• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
ছাত্রী ধর্ষণ

মানবাধিকার কমিশনের মুখোমুখি গুলশানের ডিসি বনানীর ওসি


বিশেষ প্রতিনিধি জুন ৫, ২০১৭, ১২:৪৭ পিএম
মানবাধিকার কমিশনের মুখোমুখি গুলশানের ডিসি বনানীর ওসি

ঢাকা : বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় অবশেষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মুখোমুখি হয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ ও বনানী থানার ওসি বিএম ফরমান আলী।

রোববার (৪ জুন) রাজধানীর মগবাজারে কমিশনের কার্যালয়ে হাজির হয়ে এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, বনানীতে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে তলব করা হয়েছিল। এ মধ্যে দুই পুলিশ কর্মকর্তা এসেছিলেন। আজ (৪ জুন) সকালে ১ ঘণ্টা ধরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা কমিশনের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।

এদিকে বনানীর ধর্ষণ ঘটনায় গঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। দীর্ঘ তদন্তে কমিশন দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের সত্যতা পেয়েছে। সেই সঙ্গে ঘটনায় বনানী থানা পুলিশ, ঘটনাস্থল রেইনট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি পেয়েছে কমিটি।

তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্যের পাশাপাশি আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের তদন্ত কমিটির আহবায়ক নজরুল ইসলাম।  

কমিশন সূত্র জানান, রোববার (৪ জুন) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মগবাজার কার্যালয়ে উপস্থিত হন ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ ও বনানী থানার ওসি বিএম ফরমান আলী। এরপর সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত তাদের তারা কমিশনের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদেরকে প্রশ্ন করেন। কমিশন তাদের কাছে জানতে চান, দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনার ৪০ দিন পর ভুক্তভোগীরা গত ৬  মে সন্ধ্যায় বনানী থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করতে গেলে থানা কেন এই মামলা নিতে দেরি করা।

বিচারপ্রার্থী দুই শিক্ষার্থীকে কেন থানার ভেতরে অপমানজনক কথা বলা হয়, ওসি বনানী ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন কিনা, রেইনট্রি হোটেলে রেখে ধর্ষণের ঘটনা জানার পর তারা কি ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন, এক্ষেত্রে রেইনট্রি হোটেল কর্তপক্ষের কারো সহযোগিতা আছে কিনা, ভুক্তভোগী দুই তরুণীকে হয়রানির অভিযোগ, মামলা করার পর আসামিদের গ্রেপ্তার করতে বনানী থানা পুলিশ কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল, মামলার প্রধান আসামি অপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ বাসায় থাকলেও তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি এমন আরো অনেক প্রশ্নের জবাব চাওয়া হয় তাদের কাছে।

তারা প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তাদের মত করে। অনেক প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেননি। বিশেষ করে বনানী থানার ওসি ফরমান আলী  বেশিরভাগ প্রশ্নের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। আবার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় তিনি অনেকটা ‘ভিত’ ছিলেন। বিশেষ করে দুই শিক্ষার্থীকে থানার ভেতরেই হয়রানি করার ক্ষেত্রে তার প্রশ্নবিদ্ধ ভ‚মিকা নিয়ে প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেনি ওসি ফরমান আলী। এক্ষেত্রে ওসি তার মত করে ব্যাখা দিলেও কমিশনের কাছে তা সত্য মনে হয়নি।
 
দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় মামলা দায়েরের শুরুতেই বনানী থানার পুলিশের ভুমিকা নিয়ে ব্যাপক তোলপার শুরু হয়। গত ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেল ধর্ষনের ঘটনায় মামলা হওয়ার কয়েকদিন আগেই ধর্ষকদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারে পুলিশ।

সাফাত ও নাঈম ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে কয়েক দফা সমঝোতার চেষ্টা চালায়। কিন্তু দুই শিক্ষার্থী তাতে রাজি হয়নি। এক পর্যায়ে সাফাত ও নাঈম একজন সংসদ সদস্যের ছেলেকে দিয়ে বিষয়টি সমঝোতার চেষ্টা করে। সাংসদের ছেলের মাধ্যমে দুই শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের কেউ যেন বিষয়টি নিয়ে মামলা বা কোনো ধরনের উচ্চবাচ্চ্য না করে সে বিষয়ে  হুমকিও দেওয়া হয় তাদের। এতেও দুই শিক্ষার্থী তাদের অবস্থান থেকে না সরতে চাইলে সাফাত-নাঈম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।

