• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৭)


সাহিত্য সংস্কৃতি ডেস্ক আগস্ট ১৭, ২০১৬, ০৪:৪৫ পিএম
মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৭)

আমাগ মাঝিগরে আল্লায় জন্মই দিছে খালি কষ্ট পাওনের লাইগ্যা। উপাস থাইক্যা একবার ঘরের ভিটা বানমু আর জোয়ারের পানি আইয়া তা ভাসাইয়া লইয়া যাইবো। আবার বানমু আবার ভাসাইবো। এমনে বাইচ্যা থাইক্যা লাভ কি? উঠানে জোয়ারের পানির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে মাঝি। কিন্তু সুখের স্বপ্নে বিভোর নলীনির তন্ময়তা ভেঙ্গে মাঝির এসব কথা কিছুই শুনতে পায়না নলীনি। মাঝি আবার বলে :
-বুঝছস বৌ, মাতব্বরের নৌকায় কাম কইরা কোন কুল কিনারা পাইতাছি না। নলীনি এবারও কিছু উত্তর করে না। তন্ময়তায় মগ্ন নিরুত্তর নলীনির দিকে তাকিয়ে মাঝি ডাকে :
-বৌ!
-হু! তন্ময়তা ভেঙ্গে জবাব দেয় নলীনি।
-কি দেখতাছস অমন কইরা? ঘোর লাগা হয়েই নলীনি বলে :


-দেখেন, উঠানটার মইধ্যে পানিগুলারে কি সুন্দর লাগতাছে। চাঁন্দের আলোতে কেমুন চিক্ চিক্ করতাছে পানিগুলা। এত কষ্টের ভীরেও মাঝির হাসি পায়। হেসেই ফেলে। বলে :
-বউ, তরে যে আল্লায় কিসের জন্যি মাঝির বৌ কইরা দুনিয়াত পাঠাইলো বুঝবার পারি না। এই পানির উপরে ভাইস্যা মাঝি পাড়ার কারো চউক্ষে ঘুম আসেনা আর তুই দেখস পানির উপরে চাঁন্দের আলো। নলীনি অল্প হাসে।
-একটা কতা কমু ভাবতাছি।


-কি কতা কইয়া ফালা। নলীনি লজ্জা পায়। স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে আনে। বৌ-এর এই লজ্জা বড় ভাল লাগে রতন মাঝির। বলে :
-এত লজ্জা পাস কেন বৌ। আমারে এত লজ্জা কিসের।
-আ-আমার মনে কয় আপনি বাবা হইবেন। আমি মা হমু। রতন মাঝি সাথে সাথেই কিছু বলতে পারে না। বোকার মত তাকিয়ে থাকে নলীনির দিকে। হঠাৎ বুকের ভেতর অসম্ভব সুখ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাবার পর দু’হাত দিয়ে বউকে জড়িয়ে ধরে।
-কস্ কি বউ! এত্ত আনন্দের একটা কতা কইতে এত্ত দেরী করলি! রতন মাঝি নলীনিকে পাজা কোলা করে তুলে নিয়ে একেবারে উঠানের মধ্যে পানির উপর এনে দাঁড় করায়। পানির উপর আনন্দে ঘুরে ঘুরে বলে :
-কি আনন্দ! বৌ কি আনন্দ! সত্যি সুন্দর! দেখ বৌ দেখ, ঐ জ্যোৎস্না ভরা আকাশ কত্ত সুন্দর! জোয়ারের পানিগুলারেও কি সুন্দর লাগতাছে। কেমুন চিক্ চিক্ করতাছে পানিগুলা।

মাঝি পানির মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে বউ-এর পেটে হাত রাখে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে বৌ-এর পেটটা। বৌ লজ্জায় দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। রতন মাঝির বৌ পোয়াতি হইছে। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে কথাটা সমস্ত মাঝি পাড়ায় ছড়িয়ে পরে। বিয়ের প্রায় ছ’বছর পরে রতন মাঝির বৌ পোয়াতি হইছে সে খুশিতে সবাই একবার করে এসে দেখে যায় নলীনিকে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলো এর অর্থ কিছুই বুঝে না। তারপরও জোয়ারের পানির উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এসে নলীনির মুখের দিকে ঢ্যাব ঢ্যাব কর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। ওরা কি বুঝল ওরাই জানে।

