• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘মরক্কো’র লাল টুপির রহস্য!


ফিচার ডেস্ক সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৭, ০১:৫৬ পিএম
‘মরক্কো’র লাল টুপির রহস্য!

মরক্কোর বর্তমান রাজা ষষ্ঠ মুহাম্মাদের মাথায় ঐতিহ্যবাহী ফেজ টুপি

ঢাকা: উত্তর আফ্রিকার মুসলিম প্রধান দেশ মরক্কো। যেমন সুন্দর দেশ, তেমনি এ দেশটির অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস। লাল টুপি, ফেজ বা রুমি টুপির ইতিহাসটিও দেশটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ, আজকাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই টুপির ব্যবহার দেখা না গেলেও মরক্কো, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এর প্রচলন এখনো আছে। 

ফেজ বা লাল টুপি হলো সাইপ্রাসের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। এর ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন গ্রিসে এর উৎপত্তি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ফেজ টুপি ব্যবহার করে এসেছে। মধ্যযুগে বাইজানটাইন গ্রিকরা ফেজ টুপি পরেছে এবং অটোম্যান আমলের তুর্কিরা গ্রিক দখল থেকে আনাতোলিয়া মুক্ত করার পর ফেজ টুপি গ্রহণ করে।

প্রায়ত মরক্কোর রাজা দ্বিতীয় হাসান 

ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক জন পিনকার্টন ১৮১১ সালে সাইপ্রাস ভ্রমণে গিয়ে ফেজ-এর ইতিহাস সবার কাছে উন্মুক্ত করেন। ওই সময় তিনি সেখানে প্রত্নতাত্বিক খনন করে ২৭০০ বছরের পুরনো ওই ইতিহাস আবিষ্কার করেন। 

ওসমানি খেলাফতের সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ খানের (১৮০৮-৩৯) শাসনামলে তুর্কিদের জন্য ইউরোপীয় পোশাক রীতি চালু করা হলে অটোম্যান দরবারে ঢিলেঢালা আলখিল্লার পরিবর্তে দরবারের সদস্যরা ইউরোপীয় পোশাক পরিধানে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও টুপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। জনপ্রতিনিধি, আমলা, ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পর্কিত বুদ্ধিজীবীরা ও ওসমানি আমলের আলোকিত মানুষরা ফেজ টুপি দ্বারা মাথা আবৃত করা ছাড়া অন্যান্য পোশাকে পুরোদস্তুর ইউরোপীয় বনে যায়। তখনকার সমগ্র অটোম্যান সাম্রাজ্যে এবং তুরস্ক দ্বারা প্রভাবিত প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতেও ফেজ টুপিকে মুসলিম ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতে থাকে, যা বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

প্রায়ত বক্সার মুহাম্মাদ আলী ও রাজা দ্বিতীয় হাসান ঐহিত্যবাহী ফেজ টুপি পরে

ফেজ টুপির শক্ত আবরণ নামাজে সিজদা দেয়ার সময় মাটি বা মেঝের সাথে কপাল স্পর্শে যেহেতু প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ ছিল, সে জন্য সুলতান এক ফরমান জারি করেন, ফেজ টুপিতে রূপান্তর ঘটানোর জন্য। যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব তুর্কি পুরুষের পরিধান করার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতাও আরোপ করা হয়।

ফেজ বা তুর্কি টুপি নানান নামে ও আকৃতিতে পাওয়া যেত। এর একটি নাম চেচেইয়া। ইস্তাম্বুলে এ টুপি পরিচিত ফেজ, ফেজি, অথবা ফেসি নামে। ফেজ টুপির মিহরীয় সংস্করণের নাম তারবুশ, যে শব্দটির উদ্ভূত হয়েছে ফারসি সর অর্থাৎ মাথা এবং পুশ অর্থাৎ আবরণ থেকে। টুপিটি মূলত প্রান্তহীন, সামান্য কোণাকৃতির, উপরিভাগ সমতল ও লোম দিয়ে তৈরি এবং উপরিভাগে সংযুক্ত থাকে একটি সূতাগুচ্ছ। প্রথম দিকের ফেজ টুপি পাগড়ি সম্বলিত ছিল এবং তা সাদা, লাল বা কালো রঙের হতো। 

