• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৯)


সাহিত্য সংস্কৃতি ডেস্ক আগস্ট ২২, ২০১৬, ০৪:৩৬ পিএম
মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৯)

রতন মাঝির নতুন নাও বাঁধা পড়েছে ঘাটে। কথাটা মাতব্বরের কানে যেতেই গজরে উঠে মাতব্বর। কে যেন গরম শিশা ঢেলে দেয় তার কানে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হুংকার ছেড়ে বলে :
-কি কইলি গোপাল! ঘাটে মাঝির নতুন নাও বান্দা পরছে!
-জ্বী হুজুর।
-নতুন নাও কিনল। এত্ত টেকা পাইল কই! এত্ত টেকা!
-ধার নিছে।
-ধার নিছে? এক চালা ছনের ডেরার ভিত্তে যারা ঘুমায় হেগরে কেউ ধার দেয় না। বুঝলি গোপাল।
-জ্বী হুজুর।
-হেগরে মাইনসে দয়া করে । করুণা করে। নাও কিননের টেকা কেউ ধার দেয় না।

মাতব্বরের কথায় গোপালের মনটা খারাপ হয়। গোপালের বাড়িতেও তো একচালা ছনের ডেরা। তাইলে মাতব্বর কি গোপালকে রতন মাঝির মতই মনে করে! মাতব্বরের অনেক অপকর্মের শাক্ষি এই গোপাল। গোপাল নিজের হাতে কুঠার নিয়ে মাঝির নৌকার তলায় কোপ বসিয়েছে। কেন করেছে এসব গোপাল! মাতব্বরতো গোপালকে কখনোই ঐ ছনের ছাউনির জায়গায় টিনের চাল বসিয়ে দেবে না। মাতব্বরের চোখে গোপালরা সারাজীবন গোপালই থেকে যাবে। আর মাতব্বররা নিজেদের কাজের জন্য এই গোপালদের নিজের ইচ্ছেমত ব্যবহার করে যাবে। মত খারাপ হলেও মাতব্বরের কথার প্রতিবাদ করতে পারে না গোপাল। আল্লাহ গোপালদের এ খমতা দেয়নি।

-চুপ কইরা রইলি ক্যান গোপাল! ঠিক বলি নাই!
-জ্বী হুজুর। ঠিকঅই কইছেন। নতুন নাও কিনে মাঝির মনের অশান্তি যেন আরো বেড়ে যায়। অস্থিরতা সারাক্ষণই মাঝিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। নলীনির সাথেও কথা বলতে ভয় পায়। কে জানে আবার কখন কোন দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায়। মাঝি আজ কতদিন পর আবার নিজের নাও ভাসাবে মেঘনায়। নিজের নাও-এ করে মানুষ পার করবে। সেই জন্য বৌ সেই কাক ডাকা ভোরে চুলায় গরম ভাত চড়িয়েছে। ভাতের ভেতর দু’টা আলু ছেড়ে দিয়েছে সিদ্ধ হবার জন্যে।

মাঝি শুয়েই থাকে। গামছা দিয়ে গা মুছতে মুছতে হারু মাঝি এসে দাওয়ায় দাঁড়ায়।
-রতন মাঝি জাগ নাই।
-কেডা? হারু মাঝি? রতন মাঝি উঠে বাইরে আসে।
-হারু ভাই আহ। নলিনিকে বলে :
-বৌ পিঁড়া দিয়া যা। নলীনি দুটা পিঁড়ি এনে দাওয়ায় রাখে। মাঝি বসে। হারু মাঝিও বসে। হারু মাঝি বলে :
-নাও ভাসাইবা না। আমি যাইতাছিলাম। ভাবলাম, এতদিন পর তুমি নতুন নাও ভাসাইবা তাই একলগেই যাই। নলীনি শাঙ্কিতে করে গুর আর চিড়া নিয়ে আসে।
-ভাবী সাবরে কষ্ট দিলাম। হারু মাঝি বলে।
-কষ্ট না ভাই। নলীনি গিয়ে আবার চুলার ধারে বসে। মুড়ি খেতে খেতে হারু মাঝি বলে :
-তা মাঝি আবার নিজের নাও ভাসাইবা। মন এত ভার কেন?
-আসলে শইলডা ভালা ঠেকতাছে না।
-নাও ভাসাইবা না আইজ?
-ভাসামু। তয় দেরী হইব।
-আমি যাই তাইলে।