মুরুব্বীরা এসে আশীর্বাদ করে যায় : -সুখী হও মা। ছয় বছর পর ছাওয়াল আইবো। এরথনে আনন্দের আর কি আছে মাইনসের জীবনে। নলীনি মাথা নিচু করে লজ্জার হাসি হাসে।
রাত বিরানে বাইরে ঘুরাঘুরি কইরো না। এই সময় অনেক বাইছ্যা চলন লাগে। এমন আরো অনেক উপদেশের বাণী শুনিয়ে যায় নলীনিকে বয়স্করা। নলীনি শুধু মাথা নিচু করে শুনে যায় সে সব কথা। সবাই ধরেই নিয়েছিল রতন মাঝির বৌটা বাঁজা। নাইলে এত বছরেও ছাওয়াল হয় না কেন? যদিও বৌ এর মুখোমুখি এসব কথা কেউ বলেনি কখনো। আগে পিছে কানাঘুঁষা চলেছে অনেক।

যে হারু বৌ নলীনিকে বুজান বলে ডাকে, নলীনির সুখে দুঃখে ঝাপিয়ে পড়ে, সে হারু বৌ-ও একদিন কথায় কথায় নলীনিকে বলেছিল :
-একটা কথা কই বুজান।
-ক।
-এতদিন তোমাগ বিয়া অইল অহনও কোন ছাওয়াল আইল না। আর্তশ্বাস চেপে নলীনি বলেছিল :
-ছাওয়াল দিয়া কি অইব।
-অনেক কিছু অইব বুজান। যাগ ছাওয়াল নাই হেরা বুঝেনা এইডা। নলীনি এ কথার কোন উত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে। হারু বৌ আবার বলেছিল :
-একটা কাম করবা বুজান।
-কি?
-মৌলবির কাছ থেইক্যা পানি পড়া আইন্যা খাও। কেশবপুর মরসিদের ইমাম সাবের পানি পড়া অনেক কামের । মাইনসে কয়। তোমারে আইন্যা দিমু বুজান? নলীনি অল্প হোসে বিষণ্ণভাবে বলেছিল :
-ছাওয়াল জন্ম দেওয়নের ক্ষমতা যদি স্বামী-ইস্ত্রীর দুইজনেরই না থাহে তয় হেইডা কি মৌলবির পানি পড়া খাইলেই হইয়া যাইবো!
-কি জানি বুজান। আমি অত্ত কিছু বুঝিনা। মুরব্বীরা কয় তাই আমিও কইলাম।
আইচ্ছা হারু বৌ, ধর পানি পড়া খাইলাম। আমাগর ছাওয়াল আইল। কিন্তু হেই ছাওয়াল যদি মাঝির মত হয়। হেই ছাওয়াল বড় হইয়া যদি বৌরে ধইরা পিটায়। নাও দিতে না পারলে যদি এক মাইয়ারে মেন্দি পড়াইয়া, বউ সাজাইয়া আর এক মাইয়ারে বিয়া কইরা আনে।

হারু বৌ করুণ চোখ তুলে দেখে রতন মাঝির বৌকে। নিজের নারী জীবনের সুখ দুঃখকে দিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে রতন মাঝির বৌ-এর কষ্টকে। হারু মাঝি যেমনই হউক, বৌ বাচ্চারে তিনবেলা পেট ভইরা না খাওয়াইতে পারুক তবুও মানুষটারে হারু বৌ-এর রতন মাঝির থেইক্যা ভালাই মনে হয়। নলীানির কথায় হারু বৌ গভীর একটা আর্তশ্বাস ফেলেছিল শুধু। কোনও উত্তর খুঁজে পায়নি।