ওসমানি খেলাফতের সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ

ইস্তাম্বুলে যখন ফেজ টুপির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, তখন ক্রমে পাগড়িকে বাহুল্য বিচেনা করে শুধু টুপিটি রাখা হয়। সে টুপিও প্রথমে ছিল সম্পূর্ণ গোলাকৃতির, কিছুকাল পর আকৃতি দীর্ঘ হয় এবং শেষ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য হ্রাস পেয়ে বর্তমানে যে অবস্থায় সীমিত আকারে চালু আছে, সে রূপ লাভ করে। অবশ্য তুরস্কের সূফি দরবেশদের খানকায় যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তাদের মাথায় ফেজ টুপি তুলনামূলকভাবে এখনো দীর্ঘ। আগে ফেজের রঙ কয়েকটি রঙের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এক পর্যায়ে লাল রঙই ফেজ টুপির ক্ষেত্রে স্বীকৃত রঙ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ফেজ টুপির জন্যে বিশেষভাবে রঙ সংগৃহীত হতো আমেরিকান ডগউডের তুর্কি সংস্করণ কিজিলিক ফলের রস থেকে। 

তুর্কি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ১৪০০ থেকে ১৭০০ সাল পর্যন্ত ধাতব ফেজ টুপি ব্যবহার করে শত্রুর হামলা থেকে মাথা রক্ষার জন্য। টুপির প্রান্ত থেকে কাঁধ পর্যন্ত লম্বিত লোহা বা অন্য কোনো ধাতুতে তৈরি শিকল ঝুলত বাড়তি প্রতিরক্ষা বর্ম হিসেবে।

কিং ওটো অব গ্রিক

তুর্কি সেনাবাহিনীতে লাল রঙ ফেজের টুপির ব্যবহার শুরু হয় ১৮৪০ এর দশক থেকে এবং ১৯১০ সালে সৈনিকদের জন্য খাকি ইউনিফর্ম ও ধাতব হেলমেটের প্রচলন পর্যন্ত তা বহাল ছিল। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিল অশ্বারোহী বাহিনীতে এবং কিছুসংখ্যক গোলন্দাজ ইউনিটে, যারা লাল কাপড়ের ওরিভাগ সম্বলিত ভেড়ার চামড়ার তৈরি টুপি পরিধান করত।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিশ্বের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর অধীন বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সৈনিকদের শিরস্ত্রাণ হিসেবে ফেজ টুপির ব্যবহার ছিল ব্যাপক। ফরাসিদের অধীন উত্তর আফ্রিকান রেজিমেন্টগুলো অপেক্ষাকৃত উঁচু লাল রঙের ফেজ টুপি পারত, যেগুলোর খুলে রাখার মতো বিভিন্ন রঙের পুচ্ছ সংযুক্ত থাকত। 

ওসমানি খেলাফতের যোদ্ধারা

লিবিয়ায় ইতালির স্থানীয় বাহিনীর সৈন্যরা মাথায় পরত খাটো আকৃতির লাল ফেজ, যেগুলোর খুলিতে থাকত সাদা কাপড়ের টুপি। ইতালীয় সেনাবাহিনীর ইরিত্রীয় ও সোমালি রেজিমেন্টের সৈন্যরাও লাল রঙের উঁচু ফেজ পরত এবং এগুলোর পুচ্ছ হতো বিভিন্ন রঙের। পূর্ব আফ্রিকায় জার্মান আসকারিরা প্রায় সব অনুষ্ঠানে খাকি রঙের পেজ পরিধান করত। 

অনুরূপ, কঙ্গোতে বেলজিয়ান বাহিনীর সৈন্যরা, ফরাসি বাহিনীতে সেনেগালিজরা ও পর্তুগিজ বাহিনীতে ইন্দোনেশীয়রা দীর্ঘ ও স্ফীত লাল রঙের ফেজ টুপি মাথায় দিত। ব্রিটিশ রাজার আফ্রিকান রাইফেল যাদেরকে পূর্ব আফ্রিকার উপনিবেশগুলো থেকে নির্বাচন করা হতো তারা পরত লাল বা কালো রঙের দীর্ঘ ফেজ টুপি, আর ওয়েস্ট আফ্রিকান ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের জওয়ানরা ব্যবহার করত একই ধরনের খাটো ফেজ। 

নিগ্রোদের মাথায় ফেজ

১৯৫০ সাল পর্যন্ত মিসরীয় বাহিনীর সৈন্যরা লাল রঙের তুর্কি টুপিই পরেছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ওয়েস্ট ইন্ডিয়া রেজিমেন্ট ১৯২৮ সালে নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ইউনিফর্মের অংশ হিসেবে ফেজ টুপি পরে এসেছে। বার্বাডোস রেজিমেন্টে এর রীতি বহুকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল, তবে তাদের ফেজের নিচের অংশে সাদা রঙের পাগড়িসদৃশ্য একটি কাপড় জড়ানো থাকত।