নলীনি গরম ভাত শঙ্কিতে বেড়ে পাখা দিয়ে বাতাস করে। হারু মাঝি চলে গেলে রতন মাঝি আবার এসে চৌকিটাতে শুয়ে পড়ে।
-আবার শুইলেন যে। ভাত ঠাণ্ডা হইছে।
-বউ। শইলডা ভালা ঠেকতাছে না। নাও কাইল ভাসামু।
-আপনে এমুন মনমরা হইয়া থাকেন কেন সারাক্ষণ।
-শইলডা ভালা লাগে না।
-কি হইছে।
-বুঝবার পারি না।

সারাদিন নাও ঘাটেই বাঁধা পড়ে থাকে। সেদিকে একবারও পা বাড়ায় না মাঝি। শরীর খারাপের অজুহাতে ঘর থেকেও বের হয় না। তার পরদিনও নাও বাঁধা থাকে। তার পরদিনও।
নলীনি মিয়া বাড়ির কাজটা ছেড়েই দিয়েছে। এর মাঝে মিয়া বৌ কয়েকবার খবরও পাঠিয়েছিল কিন্তু যায়নি নলীনি। ও বাড়ির কথা মনে হলেই ভয়ে বুক কাঁপে। কেবলি মনে হয়, এই বুঝি মাতব্বর সারা শরীরটা উদাম করে ফেলল নলীনির। রতন মাঝি উঠে বাইরে আসে।

মাঝি আজ কদিন ধরে ঘরে বসা। নতুন নাও কিনে এনে সেই যে বেঁধে রেখেছে ভাসায়নি আজও। নলীনি নিজেও লক্ষ্য করছে মাঝির শরীরটা দিনদিন কেমন ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই কিছু বলেও না। নলীনি এর মাঝে বেশ কয়েক ঘর বড় বাড়ি ঘূরে এসেছে। কোথাও কাজ পায়নি। সব বাড়িতেই একজন করে নলীনি আছে। শেষে পেটের দায়ে বাধ্য হয়েই নলীনিকে আবারও পা বাড়াতে হয় হাসিব মিঞা মাতব্বরের বাড়ির পথ ধরে । জীবন যে চলে না আর। মাতব্বরের বাড়ির পেছনে পুকুর পারে আসতেই নলীনি মুখোমুখি হয় মাতব্বরের। তার সেই চিরাচরিত কুৎসিত হাসি হেসে বলে :
-এই যে মাঝির বৌ। তোমাগ ডেরার দিকেই যাইতাছিলাম। তা তোমার লগে দেখা হইয়া -ভালাই হইল। আমার আর কষ্ট করণ লাগল না।
-কি কও বৌ? পা কাঁপে নলীনির। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে।
-তা মাঝি কই?
-ঘরেই আছে।
-শুনলাম নতুন নাও কিন্যা ভাসাইছে মেঘনায়।
-কিনছে। ভাসায় নাই অহনও।
-ভাসায় নাই কেন?
-শইলডা ভালা না মাঝির।
-নাও কিনল টেকা পাইল কই? চুরি করছে নাকি? নলীনি মাতব্বরের চোখের দিকে তাকায় বিষন্ন চোখ তুলে। খানিক বাদে আবার চোখ নামিয়ে আনে।
-যাউগ্যা। যেমনে খুশী টেকা যোগার কইরা নাও কিনুক। এইডা খুশীর কতা। কিন্তু আমার নাও ক্ষতি করল কি? টেকাত আমিও কম দেই নাই। এর উত্তরে নলীনির বলতে ইচ্ছে করে :
মাতব্বর সাব। টেকা দিয়া দুনিয়ার সব কিনন যায় না। যারা এইডা মনে করে হেরা পিরথীবির সবচাইতে বেক্কল। যারা টেকা দিয়া বেবাক কিছু কিনতে পারে না হেরাই পশু হইয়া যায়। যিমুন আপনে। কিন্তু বলতে পারে না কিছুই।

মাতব্বরের চোখ নলীনির সারা শরীরের উপর ঘুরে গিয়ে পেটের কাছে এসে স্থির হয়। দাঁত বের করে হাসে আর বলে :
-মাঝির বৌ। আমি মাঝিরে কিছু কমু না। আমার কথাডা তুমিই কইয়া দিও। মাঝিরে কইবা শইলডা ভালা অইলে নিজের নাও এর দাঁড় টাননের আগে যেন মাতব্বরের নাও এর দাঁড়ে হাত রাখে। তা-না-হইলে-এ- -
-তা না হইলে কি করবেন?