হারু মাঝির বৌ দরজার বাইরে নৌকায় বসে হাড়ি পাতিল মেজে জোয়ারের পানি থেকে উপুড় হয়ে ধুচ্ছিল। রতন মাঝির বৌ পোয়াতি হইছে। কথাটা কানে যেতেই সব কিছু ফেলে পানির উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এসে রতন মাঝির ঘরে ঢুকে। নলীনি চৌকিতে বসেছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে হারু মাঝির বৌ বলে :
-বুজান! ও বুজান!
-কিরে হারু বৌ!
-কি হুনলাম এইডা! হাছাই কি! নলীনি লজ্জার হাসি হাসে। কিছু বলে না। হারু মাঝির বৌ পায়ের দিকে ভিজে যাওয়া শাড়ীটা চিপে ঝেড়ে ঠিক করে। তারপর বসে নলীনির পাশে।
-তোমার মাঝি কই বুজান? মাঝি হুনছে? তৃপ্তির নিঃশব্দ হাসি হেসে নলীনি আস্তে বলে :
-হুনছে।
-খুশী হইছে?
-খুব।


-তোমার ছাওয়াল বড় ভাগ্যবান বুজান। দেখোনা আইজ সকাল থেইক্যাই পানি কেমুন নামতে শুরু করছে। তাছাড়া এইবার পানিও বেশি বাড়ে নাই, মানুষও ভাইস্যা উঠছে না একটাও। সত্যিই ভাগ্যবান রে হারু বউ। খানিক চুপ থেকে নলীনি আবার বলে :


-হারু বৌ, তুই আমারে পরায়ই ছাওয়ালের কতা কইতি। তহন আমি মন থেইক্যাই ছাওয়াল চাই নাই। যহন চাইলাম তহনই আল্লায় ছাওয়াল দিল। আমার ছাওয়াল সত্যই ভাগ্যবানরে। বড় ভাগ্যবান হারু বৌ। দেখিস তুই, আমার ছাওয়াল বড় হইয়া মাইনসেরে কিমুন ভালবাসতে শিখে। আমার এ ছাওয়াল আমাগর ভালবাসার ছাওয়াল।

রতন মাঝির বৌ পোয়াতি হইছে। কথাটা রুশনীর কানে গিয়েও পৌঁছায়। রুশনীদের ঘরের পেছনেই একটা কাঁঠাল গাছ। কাঁঠাল গাছের গোড়ার দিকটা চেয়ারের মত কিছুটা বাঁকা হয়ে সোজা উপরে উঠে গিয়েছে। রুশনী সেই গাছের গোড়াতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। জোয়ারের পানিতে রুশনীর পা গোড়ালীর উপর পর্যন্ত ডুবে থাকে। পাশের ডেরার করিম মাঝির বৌ জোয়ারের পানির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসে রুশনীর পাশে বসে।
-রুশনী হুনছস?
-কি?
-রতন মাঝির বৌ পোয়াতি হইছে। রুশনী কৃত্রিম উচ্ছ্বাস দেখাতে গিয়েও পারে না। মলিন মুখটায় একটু হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারে না। করিম মাঝির বৌ আবার বলে :
-মাঝির ছাওয়াল বড় ভাগ্যবান হইবরে রুশনী। দেখ না, পানি কেমুন নামতে শুরু করছে। এইবার মানুষও ভাসছে না একটাও। তাছাড়া মাঝির কপালও খুলছে। রুশনী প্রসঙ্গ পাল্টাবার চেষ্টা করে বলে :
-করিম ভাই নাও ভাসাইছে না আইজ?
-নাও ভাসাইয়া যাগ জীবন চলে জোয়ার হেগরে ঘরে আটকাইয়া রাখে সাধ্যি কি? করিম মাঝির বৌ উসখুস করে রতন মাঝির প্রসঙ্গে আসার জন্য। রুশনীকে খোঁচা দিয়ে কথা না বললে পেট ভরে না করিম মাঝির বৌ-এর। মায়া কান্না দেখিয়ে বলে :
-তর লাইগ্যা আমার বড় কষ্ট হয় রে রুশনী! বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রুশনীর গা জ্বলে যায়। সেতো কখনো কারো কাছে নিজের কষ্টের কথা বলে না। তবে ওর জন্যে মানুষের এত কষ্ট হয় কেন? বিশেষ করে এই করিম মাঝির বৌ-এর। পাশে বসলেই রতন মাঝির প্রসঙ্গ টেনে কথা না বললে যেন তার স্বস্তি আসে না।

