• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মানবতার পাহাড়ি রঙ


অর্পণা মারমা ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৮, ০৬:২৮ পিএম
মানবতার পাহাড়ি রঙ

ঢাকা: সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে, পাহাড়ের অনেক নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তির মানবতা দেখে আমি এবং আমার মতো যারা পাহাড়ের বাইরে আছেন, তারা সবাই সত্যিই মুগ্ধ। যারা পারছেন, তাদের অনেকেই সুদূর ঢাকা বা আরও দূর থেকে তাদের সংহতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন, রাঙামাটি হাসপাতালে ‘অবরুদ্ধ’ বা কারও কারও ভাষায় ‘চিকিৎসাধীন’ দুই বোনের জন্য।  অনেকে মানববন্ধন করেছেন, বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে প্লাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন, বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, অনলাইনে পোস্ট দিচ্ছেন; সবই মানবতার খাতিরে। পার্বত্যাঞ্চলের অতি কয়েকজন তো প্রায় প্রতিদিনই রাঙামাটি সদর হাসপাতালের সামনে সময় কাটাচ্ছেন—মেয়ে দুজনের কল্যাণের জন্য, ‘নিজেদের মেয়েদের’ জন্য।

এসবের যে কোনো একটি কাজই ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা অর্জন করার জন্য যথেষ্ট, সেখানে অনেকেই আরও বেশি করছেন, অনেক দায়িত্ব নিচ্ছেন। আন্তরিক ধন্যবাদ সেসব স্বেচ্ছাসেবীর জন্য, যারা হাসপাতালে মেয়ে দুজনকে সঙ্গ দিচ্ছেন, তাদের সঙ্গে রাতে ঘুমাচ্ছেন, তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিচ্ছেন। সত্যি বলতে কি, ধন্যবাদ দেওয়াটা অনেক অনেক কমই হয়ে যায়। অবশ্য এর বেশি আর কিই-বা বলতে পারি।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত এক বাঙালি দিনমজুরের মেয়ে। খাগড়াছড়ির গামারীঢালার মেয়েটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির এক শনিবার সন্ধ্যার দিকে বাড়ির পাশে গরু আনতে গেলে এক পাহাড়ি যুবক তাকে ধর্ষণের চেষ্টার মধ্যেই মেয়েটির চিৎকারে আশপাশের লোকজন চলে আসে এবং আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে আমি অবশ্য ঢাকায় কাউকে প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে শুনিনি; কোনো নারীবাদী সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা তো দূরের কথা। হাসপাতালে ওই মেয়েকে দেখতে কেউ গিয়েছিলেন কিনা, সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই এখানে অবান্তর। কোনো ক্লাস বর্জন, কালোব্যাজ ধারণ, মানববন্ধন বা স্মারকলিপি পেশ করার মতো কিছু করারও প্রয়োজন কেউ বোধ করেনি। হয়তোবা, দিনমজুর কিংবা পাহাড়ের বাঙালি বা যাদের আমরা ‘সেটেলার’ বলে জানি তাদের জন্য মানবতা, ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’ বা মানবাধিকারের মতো কঠিন বিষয় প্রযোজ্য নয়!

গত বছরের জানুয়ারিতে রাঙামাটিতে রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে এক নির্যাতিতা জানিয়েছিল তার ওপর চালানো অত্যাচারের রোমহর্ষক ঘটনাবলি। ‘গলায় শেকল দিয়ে বেঁধে প্রায় দুই মাস ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে রাঙামাটির পাহাড়ি মেয়ে জোছনা চাকমার ওপর’। কারা করেছিল জানেন? আমাদের ইউপিডিএফের স্থানীয় যুব সমিতির কর্মীরা। ঘটনাস্থল তো এই রাঙামাটিই ছিল। তখন না ছিল কোনো ভলান্টিয়ার তার পাশে, না অন্য কেউ! পাহাড়ের বড় নেতা দূরে থাক, কোনো পাতি নেতা বা নেত্রীও জোছনা চাকমার জন্য সহানুভূতি দেখাননি। এমনকি, কোনো প্রতিবাদও করেননি। মনে হয়, তাদের প্রতিবাদের চর্চাটা অনেকটা এরকম যে, স্বগোত্রের দুর্বৃত্তরা যাই করুক না কেন, প্রতিবাদ করা যাবে না; কারণ প্রতিবাদ অপরাধ অনুযায়ী হবে না, অপরাধী অথবা নির্যাতিতার পরিচয় অনুযায়ী হবে।

খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার ক্ষেত্রলাল ত্রিপুরার মেয়ে দীপা ত্রিপুরা ভালোবেসেছিল এক বাঙালিকে। পাহাড়ে এর ফলাফল কী হতে পারে তা জানত বলেই যখন সে তার ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে পালাচ্ছিল, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কিছু কর্মী তাদের অপহরণ করে। পরের ঘটনাবলি পার্বত্য অঞ্চলে সংঘটিত এমন অন্য সব ঘটনার মতোই। ছেলেটিকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে মারধর করা হয়। আর মেয়েটি শিকার হয় একাধিকবার গণধর্ষণের। এমন কি তা মোবাইলে রেকর্ডও করা হয়। ঘটনা বেশি দিন আগের নয়, ২০১৫ সালের জুন মাসের। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও কোনো ধরনের প্রতিবাদ করার সাহস কেউ দেখায়নি। কারণ হয়তোবা, পাহাড়ে নারীর অধিকারের সংজ্ঞা ভিন্ন। আর এখানে প্রতিবাদ তো করা হয় অপরাধী দেখে, অপরাধ দেখে নয়। আয়না চাকমার মতো, দীপা ত্রিপুরার পাশেও কোনো ভলান্টিয়ার ছিল না তাকে মানসিক স্বস্তি দেওয়ার জন্য; আজ যেমন আছে বিলাইছড়ির দুই নির্যাতিতা বোনের জন্য।

সাংগঠনিকভাবে পরিচিত রেটিনা চাকমাকে বিয়ে করায়, দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা সৈকত ভদ্র হয়ে যান প্রতিপক্ষ ‘বাঙালি’। অথচ দুজনই ছিলেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সদস্য। কিন্তু ‘চাকমাদের দৃষ্টিতে যা ভয়াবহ অন্যায় সেই পাহাড়ি-বাঙালি বিয়ের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল। সংগঠনের নেতারাও ‘বিশেষ স্বার্থে’ সৈকত-রেটিনার প্রেম-বিয়ে সংক্রান্ত জটিলতার সমাধানে এগিয়ে আসেনি। এমনকি উপজাতীয় অধিকারের পক্ষে সোচ্চার একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রও তার স্টাফ ফটোগ্রাফারের কোনো অন্যায় নেই জেনেও তার পক্ষে না দাঁড়িয়ে বরং বিশেষ মহলের চাপে চাকরিচ্যুত করেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, স্বয়ং সৈকত ভদ্রের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশেও মেয়েদের ওপর নিলামের মতো মধ্যযুগীয় বর্বরতা সংঘটিত হতে পারে সেটা জেনে আপনারা অবাক হতে পারেন।’

বান্দরবানের রোয়াংছড়ির ১১ পাহাড়ি মারমা কিশোরীর মিয়ানমারে পাচারের ঘটনায় কয়জন ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল, মনে পড়ে না। সোশ্যাল মিডিয়াতে এ নিয়ে আদৌ কোনো প্রতিবাদ বা পোস্ট ছিল কিনা, সেটি নিয়েই আমার সন্দেহ আছে। অথচ একজন বা দুজন নয়, ১১ জন ‘কন্যাশিশুকে ধর্ষণের আলামত সংগ্রহ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা’ করতে বান্দরবান সদর হাসপাতালে পাঁচ সদস্যের মেডিকেল টিম কাজ করেছিল। ভয়াবহ বিষয় হলো, ‘উদ্ধারকৃত পাচার হওয়া ১১ মারমা কিশোরী পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, প্রতিদিন বৌদ্ধ ভিক্ষু উসিরি তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করত।’ কিন্তু ঢাকার রাজপথে কয়জন মানববন্ধন করেছিল বা বিবৃতি দিয়েছিল? কয়টি জাতীয় দৈনিক সংবাদটিকে গুরুত্ব সহকারে ছেপেছিল? রাজশাহী বা চট্টগ্রামে কী কেউ কোনো প্রতিবাদের আয়োজন করেছিল? পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কাজ করেন এমন কয়জন বুদ্ধিজীবী এ ঘটনায় শাহবাগে গিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন? যেহেতু এ ঘটনায় আটক করা হয়েছিল একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ ২ পাচারকারীকে, তাই তথাকথিত অনেক প্রতিবাদী, নারীবাদী বা বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদের প্রয়োজন মনে করেননি বোধ হয়। যেভাবে দুই মারমা বোনের জন্য প্রচার হয়েছে আর আমরা প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছি, ওই ১১ জনের জন্য তা হয়নি।

বিলাইছড়ির ঘটনা নিয়ে যত প্রতিবাদ, সংবাদ সম্মেলন, সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট, মানববন্ধন আর প্লাকার্ডের ছবি দেখছি তার সবই করা হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। বিশেষ কাউকে ছোট করার জন্য; নির্যাতিতার প্রতি প্রকৃত দরদ বা নারীর প্রতি আন্তরিকতা থেকে নয়। আর এ জন্যই যখন সংবাদ পাই, ‘বিলাইছড়িতে নির্যাতিতা দুই কিশোরীর শরীরে শুক্রাণুর আলামত পাওয়া যায়নি’ তখন নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা ও মানবতার কারণে পাহাড়ের যে পূজনীয় ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে মাথা নোয়াতাম তাদের প্রতি ঘৃণা জন্ম হয় মনের গভীরে।