ভয়ার্ত চোখ তুলে মাতব্বরের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় নলীনি!
-তা না হইলে কি করমু? নলীনির পেটের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবারো দাঁত বের করে হাসে মাতব্বর। বলে :
-বিয়ার ছয় বছর বাদে পোয়াতি হইছ বৌ। বড় আনন্দের কতা। বড় খুশীর কতা। তোমার পেটের ছাওয়াল বড় ভাগ্য নিয়া জন্মইবো। দেখলানা এইবার জোয়ারের পানি কেমুন তরতর কইয়া নাইম্যা গেল। তোমাগ মাঝি পাড়ায় এইবার মানুষও ভাইস্যা উঠে নাই একটাও। তোমার ছাওয়াল বড় ভাগ্যবান ছাওয়াল। মাতব্বর একটু থামে। নলীনির পেটের দিকে স্থির দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে দাঁড়িতে হাত বুলায়। তারপর কচলিয়ে কচলিয়ে বলে :
-তয় বুঝলা বৌ, কথা হইল গিয়া বিয়ার ছয় বছর বাদে তুমি পোয়াতি হইলা। ছয় বছর আগে কেন হইল না। আইজ ছয় বছর পরে তুমি কি খালি মাঝির লগে শোওয়নের লাইগ্যাই পোয়াতি হইছ? এই কথাটা খালি মাঝি পাড়ায় না, পুরা এলাকার মধ্যে রাষ্ট্র করণের লাইগ্যা আমার মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগবো।
-কি কমু এইবার বুঝলা বৌ? নলীনি রুদ্ধ নিঃশ্বাসে মাতব্বরের চোখের দিকে তাকায়।
-যাই বউ। তুমি মাঝিরে বুঝাইয়া কইও। মাতব্বর চলে যায়।

একি বলে গেল মাতব্বর? কেমন করে বলল? নলীনির মনে হয় আকাশ নেমে নলীনির মাথায় এসে ভর করেছে। এত ভার। অসহ্য ভার বইতে পারছে না নলীনি। পায়ের নিচে মাটিগুলোও প্রতারণা করছে নলীনির সাথে। মাতব্বর একি বলে গেল! পৃৃথিবী এমন অকৃতজ্ঞ কেন? কাঁদতে ইচ্ছে করে নলীনির। কিন্তু কান্নারাও প্রতারণা করে নলীনির সাথে।


বিষন্ন পা দু’টি টেনে টেনে মাঝি পাড়ার পথ ধরে হাঁটে নলীনি। হাঁটতে হাঁটতে শিমুল গাছ তলায় এসে দাঁড়ায়। গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসে। গাছের উপরে সবুজ ছাদের দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলে : খোদা! সমাজে এই মাতব্বরগর পাশে যদি তুমি আমার মত নলীনিগরে পাঠাইলা তয় বাঁচনের মত কইরা পাঠাইলানা কেন? কেন জীবন আমাগরে লাইয়া মজা করে! কেন মাতব্বররা আমাগরে মানুষ ভাবে না! আমরা কেন মাতব্বরগর সামনে খাড়াইয়া কতা কইতে পারি না! কি আনন্দ পাও এর মধ্যি দিয়া তুমি! কও খোদা! অহন আমি কেমুন কইরা বাঁচমু! মাঝিরে বাঁচামু কেমনে! রাস্তা দেখাইয়া দেও! রাস্তা দেখাইয়া দেও খোদা!

মাঝি চোখ বুঁজে চৌকির উপর শুয়ে আছে। নলীনি পা টেনে টেনে গিয়ে দরজায় দাঁড়ায়। মাঝির চোখ বুঁজে থাকা করুণ, বিষন্ন মুখটার দিকে তাকিয়ে নলীনির মনে হয় :
মাতব্বর নিশ্চয়ই মাঝিরে কিছু কইছে। হেই ডরেই মাঝি নতুন নাও কিন্যাও ভাসায় না। সারাদিন কেমুন মনমরা হইয়া শুইয়া থাকে। মাঝির শইলডাও দিনদিন কেমুন ভাইঙ্গা পরতাছে। ঘরতনেও বাইরে যায় না। জীবনের কোন চোরাপথ দিয়া আমরা হাঁইট্যা যাইতাছি খোদা। বিয়ার পাঁচ বছর ছয়মাস পরে সুখের মুখ দেখলাম, হেই সুখের চারপাশে এমন ঘুণ পোকা কেন? নলীনি গিয়ে বসে মাঝির পাশে। মাঝি চোখ মেলে তাকায়।বিশন্ন কণ্ঠে বলেঃ
আইয়া পরলি যে। মিয়া বৌ কাম দেয় নাই?