রুশনী আজ আর সহ্য করতে না পেরে করুণ ভাব করে বলে :
-আমার লাইগ্যা তোমার এত কষ্ট হয় কেন গো ভাবী।
-রতন মাঝি তর কপালডারে ভাইঙ্গা দিছে। এইডা ভাইব্যা কষ্ট হয়।
-আমার তো কোনও কষ্ট অয় না। তোমার অয় কেন?
-জানি না। তয় তর লাইগ্যা পরানডা পোয়ায় খুব। রুশনী কিছু ভাবে। তারপর একটা আর্তশ্বাস চেপে আস্তে আস্তে বলে :
-আমার লাইগ্যা তোমার পরানডা খুব পোড়ায়?
-খুব পোড়ায়গো রুশনী! রুশনী লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শব্দ করে। তারপর বলে :
-আমার লাইগ্যা তোমার পরানডা যহন এত্ত পোড়ায় তহন একটা কাম করলে কিমুন অয় ভাবী।
-কি কাম?


-রতন মাঝির লগে আমার বিয়া ভাইঙ্গা যাওনের পর তোমার মাঝিও আমারে বিয়া করতে চাইছিল। আমি রাজী হই নাই। অহন করমু। দিবা? করিম মাঝির বৌ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলে :
-ঝাটা মার। ঝাটা মার ঐ মুখে। মাগীর এই জন্যই কপাল পুড়ছে। বলেই দু’লাফে প্রস্থান করে। রুশনী যেমন বসেছিল তেমনি বসে থাকে। অনেক কষ্টের ভীড়েও ঠোঁটের কোনায় ম্লান হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়। জোয়ারের পানি প্রায় নেমে গেছে। এখন কাদার মাঝে ডুবে আছে মাঝি পাড়া। একাধারে সাত-আটদিন ভর রৌদ্র না উঠলে এই কাদা শুকিয়ে যাবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এই কাদার ভেতর দিয়েই পা ডুবিয়ে এ ঘর, ও ঘর, এ বাড়ি, ও বাড়ি করে মাঝি পাড়ার মাঝি, বৌ, ঝি, ছেলে-মেয়েরা।

পানি নেমে যাওয়ায় পর গলে যাওয়া ঘরের ভিটা-ধার পুনণির্মাণে সব বৌ ঝি-রাই জোড় কাজ চালিয়েছে। মেঘনার পার থেকে মাটি এনে ঘরের নতুন ধার তুলছে। রুশনী ঘরের ধারে মাটি বসিয়ে প্লাস্টিকের বদনা থেকে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে গিয়ে বসে সেই গাছটার গোড়ায়। এত যন্ত্রণা বুকের ভেতর। দিনরাত তুষের আগুনের মত ঘষে ঘষে সে যন্ত্রণা বুকের ভেতর জ্বলে আর রুশনীকে কাঁদায়। মাঝির সাথে রুশনীর বিয়ে ভেঙ্গে যাবার দিন থেকে আজ পর্যন্ত একটা দিনও রুশনী ভাল করে ঘুমাতে পারেনি।

এক জীবনে এত যন্ত্রণা কেন বুকের মধ্যি! ভাবে রুশনী। নলীনিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে রুশনীর। সেই যে বিয়ের পরদিন পা টিপে টিপে রতন মাঝির বৌকে দেখতে গিয়েছিল তারপর আর যায়নি। ইচ্ছে করেই নিজেকে লুকিয়ে রেছেছে রুশনী। পাছে কেউ কিছু ভেবে বসে সেই ভয়ে। আজ আবার মনের সাথে যুদ্ধ করে রুশনী পা টিপে টিপে ধুক্ ধুুক্ বুকে হেঁটে চলে রতন মাঝির ডেরার রাস্তা ধরে। নলীনি চৌকিতে বসে আছে। মাঝি বাইরে নষ্ট হয়ে যাওয়া ঘরের বেড়াতে শোলা ঢুকিয়ে তা ঠিক করে। রুশনী হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়ায় আমগাছ আমগাছ তলায়। মাঝির দিকে চোখ যেতেই চোখ নামিয়ে মাঝির পাশ কেটে ডেরায় ঢুকে।