ভাবতে কষ্ট হয়, দুজন অসহায় মেয়ের কষ্ট আর বিশ্বাস তারা কত সহজে নিজেদের স্বার্থে অপব্যবহার করলেন। মাটিরাঙার কুলসুম আকতার, আলীকদমের সেলতিপাড়ার পাখি আক্তার, মহালছড়ির মাইসছড়ি এলাকায় শাহেদা বেগম কিংবা খাগড়াছড়ির আলুটিলাস্থ ইমাং রেস্টুরেন্টে গণধর্ষণের শিকার হওয়া জান্নাতুল ফেরদৌসদের মতো অনেক রোমহর্ষক আর ভয়াবহ ঘটনাগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে গেছে।

আমি জানি, যে ঘটনাগুলো আমি তুলে ধরেছি, এর বাইরেও এমন অনেক অনেক ঘটনা আছে, যেগুলোর বেশির ভাগই পাঠকের অজানা। কারণ, স্বগোত্রের দুর্বৃত্তরা নারীর প্রতি কোনো অন্যায় করলে, ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়; ধর্ষকের বিচার চেয়ে কোনো আন্দোলন হয় না, কোনো মিছিল হয় না, পত্রিকার পাতায়ও কোনো খবর হয় না। যেহেতু বেশির ভাগ সংবাদপত্রের স্থানীয় প্রতিনিধি পাহাড়ি, তাই তাদের বিবেচনায় হয়তো এ ধরনের ঘটনা সংবাদ হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না। কারণ, হয় এই ঘটনাগুলোর শিকার মেয়েরা বাঙালির সঙ্গে প্রেমের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করেছে, নয়তো পার্বত্যাঞ্চলের বাঙালিদের এসব ঘটনার সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই; বরং পাহাড়ের উপজাতি সন্ত্রাসীরাই এগুলো ঘটিয়েছে। এমনকি এটা যদি পার্বত্য অঞ্চলের কোনো বিশেষ বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত কোনো অপরাধ হতো, তাহলে তো এটা নিয়ে কোনো নিউজ করারও হয়তো অনেকে সাহস করত না। যেমনটি হয়েছে রেটিনা চাকমা, আয়না চাকমা, দীপা ত্রিপুরা বা জোছনা চাকমার ক্ষেত্রে।

বিলাইছড়িতে সেদিন আসলে কী ঘটেছিল সেটা সময় হলে সবাই জানতে পারবে। তবে এখন পর্যন্ত অন্তত একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে। তা হলো, পাহাড়ে যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নারীর প্রতি সহিংসতা কিংবা একই ধরনের কিন্তু আরও জঘন্য ও ভয়াবহ ঘটনার পরেও অনেক নেতা-নেত্রী ও ভলন্টিয়ারদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো প্রতিবাদ বা হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়নি। সেখানে বিলাইছড়ির দুই মারমা বোনের জন্য উনাদের দৌড়াদৌড়ি আর যাই হোক আন্তরিকতাপ্রসূত হতে পারে না। এ মায়াকান্নার মুখোশের আড়ালে কী লুকানো আছে, সেটি উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন।

লোকদেখানো বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিশেষ ঘটনায় মানুষকে উত্তেজিত করার চেষ্টায় আর যাই হোক, ফায়দা হবে না। এসব করে, সহজ সরল পাহাড়িদের বেশি দিন বোকা বানানো সম্ভব হবে না। বরং সবার সামনে মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে। তাই আসুন, পাহাড়ি রঙে না রাঙিয়ে মানবতাকে তার প্রকৃত রঙে বিকশিত হতে সাহায্য করি।  রাজনীতির হীন স্বার্থে মানবদরদি না সেজে, মানুষ হিসেবে দল-মত-নির্বিশেষে প্রকৃত মানবদরদি হতে চেষ্টা করি। নারীর প্রতি সংবেদনশীলতার মতো একটা স্বর্গীয় বিষয়কে ব্যক্তিস্বার্থে অপব্যবহার না করে সব নির্যাতিতার প্রতি সমানভাবে সহানুভূতিশীল হই।  প্রকৃত ঘটনা না জেনে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ করার পরিবর্তে, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিই আসল অপরাধীকে ধরতে এবং তার যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে।

লেখক: কলামিস্ট

সোনালীনিউজ/জেএ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!