নাহ্ । হেগ কামের মানুষ লাগবো না আর। আর্তশ্বাস চেপে বলে নলীনি। নলীনির খুব ইচ্ছে করে মাঝির বুকে মাথা রেখে কাঁদতে। আকাশ যেভাবে অঝোর ধারায় কাঁদে সেভাবে কাঁদতে। কেঁদে কেঁদে নিজেকে হালকা করতে। কিন্তু কাঁদে না। শক্ত করে নিজেকে ধরে রাখে। আস্তে আস্তে বলে :
-একটা কতা কই।
-ক।
-চলেন না আমরা মাঝি পাড়া ছাইড়া পলাইয়া যাই। মাঝির বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠে।
বউ কি তাইলে জাইন্যা গেছে রুশনীর কতা? রুশনী নাও কিনার টেকা দিছে হেই কতা? রুশনীরে অমাবস্যার মাঝ রাইতে মেঘনায় ঘুরাইয়া বেড়ামু হেই কতা? রুশনী দিনে দিনে আমার বুকের মধ্যি অনেক বড় একটা জায়গা কইরা লইছে হেই কতা? বৌ পলাইতে চায় কেন? গোপনে গোপনে বৌ কি তাইলে রুশনীরে হিংসা করতে শুরু করছে?
-কি ভাবতাছেন অত?
-হু! না, কিছু না।
-চলেন না পলাইয়া যাই এইহান থেইক্যা আমরা।

মাঝি কি বলবে ভেবে পায় না। সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মাঝিরও এখানে আর থাকতে ইচ্ছে হয় না। এই রুশনীর সামনে থেকে পালাতে পারলেই যেন বাঁচে । কিন্তু মাঝির এই গোপন ইচ্ছে যে নলীনি এভাবে প্রকাশ করে ফেলবে ভাবতে পারেনি মাঝি। মাঝি কি বলতে গিয়ে আবার কি বলে ফেলবে তাই নলীনির কথার প্রসঙ্গ টেনেই বলে :
-কই যামু?
-আল্লায় পা টাইন্যা যেদিকে লইয়া যাইবো।
-খামু কি?
-অহনই কি খাই। খাইয়া না খাইয়া দিন কাটে।

মাঝি ভয় ভয় মন নিয়ে বলে :


-তর কোন কতাই কোনদিন হুনি নাই বউ। অহন হুনমু। তর বেবাক কতা হুনমু। চল্ আমরা হাছাই পলাইয়া যাই। এই মাঝি পাড়ায় আমারও আর মন থাকতে চায় না। বলেই মাঝির মনটা কুকড়ে যায়। বৌ আবার জানতে চাইবে নাতো কেন এই মাঝি পাড়ায় মন টেকে না। তখন এর উত্তরে কি বলবে মাঝি! কিন্তু নলীনির মাথায় মাতব্বরের চিন্তা এমন ভাবে লেপ্টে বসেছে যে এর বাইরে এখন আর মাঝির মন খারাপ নিয়ে অন্য কোন কারণের কথা ভাবতেই পারে না নলীনি। মাঝির সুমতিতে উচ্ছ্বসিত হয় নলীনি।
-হাছাই কইতাছেন?
-হ বৌ। হাছাই কইতাছি।
-কি যে আনন্দ লাগতাছে আমার। চলেন না আইজ রাইতেই আমরা পালাইয়া যাই।
মাঝির বুকটা আবার ধক্ করে উঠে। আইজ রাইতেই যাইতে চায় কেন! বৌ কি তাইলে হাছাই জানে অমাবশ্যার রাইতের কতা! ধক্ ধক্ বুকে মাঝি একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে :
আইজ থাক। অমাবশ্যা রাইতটা কাইট্যা গেলে পরের রাইতে আমরা নাও ভাসাইয়া দিমু।
সত্যি কইতাছেন?
-সত্যি।