-রুশনী রুজান! আহ। বও। নলীনি উঠে রুশনীকে হাত ধরে চৌকিতে বসায়। বিয়ের ক’দিন না যেতেই লোকের কানাঘুষায় নলীনি জেনেছিল রুশনীর সাথে মাঝির বিয়ে ঠিক হয়েছিল। রুশনীর বাবা নাও দিতে পারেনি। তাই বিয়ের আসর থেকে উঠে গিয়ে নলীনিকে বিয়ে করে আনে রতন মাঝি। নলীনির খুব কষ্ট হয়েছিল শুনে। কিন্তু তখন রুশনীর জন্য করুণা করা ছাড়া আর নিজের জন্য দুঃখ করা ছাড়া কিছু করার ছিলনা নলীনির। কারণ, সামাজিকতার চরম বাঁধনে নলীনি তখন বন্দী। তাছাড়া নলীনি খুব ভাল করে জানে গরীব ঘরের মেয়েদের বিয়ের পর মুখ ফুটে কিছু বলতে যাওয়া আর নিজের পায়ে নিজে কুড়াল দিয়ে আঘাত করা সমান কথা। রুশনীর হাতটা ধরে রেখেই নলীনি বলে :


-সেই যে বিয়ার পরদিন আইলা আরতো আইলা না। ফ্যাঁকাশে হাসি টেনে রুশনী বলে :
-হগলতে কইল রতন মাঝির বৌ পোয়াতি হইছে। এমন সুখের একটা কতা হুইন্যা আমিও তোমারে দেখতে আইছি।

-খুশী হইছি বুজান। আমার পেটের ছাওয়ালরে আশীর্বাদ কইরা যাও।
-আমার আশির্বাদ তোমার ছাওয়ালের জন্য যদি অমঙ্গল হয়!
-না বুজান! এমুন কতা আর একবারও কইওনা। তোমার আশীর্বাদে যদি অমঙ্গল হয়, তয় দুনিয়ার আর কারো আশীর্বাদে তার মঙ্গল হইব না।
-তোমার ছাওয়াল বড় ভাগ্যবান বৌ।
-হ বুজান। তুমি আইছ অহন মনে অইতাছে দুনিয়ার বেবাক ভাগ্যি আল্লায় আমার ছাওয়ালের কপালে লেইখ্যা দিছে। রুশনী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে নলীনির সমস্ত শরীরটা। সেই শরীরে রতন মাঝির ভালবাসাকে খুঁজে ফেরে। নৌকার ছবি খুঁজে ফেরে। খানিক বাদেই বলে :
-অহন যাই বৌ।
-আরেকদিন আইস বুজান।
-আসমু। রুশনী আমগাছ তলা দিয়ে বিষন্ন পায়ে হেঁটে হেঁটে যায় নিজের বাড়ির পথ ধরে। নলীনি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে রুশনীর চলে যাওয়াকে। মনে মনে বলে : জীবন জীবনের লগে ইমুন কইরা প্রতারণা করে কেন? মাঝি পাড়ার চিপাচাপি রাস্তা ধরে বিষন্ন কান্ত মন আর শরীরটাকে টেনে টেনে রুশনী হাঁটে আর ভাবে : রতন মাঝির ঘরে ছাওয়াল হইল। কিন্তু এই ছাওয়াল তো হওনের কতা আছিল আমার পেটে। এই ছাওয়াল হওনের স্বপ্নতো মাঝি দেখাইছিল আমারে। আমার সব স্বপ্ন এমুন কইরা ভাইঙ্গা গেল কেন? কেন ভাইঙ্গা গেল আমার সব স্বপ্ন? কান্নায় ঝাপসা হয়ে আসে রুশনীর চোখ।