উপনিবেশ পরবর্তী আফ্রিকায় ফেজ টুপির ব্যবহার রহিত হয়ে যায় দেশগুলো স্বাধীনতা লাভের পর পরই। কিন্তু কিছু কিছু স্থানে যেমন- সেনেগালে কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালনের ক্ষেত্রে, ইতালির বারসেগলিয়েরি রেজিমেন্টে ইউনিফর্মের অংশ হিসেবে ফেজ ব্যবহার অনুমোদিত ছিল। বারসেগলিয়েরি রেজিমেন্ট ফেজ ব্যবহার করতে শুরু করে ফরাসিদের আফ্রিকান সৈন্যদের সংস্পর্শে এসে যাদের সাথে তারা ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। 

তরুণ প্রজন্মের মাথায় ফেজ

মরক্কোর ছিটমহল কুটা ও মেলিলায় মোতায়েন স্প্যানিশ রেগুলার (সাবেক মুর) তাবোর দলের সদস্যরা কুচকাওয়াজের ইউনিফর্ম হিসেবে লাল ফেজ ও কালো চোগা পরত। লাইবেরিয়ান ফ্রন্টিয়ার ফোর্স যদিও ঔপনিবেশিক বাহিনীর অংশ ছিল না, কিন্তু তারা ১৯৪০ এর দশক পর্যন্ত ফেজ টুপি পরিধান করেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর ত্রয়োদশ ওয়াফেন মাউন্টেন ডিভিশনের সৈন্যরা, যাদেরকে নির্বাচন করা হয়েছিল বসনীয় মুসলিমদের মধ্য থেকে তারাও ফেজ ব্যবহার করেছে। সাবেক অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের পদাতিক রেজিমেন্টের বসনীয় মুসলিমরা নিজেদের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছিল ফেজ টুপি পরিধান করে। 

ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর মাথায় পাচি

ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতের মুসলিম অঞ্চলগুলো থেকে বাছাইকৃত সৈন্যরা ফেজ টুপি রয়েছে, যদিও হিন্দু ও মুসলিম পদাতিক ও ঘোড়সওয়ারদের সবাই পাগড়ি পরত। পাকিস্তানের বাহওয়ালপুর ল্যান্সারস রেজিমেন্টে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত সবুজ রঙের ফেজ চালু ছিল। আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় অনেক আফ্রিকান স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী, যারা ফরাসিদের পক্ষে কাজ করেছে তারা ফেজ টুপি মাথায় ধারণ করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।

পুরনোপন্থী কোনো হায়দরাবাদী মুসলিম ভদ্রলোক শেরওয়ানি চাপিয়ে মাথায় ফেজ টুপি পরলে সেটিকে অনিবার্যভাবে রুমি টুপি বলা হবে। ভারতীয় উপমহাদেশে রুমি টুপি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ইসলামি পরিচিতির প্রতীক এবং অটোম্যান সুলতানের নেতৃত্বে খিলাফতের প্রতি সমর্থনের দৃষ্টান্ত। 

পরে রুমি টুপি মুসলিম লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে, যে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ রুমি টুপি পরতেন এবং মুসলিম লীগের আরেক নেতা নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান ২০০৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রুমি টুপি ব্যবহার করে গেছেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক তুরস্কের ভিত্তি স্থাপন করে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ফেজ টুপিকে সামন্তবাদের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে ফেজ নিষিদ্ধ করেন, যে টুপি অটোম্যান সাম্রাজ্যের পোশাক রীতির অংশ হিসেবে ১৮২৬ সালে প্রচলন করেছিলেন সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ। মোস্তফা কামাল ইউরোপীয় পোশাক পরিধানকে উৎসাহিত করেন এবং ফেজ টুপির বদলে ইউরোপীয় হ্যাট তুরস্কে শিগগিরই জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ছবিতে ফেজ

তবে তাদেরই খেলাফতের অধীনে থাকা মরক্কোয় পূর্ণভাবে এবং তিউনেশিয়ায় আংশিকভাবে এর ব্যবহার রয়েছে। সেই সাথে নাইজেরিয়াসহ অফ্রিকার মুসলিম প্রধানদেশের রাষ্ট্রনায়করা এখনো এর ব্যবহার করে থাকে। এ ছাড়াও মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে এর ব্যবহার রয়েছে। সূত্র: উইকিপিডিয়া

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এআই

Wordbridge School
Link copied!