মাঝি হাফ ছেড়ে বাঁচে। পাশাপাশি বৌ এর সরলতায় আরও মুগ্ধ হয়। ভাবে :
মাইয়া মাইনসেরে আল্লায় কত্ত সরল কইরা পাঠাইছে দুনিয়ায়। এই জন্যিই তো পুরুষরা হেগরে এত্ত সহজে ধোকা দিয়া বোকা বানাইয়া রাখে। নলীনিও বুক চিড়ে একটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মনে মনে আল্লাহকে বলে : তুমি বড় দয়ালু খোদা! বড় দয়ালু। মাঝি রাজী না অইলে মাতব্বরের নজর থেইক্যা মাঝিরে কোন ভাবেই বাঁচাইতে পারতাম না আমি। আমি নিজেও বাঁচতে পারতাম না। তুমি বড় দয়ালু। নলীনি উঠে গিয়ে ঘরের কোনায় টানানো শিকার ভেতরে ঝুলন্ত কয়েকটা পাতিলের নিচ থেকে একটা পাতিল নামিয়ে ঘরের মেঝেতে এনে রাখে। পাতিলের মধ্যে থেকে গুপ্তধনের মতো লুকানো একটা পুঁটলি বের করে। খুব যত্ন সহকারে সেই পুঁটলি খুলে মেঝেতে কিছু ভাংতি পয়সা ঢালে।ওখান থেকে গুণে গুণে চার টাকা আটআনা আলাদা করেরেখে বাকীটা আবার পুঁটলি কওে বেঁধে পাতিলে ঢুকিয়ে রাখে। তারপর খুব যত্ন সহকারে সেই পাতিল আবার শিকায় তুলে রাখে আগের মতো। মেঝে থেকে ভাঙ্গতি পয়সাগুলো তুলে এনে মাঝির পাশে রাখে চৌকির উপর। তারপর বলে :
-অহন যান। এইডা দিয়া কিছু গুর মুড়ি কিন্যা আনেন।

মাঝি শুয়ে থেকেই চোখ ঘুরিয়ে দেখে শোলার বেড়ার আড়ালে ছনের একচালা ছাউনির নিচে ছোটো ডেরা ঘরটার চারপাশটাকে। একপাশে কয়েকটা শিকায় কিছু মাটির হাঁড়ি ঝুলছে। এক কোণায় দড়ি টানিয়ে ময়লা, আধা ময়লা কাপড়গুলো তুলে রাখা হয়েছে। আরেক কোণায় একটা চুলা। বৃষ্টির দিনে ঘরের ভেতর বসেই এই চুলায় পাক করে নলীনি। চুলার পাশে একটা পিতলের গ্লাস, দুইটা মাটির শাঙ্কি, একটা প্লাস্টিকের বদনা। এ যেন পুতুল খেলার সংসার।

আজ অমাবশ্যার রাত। সন্ধ্যা যত গাঢ় হয় মাঝির বুকটা তত দুরু দুরু করে কাঁপে। ছয় বছর আগে একটা নৌকার জন্য হাতে মেন্দী পড়িয়ে, গায়ে হলুদ পড়িয়ে বউ সাজিয়ে যাকে মাঝি বউ বানাতে অস্বীকার করেছিল, আজ রাতে তার দেয়া নৌকায় বসে তাকে নিয়েই মেঘনায় নাও ভাসাবে রতন মাঝি। একবার ভাবে যাবে না। কিন্তু পরক্ষনেই মন সায় দেয় না। ভাবে :
তারে কথা দেয়া হইছে। রাখতে হইব। একটা কতা অন্তত রাখতে হইব। জীবন জীবনের লগে এমনে প্রতারণা করলেও মানুষের উচিত না বারবার জীবনের লগে প্রতারণা করা।