বনানী থানা পুলিশ যেন মামলা না নেয় সেজন্য তদবির করতে থাকে তারা। এরপর ভুক্তভোগীরা মামলা করতে গেলে বনানী থানায় তাদের নানানভাবে নাজেহাল করা হয় বনানী থানার ভেতরেই। দুই শিক্ষার্থীকে থানার ভেতরে গালিগালাজ করে বনানী থানার ওসি। মামলা না নিয়ে উল্টো দুই শিক্ষার্থীর চরিত্র নিয়ে উল্টা পাল্টা কথা বলেন ওসি। ডিএমপির তদন্ত কমিটির কাছে এ ধরনের তথ্য দিয়েছে দুই শিক্ষার্থী।
 
ধর্ষণের শিকার দুই শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত ডিএমপি সদর দফতরের একজন পুলিশ কর্মকর্তার সহযোগিতা নিয়ে মামলা দায়ের করে। বনানী থানার ওসি ৪৮ ঘণ্টা পর মামলা নেন। আবার মামলা নিলেও ভুক্তভোগিদের হয়রানি করেন তিনি।  আসামিদের  গ্রেপ্তারে গড়িমসি করেন। তদন্তের শুরুতে আসামিদের পক্ষ নেন বলেও অভিযোগ উঠে। এই নিয়ে গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হলে খোঁদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজি ও ডিএমপি কমিশনার এই নিয়ে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।

সঠিক তদন্তের জন্য মামলা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়। ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাব আসামিদের গ্রেফতার করে। আসামিরা ইতোমধ্যে ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক প্রতিবেদন ছাড়া সিআইডি ও মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তদন্তেও আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

শিগগিরই মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মামলার তদারক কর্মকর্তা ভিকিটিম সাপোর্ট সেন্টারের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আছমা আক্তার মিলি। তবে ঘটনায় পুলিশের গাফিলতিরও প্রমাণ পেয়েছে আলোচিত ধর্ষণ ঘটনার ডিএমপির তদন্ত সহায়ক কমিটি। তবে বনানী থানার ওসি এই নিয়ে নানান টালবাহানা শুরু করেন।

বৃহস্পতিবার (১ জুন) মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে গুলশানের ডিসিসহ তার উপস্থিত হওয়ার দিন ধার্য থাকলেও তারা  উপস্থিত হননি।

পুলিশ, আদালত ও তদন্ত সংশি¬ষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, দুই শিক্ষার্থী আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার আগে ডিএমপির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান। পরে তারা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এর আগে রেইনট্রি হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ডেকে এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়া হয়েছে।

মানবাধিকার কমিশনের সহকারী পরিচালক ও তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব এম রবিউল ইসলাম বলেন, দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় ডিএমপির গুলশান বিভাগের ডিসি ও বনানীর ওসি আজ (রবিবার) মানবাধিকার কমিশন কার্যালয়ে এসেছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তারা এসে তাদের মত করে প্রশ্নের জবাব দিয়েছে।

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে গত ২৮ মার্চ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে দুই তরুণী গত ৬ মে মামলা করেন। এজাহারভুক্ত আসামিরা হলো, সাফাত আহমেদ, তার বন্ধু সাদমান সাকিফ ও নাঈম আশরাফ ওরফে আবদুল হালিম এবং গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ ওরফে রহমত। পাঁচ আসামিকেই  গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছে। এদের মধ্যে সাফাত আহমেদ, সাদমান সাকিফ, নাঈম আশরাফ ও বিল্লাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

মামলার আসামিরা ইতিমধ্যে দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আর অন্যান্য আলামতে সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া  গেছে। রেইনট্রি  হোটেল থেকে জব্দ করা সিসিটিভি সার্ভার  মেশিন ও   হোটেলে অবস্থানের নথিপত্রও পরীক্ষা করে অভিযোগের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সোনালীনিউজ/জেডআরসি/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!