই সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন থেকেই।
তাঁরই সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা। পেয়েছেন ভারতের বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন সম্মাননা (২০১৪), ভিন্নমাত্রা সাহিত্য সম্মাননা (২০১০), গঙ্গা-গোবিন্দ সাহিত্য সম্মাননা (২০১৫), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি সহিত্য পত্রিকা সম্মাননাসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সন্মাননা।
রিটা আশরাফের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বালুচরে বসতি (উপন্যাস), নৈবেদ্যর নারী (উপন্যাস), বিবর্ণ স্বাধীনতা (উপন্যাস), একটু ভুলের অনুভূতি (উপন্যাস), তুতুলের খড়গোশ শিকার (শিশুতোষ গল্প), মামদোভূতের পুত (শিশুতোষ গল্প সংকলন) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনলো যাঁরা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে তৎকালীন বিশ্ব (গবেষণা), নজরুলের কুহেলিকা : একটি সার্বিক পর্যালোচনা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে উপমা (গবেষণা) ইত্যাদি।

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০২)

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!