রাত যত গভীর হয় মাঝির বুকটাও তত টিপ টিপ করে। মাঝি বুদ্ধি করে নলীনিকে আাগেই বলে রেখেছিল আজ রাতে সে নাও ভাসিয়ে বন্দরে যাবে। কাল সকালে ফিরে এসে বৌকে নিয়ে মাঝি পাড়া ছেড়ে পালিয়ে যাবে জীবনের নতুন ঠিকানা খুঁজতে। বউ কিছুটা বিষ্ময় কিছুটা ভয় তাড়িত চোখে প্রশ্ন করেছিল :
-ঘুট ঘুইট্যা আন্ধার রাইতে নাও ভাসানের দরকার কি? মাঝি উত্তর তৈরি করেই রেখেছিল। তাই সাথে সাথে বলে ফেলেছিল :
-মাতব্বররে বড় ডর করে বৌ। দিনের বেলা নাও ভাসাইলে যদি মাতব্বরের লোকেরা দেইখ্যা ফালায়। এমন করে বলে মাঝি সেখানে অবিশ্বাসের কোন ছোঁয়া থাকে না। তাছাড়া বউ ভাবে : যে কথাটা মাঝি বলেছে এটা আগে বউ-এরই বলার দরকার ছিল। মাতব্বর যে মাঝির, নলীনির দু’জনেরই কতদূর সর্বনাশের জন্য তৈরী এ নলীনির চেয়ে আর বেশী কে জানে। মাঝি আজ রাতে বন্দরে যাবে এই জন্য নলীনিও ঘুমায়নি। মাঝি মাথার নিচে হাত দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে। নলীনি পাশে বসে থাকে। মাঝি কিছু বলেনা। বুকের ভেতর ঢিপ্ ঢিপ্ শব্দটা ক্রমেই জোরালো হয় শুধু।

-রাইত-ত অনেক হইল। কহন যাইবেন?
-অহনই যামু। তুই শুইয়া পড়।
-আপনি গেলেই আমি শুইয়া পড়মু।
-রাইত জাগলে আমাগ ছাওয়ালের অসুবিধা অইব না। নলীনি ম্লান হাসে। কাল সে স্বামীর হাত ধরে মাঝি পাড়া ছেড়ে পালাবে। মাতব্বরের নোংরা চোখের দৃষ্টি থেকে, ভয়ংকর হাতের থাবা থেকে মুক্তি পাবে। সেই আনন্দে নলীনির বুকের ভেতরটা হালকা লাগে খুব। একটা আর্তশ্বাস চেপে নলীনি বলে : এই মাঝি পাড়ায় আপনের শেষ রাইত কাটবো মেঘনার বুকে ঘুট ঘুইট্যা অন্ধকারের নিচে। আর আমার রাইত কাটবো এই ডেরা ঘরটার ভিত্তে খালি চৌকিটায় এইপাশ ঐপাশ কইরা।
-তর কষ্ট হইতাছে বৌ।
-না! আনন্দ লাগতাছে। তয় দুইজনে একলগে থাকতে পারলে আরও আনন্দ হইত। একটু ভেবে নলীনি বলে :
-আমারে লইবেন আপনের লগে? মাঝি চমকে উঠে! বউকি বুঝতে পারছে আইজ রাইতের কতা! লগে যাইতে চায় কেন? নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রেখে খুব ভেবে চিন্তে ভয়ে ভয়ে বলে :
-পাগলের মত কি যে কস বৌ। ছয় বছর বাদে আমাগ ছাওয়াল আইবো। আমাগ ছাওয়ালের ক্ষতি হইব না। নলীনি এর পেছনে কোন যুক্তি দাঁড় করাতে পারে না। লজ্জার হাসি হাসে শুধু। আর নলীনির এই সরলতায় মাঝি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। রাত ঠিক দুই প্রহরে মাঝি ডেরা থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের শরীরের অস্তিত্বও বোঝা যায় না। মাথার উপর তারারা শুধু সেই অন্ধকারকে ভেদ করে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশে উন্মত্ত। মাঝি পাড়া নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে গাছের ডালে মাঝে মাঝে ডেকে উঠে দু’একটা রাত ডাকা পাখি। দূর গা থেকে ভেসে আসে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। নলীনি দরজায় এসে দাঁড়ায়।
-সাবধানে যাইয়েন।
-তুই ভয় পাইস না। ঝাপ ফালাইয়া শুইয়া পড়।
-নতুন নাও। বুইঝ্যা শুইন্যা হাল ধইরেন।