রতন মাঝির ঘরে এখন আনন্দের বন্যা। একজন নতুন মানুষ আসবে রতন মাঝির ঘরে। দিনে দিনে বড় হবে সে মানুষ। টুকটুক করে সে সে হেঁটে বেড়াবে সারা বাড়িময়। রতন মাঝিকে বাবা ডাকবে, নলীনিকে মা ডাকবে। যখন তখন এক একটা বায়না ধরে মাঝিকে বিরক্ত করবে। মাঝি যখন নদীতে নাও ভাসানোর জন্য ডেরা থেকে বের হয়ে আসবে দরজায় দাঁড়িয়ে সে তখন আমিও যামু বাজান, আমিও যামু করে চিৎকার করবে। সে চীৎকার বাতাসের সাথে ভেসে ভেসে ছুটে আসবে রতন মাঝির পেছনে পেছনে।

মেঘনায় নাও ভাসিয়ে নাও-এর দাঁড়ে হাত রেখে আরো কত সুখ স্বপ্ন ভাবে রতন মাঝি। নাও কোথায় বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে জানেনা রতন মাঝি। জানার ইচ্ছেও হয়না। মাল বোঝাই নৌকায় আরও একজন মানুষ আছে। প্রতিদিনই থাকে। বেটে বেটে গরনটায় লম্বা একটা মুখ। সে মুখের উপরে টিয়া পাখির নাকের মত একটা নাক। গেঞ্জিটাকে পেটের উপর পর্যন্ত গুটিয়ে রাখে সর্বদা। সেই বলে দেয় কোন দিকে নাও ভিড়াবে মাঝি। তারপর অজানা কোন এক ঘাটে নাও বেঁধে নামিয়ে দিয়ে আসে সেই মাল। লোকটা গুলুইয়ের অন্যপাশে বসে আছে। মাঝি দাঁড় টেনেই চলে। নৌকার ঐ পাশে বসা লোকটা বলে :


-ও মাঝি ভাই। কতা কওনা যে। কি ভাব অত।
-আল্লার দুনিয়ায় ভাবনার কি শেষ আছে ভাই।
-একটা গান ধর না মাঝি ভাই।
-গাইবার পারি না যে।
-হুনলাম তোমার বৌ পোয়াতি হইছে।
-হ ভাই।
-এই জন্যিই বুঝি মনডাত এক ফুর্তি।
-বিয়ার ছয় বছর পরে ঘরে ছাওয়াল আইবো। মনে ফুর্তি হইব না।
-তা কি অইলে বেশি খুশি হও। মাইয়া না বেটা।

রতন মাঝির চোখের সামনে দু’টি মুখ ভেসে উঠে। রুশনী আর নলীনি। করুণ দুটি মুখ। রতন মাঝি যতটা প্রতারণা করেছে ঐ দুই মুখের সাথে, নিজের সাথে। ঐ দুই মুখ তা কল্পনাও করতে পারেনা কখনো।
-কি মাঝি ভাই কইলা না যে।
-মাইয়া পোনাই চাই ভাই।
-কেন? হগলতেই পরথম বেটা চায়। তুমি উল্টা চাও কেন? রতন মাঝি নদীর বহমান পানির দিকে তাকিয়ে আর্তশ্বাস ফেলে। তারপর উদাস ভাবে বলে :
-মাইয়া মানুষ আল্লাহর এক অদ্ভুত সৃষ্টি। পৃথীবির বেবাক সুন্দর এই মাইয়া মাইনসের মইধ্যে। তাই উল্টা চাই।