নলীনির মুখের উপর গভীর সরলতার দিকে তাকিয়ে মাঝির মনটা কেঁপে উঠে। ভাবে : এত্ত সরল একটা মুখ। ঐ মুখটারে কেমনে ধোকা দিতাছি আমি। তুই এত ভালা কেনরে বৌ। তর স্বামী আরেক মাইয়ারে লইয়া মেঘনায় নাও ভাসাইতে যাইতাছে আর তুই স্বামীর মঙ্গল চিন্তায় অহনও অস্থির হইতাছস। আল্লায় তগরে এত্ত ভালা বানাইছে কেন? মাঝির অস্তিত্বটা অন্ধকারের সাথে কোলাকুলি করলে নলীনি দরজার ঝাপ টেনে দিয়ে এসে শূন্য চৌকিটাতে শুয়ে পরে। ঘুম আসে না। বহুক্ষন এ-পাশ ও-পাশ করে কাটায়। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত আনন্দ চাগিয়ে উঠে নলীনির। মনে মনে বলে : মাতব্বর, এইবার কারে চোখ রাঙাইয়া কতা কইবা। কাইলই, কাইলই আমরা সবার চক্ষের আড়াল হইয়া জীবনের সুখ খুঁজতে যামু। জীবনের নতুন ঠিকানা খুঁজতে যামু।

কিন্তু পরক্ষণেই মনটা আবার ভয়ে কুকড়ে যায়। আমরা কই যামু! মাতব্বরের ডরে পলাইয়া ত যামু কিন্তু কই যামু! মাতার উপরে একটা ছাউনি কই খুঁইজ্যা পামু। আমাগ ছাওয়লের জন্ম দেওয়নের লাইগ্যা একটা ডেরা কই পামু। খোদা, তুমি কেন যুগে যুগে এইসব মাতব্বরগরে পাঠাইয়া আমগ নলীনিগরে, রতন মাঝিগরে জীবনতনে তাড়াইয়া বেড়াও! কি মজা পাও তুমি! হেগরে পাঠাইয়া পৃথিবীর এত্ত সুন্দররে কেন অসুন্দর কইরা দেও!
তারপরও নলীনির ভাল লাগে। বুক চিড়ে একটা শান্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে।
তারপরেও তো স্বোয়ামীর ভালবাসা আছে। হেই ভালবাসাটুকু আর কাইড়া লইও না খোদা।
হারু মাঝির ঘরের পেছনের তেতুল গাছটার নিচে রুশনী দাঁড়িয়েই ছিল অন্ধকারের সাথে একাত্ম হয়ে। রতন মাঝি এলে নিঃশব্দে মাঝির পাশাপাশি হেঁটে চলে। দু’টি নির্বাক মূর্তি পাশাপাশি হেঁটে গিয়ে নিঃশব্দে উঠে বসে নৌকার মাঝে।

রতন মাঝি নৌকার বাঁধন খুলে পানিতে ভাসিয়ে উঠে বসে তাতে। সেই যে নৌকা কিনে ঘাটে বেঁধেছে আজই প্রথম সেটা বাঁধন শূন্য করে নদীতে ভাসায় মাঝি। মাথার উপর বিস্তীর্ণ তারার মেলা। এছাড়া দূরে জোনাকি পোকার মত এখানে সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট আলো। জেলেরা নদীতে জাল ফেলে নৌকায় বাতি জ্বেলে বসে আছে। সেই আলোর অস্তিত্ব ছাড়া এই অন্ধকারে আর কিছু চোখে পড়ে না। নৌকা হারিয়ে যায় গভীর মেঘনার বুকে। মাঝি পাড়া, জেলে পাড়া, নৌকা ঘাটা, বিস্তীর্ণ চর সব কিছুকে পেছনে ফেলে নৌকা ভেসে বেড়ায় মধ্য রাতের মধ্য নদীতে। এক মনে দাঁড় টেনে চলে মাঝি নিরুদ্দেশ যাত্রার উদ্দেশ্যে। মধ্য রাতের নদীতে নির্বাক মুর্তি হয়ে ভেসে বেড়ায় দুটি নর-নারী।

এ পর্যন্ত মাঝি একবারও কথা বলেনি। রুশনীর দিকে ফিরেও তাকায়নি একবার। বহক্ষনের নিস্তব্ধ গুমোট পরিবেশকে ভেঙ্গে দিয়ে রুশনীই প্রথম ডাকে :
-মাঝি। মাঝি নিরুত্তর দাঁড় টানে। রুশনী অন্ধকারের মাঝে একটা আর্তশ্বাস মিশিয়ে দিয়ে বিষন্নভাবে বলে চলে :
-মাঝি। আমার কি মনে অইতাছে জান। মনে অইতাছে, এই পিরথিবীতে আমার মত এত্ত সুখ আর বোধহয় কাউরে দেয় নাই আল্লায়। এত্ত সুখ মাঝি। আইজ পরায় ছয়ডা বছর তোমারে বুকে রাখছি আমি। তোমার পাশে বইসা মেঘনায় ঘুরতাছি এমুন স্বপ্ন কত্ত যে দেখছি আমি হিসাব নাই। এত্ত সুখ মাঝি।
মাঝি কিছু বলে না। বুক ভেঙ্গে যায়। দাঁড় থেকে ক্ষণে ক্ষণেই হাত থেমে যায়। তবুও হাত শক্ত করে দাঁড় টেনে চলে মাঝি।
-আমারে একবারও তুমি চাইয়া দেখলা না মাঝি। আমি আইজ হাতে মেন্দি পড়ছি, গায়ে হলদি পড়ছি, নতুন শাড়ী পড়ছি, খোপা বানছি, খোপায় ফুল পড়ছি। দেহ মাঝি কত্ত সুন্দর কইরা সাজছি আমি। আমার লগ থেইক্যা একবারও ফুলের বাস পাও না তুমি মাঝি?
রুশনী আঁচলের নিচ থেকে কুপি বের করে আনে। ম্যাচ জ্বেলে কুপিতে আগুন ধরায়। কুপি হাতে নিয়ে ছই এর ভেতর থেকে বের হয়ে এসে মাঝির মুখোমুখি বসে রুশনী। তারপর ঠিক দুজনার মুখের সামনে কুপিটা তুলে ধরে।
-দেহ মাঝি, একবার চাইয়া দেহ, কি সুন্দর কইরা সাজছি আমি। কুপির আলোতে মাঝির চোখ অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও রুশনীর মুখের উপর স্থির হয়। ক্ষণিকের জন্য হলেও হাত কেঁপে উঠে মাঝির। দাঁড় থেমে যায়। রুশনীর মুখ থেকে চোখ নামাতে পারে না মাঝি। তাকিয়েই থাকে অপলক চোখে। সত্যি খুব সুন্দর করে সেজেছে রুশনী। কপালে টিপ পড়েছে, ঠোঁটে রং মেখেছে, পায়ে আলতা পড়েছে, কুঁচি দিয়ে শাড়ী পড়েছে। সব কিছুর মদ্ধে শরল ভালবাশার এক মুখ।ঐ মুখের সাথে কেমন করে প্রতারণা করতে পারে মানুষ শুধু একটা নৌকার জন্য। মাঝি ভেবে পায় না। রুশনী কুপিটা নামিয়ে রেখে হাত দু’টো মাঝির সামনে মেলে ধরে। দেহ মাঝি, আমার হাত দেহ। কি সুন্দর কইরা মেন্দি পড়ছি আমি।

রিটা আশরাফের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মধ্য রাতের নদী’-এর শেষ পর্ব আসছে... চোখ রাখুন সোনালীনিউজ-এ

কথাসাহিত্যিক ড. রিটা আশরাফ

নরসিংদী জেলার সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় স্বরচিত কথাসাহিত্য প্রতিযোগিতায় বহুবার প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। কথাসাহিত্য রচনায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকেও।
ড. রিটা আশরাফ বর্তমানে বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এইউবি) বাঙলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং একই সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন থেকেই। তাঁরই সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা। পেয়েছেন ভারতের বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন সম্মাননা (২০১৪), ভিন্নমাত্রা সাহিত্য সম্মাননা (২০১০), গঙ্গা-গোবিন্দ সাহিত্য সম্মাননা (২০১৫), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি সহিত্য পত্রিকা সম্মাননাসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সন্মাননা।
রিটা আশরাফের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বালুচরে বসতি (উপন্যাস), নৈবেদ্যর নারী (উপন্যাস), বিবর্ণ স্বাধীনতা (উপন্যাস), একটু ভুলের অনুভূতি (উপন্যাস), তুতুলের খড়গোশ শিকার (শিশুতোষ গল্প), মামদোভূতের পুত (শিশুতোষ গল্প সংকলন) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনলো যাঁরা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে তৎকালীন বিশ্ব (গবেষণা), নজরুলের কুহেলিকা : একটি সার্বিক পর্যালোচনা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে উপমা (গবেষণা) ইত্যাদি।

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৮)


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!