সন্ধ্যায় বোগল চাপা করে একটা প্যাকেট নিয়ে মাঝি ডেরায় ঢুকে। নলীনি শুয়েছিল। উঠে বসে। মাঝি বৌ-এর হাতে প্যাকেটটা দেয়।
-তর লাইগ্যা আনছি।
-এত্ত সুন্দর শাড়ি! পেকেট খুলে নলীনি বলে।
-পছন্দ হইছে তর।
-খুব!
-পইরা আয়। দেহি। নলীনি লাল ডোরা কাটা জমিনের উপর কালো পাড়ের নতুন শাড়ি পড়ে মাথায় ঘোমটা টেনে এসে মাঝির পা ছুঁয়ে সালাম করে। মাঝি অপলক চোখে তাকিয়ে দেখে নলীনিকে। মাঝির বৌরে আল্লায় এত্ত সুন্দর কইরা বানাইছে। আর হেই সুন্দররে মাঝি এতদিন একবারও চোখ তুইল্যা দেহে নাই। নলীনির দিকে তাকিয়ে ভাবে মাঝি। তারপর ঘোরলাগা ভাবেই বলে :
-তরে যে কি সুন্দর লাগতাছে বৌ!
-শাড়ি কিনলেন। এত্ত টেহা পাইলেন কই।
-মাতব্বর দিছে। মাতব্বরের মনডা বালা। কি কস বৌ?

নলীনির মনে হয় ওর গায়ে যেন অজগর সাপ পেঁচিয়ে আছে। এত শক্ত করে পেঁচাচ্ছে নলীনেকে যে, নলীনি নড়তে পর্যন্ত পারছেনা। মাতব্বরের নাম শুনলেই নলীনির সমস্ত গা শির শির করে উঠে। মনে হয়, এই বুঝি সুখ পালিয়ে গেল। সমস্ত মুখের উপর মুহুর্তে কে যেন ছাই মেখে দিয়ে যায় নলীনির। আস্তে করে শুধু বলে :
-ঠিকঅই কইছেন।
-বিয়ার পরে তরে নতুন কাপড় দিছি মনে পড়ে না। আইজ যহন মাতব্বর টেহা দিল তহন আর কিছু না ভাইব্যা বন্দরে গিয়া তর লাইগ্যা শাড়ীডা কিন্যা আনলাম। তুই খুশী হস নাই বৌ?
-হইছি।
-তয় তর মুখটা ইমুন ভার ভার লাগতাছে কেন?
হঠাৎ নলীনি জানতে চায় :
-আইচ্ছা, মাতব্বরের নৌকায় কি মাল টানেন আপনে?
-আমি জানি না। মাতব্বরের লোকেরা নাও ভইরা রাখে আমি খালি বাইয়া লইয়া যাই। জিগান না কোনও সময়?
-দরকার কি।
-মাল কোন ঘাটে নামাইয়া দেন?
-ঠিক নাই। এক একদিন এক এক ঘাটে। মাঝির সরলতার তল খুঁজে পায়না নলীনি। মাঝির মুখের কোথাও এখন আর আগের সেই রুরতা নেই। মুখটা সব সময়ই কেমন মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এই মুখের উপর আবারো কোন সর্বনাশের ছায়া পরুক এটা ভাবতে পারে না নলীনি।

-আমার একটা কতা রাখবেন?
-কি কতা? নলীনি মাঝির ডান হাতটা টেনে নিজের পেটে রাখে। আমার এই পেটে আপনের সন্তান। এই সন্তান আমাগর ভালবাসার সন্তান। এই সন্তানের গায়ে হাত রাইখ্যা কন রাখবেন আমার কতা।

মাঝি অবাক হয়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নলীনির মুখের দিকে। মাঝে মাঝেই নলীনিকে চিনতে পারেনা মাঝি। বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই ধক করে উঠে। ভাবে : বুকের মধ্যি যে রুশনীর মুখ উঁকি মারে এইটা কি বুঝতে পারে নলীনি! সে কি কথা জানতে চায় এমন কইরা।
-কন্ রাখবেন আমার কতা? মাঝির গলা কেঁপে উঠে। অসংলগ্ন ভাবে বলে :
-রাখমু। ক কি কতা।
-আপনি আর মাতব্বরের নাও টানাবেন না। রুশনীর প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললেও মাঝি হয়ত এতটা বিপর্যস্ত হতো না। কিন্তু মাতব্বরের নাও এর কথায় এক্কেবারে পাথর হয়ে যায় যেন।
কি কইতাছে এইসব বৌ? কেন কইতাছে? মাতব্বরের জন্যি নাও হারাইয়াও সুখের মুখ দেখছি। সেই সুখ পায়ে ঠেইল্যা দিমু? ভাবে মাঝি। আবাক বিস্ময়ে বলে :
-তুই এইসব কি কস বৌ?
-হ। ঠিকঅই কইতাছি। আপনি কন আর বাইবেন না মাতব্বরের নাও।
-খামু কি? তুইওতো অহন কামে যাসনা মাতব্বরের বাড়ি।
-অন্য বাড়িত যামু। আপনি হারু মাঝির কাছ থেইক্যা নাও ভাড়া খাটবেন।
-মাতব্বর এইডা মানব কেন?

-মাতব্বর যা কইবো আপনি তাই করবেন? আপনের পছন্দ অপছন্দ নাই। বিশ্বাস করেন, আমার বড় ডর করে। খালি মনে হয় মাতব্বরের নাও আমাগর সুখ কাইরা লইবো।
নলীনির কাতর অনুনয় মাঝির বুকের ভেতর গিয়ে ঝনঝন করে বাজে। একটা আর্তশ্বাস চেপে নলীনির পেটে হাত রেখেই বলে :
-ঠিক আছে। আমার সন্তানের গায়ে হাত রাইখ্যাই আমি তরে কতা দিলাম। তবু তুই ডরাইস না বৌ। এতডা বছর পরে তরে আমি ভালবাসলেও বড় বেশি ভালবাইস্যা ফালাইছি। এই ভালবাসা হারানোর চিন্তা আমিও আর করি না বৌ। তর আর কোন কষ্ট আমি হইতে দিমুনা।
নলীনি আর হাতে স্বামীর হাতটা চেপে ধরে। পানি এসে ঝাপসা করে দেয় নলীনির চোখ।

দু’দিন ধরে ঘাটে মাল বোঝাই নৌকা বাঁধা পড়ে আছে। রতন মাঝি নাও ভাসায় নাই নদীতে। কথাটা মাতব্বরের কানে যেতেই গজরিয়ে উঠে মাতব্বর।
-কি কইলি গোপাল? রতন মাঝি নাও ভাসায় নাই নদীতে?
-না হুজুর।
-কি কয় মাঝি?
-শইলডা বলে ভালা ঠেকে না।
-মাঝি কই অহন?
-বাড়িতঅই আছে।
-অণে ডাইক্যা আন মাঝিরে। একটু ভেবে নিয়ে সাথে সাথেই বলে :
-না থাক, ডাইক্যা আননের দরকার নাই। মাঝি নিজেই আইবো। বলে ছাগলের মত দাঁড়িাতে কুৎসিত হাসি হেসে হাত বুলায়।

রিটা আশরাফের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মধ্য রাতের নদী’-এর ৮ম পর্ব আসছে... চোখ রাখুন সোনালীনিউজ-এ

কথাসাহিত্যিক ড. রিটা আশরাফ
নরসিংদী জেলার সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় স্বরচিত কথাসাহিত্য প্রতিযোগিতায় বহুবার প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। কথাসাহিত্য রচনায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকেও।


ড. রিটা আশরাফ বর্তমানে বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এইউবি) বাঙলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং একই সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন থেকেই। তাঁরই সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা। পেয়েছেন ভারতের বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন সম্মাননা (২০১৪), ভিন্নমাত্রা সাহিত্য সম্মাননা (২০১০), গঙ্গা-গোবিন্দ সাহিত্য সম্মাননা (২০১৫), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি সহিত্য পত্রিকা সম্মাননাসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সন্মাননা।


রিটা আশরাফের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বালুচরে বসতি (উপন্যাস), নৈবেদ্যর নারী (উপন্যাস), বিবর্ণ স্বাধীনতা (উপন্যাস), একটু ভুলের অনুভূতি (উপন্যাস), তুতুলের খড়গোশ শিকার (শিশুতোষ গল্প), মামদোভূতের পুত (শিশুতোষ গল্প সংকলন) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনলো যাঁরা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে তৎকালীন বিশ্ব (গবেষণা), নজরুলের কুহেলিকা : একটি সার্বিক পর্যালোচনা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে উপমা (গবেষণা) ইত্যাদি।

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৬)


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!