• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মায়ের থাপ্পড়ে পাল্টে গেল আমার বৈশাখ


হৃদয় আজিজ এপ্রিল ১৪, ২০১৭, ০৭:১১ পিএম
মায়ের থাপ্পড়ে পাল্টে গেল আমার বৈশাখ

ঢাকা: গাঁয়ের ছেলে আমি। শৈশব আর কৈশোর কেটেছে সেই অঁজপাড়া গাঁয়েই। আর সেই পাড়াগাঁয়ের যত উৎসবই থাক না কেন পহেলা বৈশাখের কথা ভুলতে পারা কঠিন। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের প্রাণের যোগসূত্র। খুব বেশি দিন আগের কথা কি? এই তো মনে হয় কয়েকদিন আগেই পার করে এলাম কৈশোর। বাঙলা নববর্ষ স্মৃতিতে একেবারেই জ্বলজ্বল করছে। যখনকার কথা বলছি, সেটা ছিল নব্বই দশকের শেষের দিক। তখন অনেক ছোট।

পহেলা বৈশাখ বলতেই বুঝতাম হালখাতা; নতুন নতুন মিঠাই খাওয়া আর বাবার হাত ধরে মেলায় যাওয়া। এ আনন্দ সবকিছুর থেকে একেবারেই আলাদা। বৈশাখের সকালে গোসল সেরে নিতাম আগেভাগেই। দেরি হলে আমাকে ফেলে রেখেই বাবা তো কাজে চলে যাবে। তাই যদি আগেই রেডি হয়ে থাকি তাহলে বাবা না করতে পারবে না।

সকালের খাওয়া শেষ হতেই বাবার সঙ্গে জেদ করতাম তক্ষুণি রওনা হওয়ার জন্য। বাবা কাজের মানুষ, প্রতিদিনই তার ব্যস্ততা থাকতো। তাই বোঝাতেন, এত সকালে মেলা বসেনি। আর এ সময় মেলায় গেলে কিছুই পাওয়া যাবে না।

তখন একটি ঘণ্টাকে মনে হতো এক বছরের সমান! কয়েকটি ঘণ্টা কেটে যেতে অসহ্য অস্থিরতায়। দুপুরের খাবার খেয়ে তবেই না বাবা আমার হাত ধরে নিয়ে যেতেন মেলায়। পাশের গ্রামেই বসতো পহেলা বৈশাখের মেলা। সে কি যে আনন্দ মেলায় পৌঁছানোর আগেই কানে ভেসে আসতো বাঁশির সুর, মানুষের কোলাহলের শব্দ। নানা প্রকারের বেলুন, ঘুড়ি, নাগরদোলা।

তবে বাবা মনে হয় আমার পছন্দ বুঝতেন। আগেই ভাগেই গিয়ে বসাতেন মিষ্টির দোকানে। সেখানে পেটভরে খাওয়া হতো মিষ্টি। আমার তো কোনো ভাই-বোন নেই্। তাই ভাগ বসানোর তো কেউ নেই। নিশ্চিন্তে প্রিয় মিষ্টিগুলো খেয়ে ফেলতাম। প্রিয় ছিল জিলাপি, কালো জাম মিষ্টি, খাজা। তবে আরো কত নাম না জানা মিষ্টি যে দৃষ্টি কাড়তো আজ মনেই নেই। 

বলা বাহুল্য, পেটভরে মিষ্টি খাওয়ার সময় মিষ্টি রস পড়ে মেখে যেত নতুন জামা। বাড়ি এসে মায়ের বকুনি খেতে হতো। মিষ্টি খাওয়া শেষে লাঠি খেলা দেখার পালা। লাঠিয়ালরা বাহারি সাজের পোশাক পরে বাদ্যের তালে তালে লাঠির কসরত দেখাতো। কখনও নগরদোলায় উঠতাম। সাপ খেলা, পাতা খেলারও আয়োজন হতো। এসব দেখতে দেখতে গড়িয়ে যেত বিকেল। ফেরার আগে বাবার হাত ধরে আবারো খাবারের দোকান যেতাম। মুড়ি-মুড়কি, পিঁয়াজু, জিলাপিসহ হরেক রকমের মিঠাই কিনে বাড়ির পথ ধরতাম। এক ফাঁকে টমটম, বাঁশি ও মাঠির খেলনা কিনতে একদম ভুল হতো না।

এরপরেও বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি ছিল রুটিন বাঁধা। মায়ের কথা, মিষ্টি খাওয়া ভালো, তবে এভাবে জামা নোংরা করে বাড়ি ফেরা ভালো নয়। মায়ের বকুনি খাওয়ার পর কয়েকদিন পড়ালেখা শিঁকেয় উঠতো। মেলা থেকে কিনে আনা খেলনা নিয়ে সকাল বিকেল শোডাউন করতাম পুরো পাড়া। ক্লান্ত হয়ে কখনও ঘুমিয়ে পড়তাম রাতে ঘরে ফিরে। মা কখনও কখনও ডেকে তুলে রাতের খাওয়া খাওয়াতো। কি যে মধুর দিনগুলি। আর বড্ড মনে পড়ে।

নববর্ষ আর পহেলা বৈশাখের আমেজ কয়েকদিন থাকতো। কখনও কখনও মেলা থেকে আনা মিঠাই পাত্রে করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দলবেঁধে খাওয়া হতো। তারপর নতুন খেলনা নিয়ে সবাই খেলতে যেতাম। কেউ মেলা থেকে কিনে আনতো টমটম। সেগুলো নিয়ে রাস্তায় দৌড় দিতাম। কেউ কেউ আবার মাটির হাড়ি-পাতিল দিয়ে খেলতো। সংসারী খেলা। আবার কেউ ফুটবল নিয়ে মাঠে যেত।

এভাবেই কয়েকদিন চলতো। তারপর যখন খেলনাগুলো নষ্ট হতো তখন মনে শেষ হয়ে যেত মেলার সেই আনন্দ। শৈশব থেকে যখন কৈশোরে পা দিলাম, তখন কিছুটা অন্যরকম হয়ে গেল পহেলা বৈশাখের সেই অনুভূতি।

একবার পহেলা বৈশাখে দূর গ্রামে আয়োজন করা হয়েছে নৌকা বাইচের। তখন ক্লাস সিক্সে উঠেছি। আমার গ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের স্কুলে একাই যেতাম সাইকেলে করে। এ কারণে বাবা মায়ের একটু বেশিই চিন্তা হতো। তার ওপর আবার বাবা-মার একমাত্র সন্তান। তো সেবার ৬ কিলোমিটার দূরের বিলে নৌকা বাইচ দেখার খুব লোভ হলো। ক্লাসের কয়েকজন মিলে প্রথম ক্লাস শেষেই পালিয়ে ওই খেলা দেখতে যাই। খেলা দেখা শেষে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ৯টা বাজে। 

আমার দেরি দেখে তো বাবা-মা চিন্তায় অস্থির। সন্ধ্যায় স্কুলশিক্ষক আমিনুর স্যারের বাড়ি গিয়ে জানতে পারেন, আমরা কয়েকজন মিলে অনেক আগেই স্কুল থেকে পালিয়ে গেছি। তবে কোথায় কী কারণে গেছি তা তিনি জানাতে পারেননি। একথা শুনে চিন্তিত মা বাবা আত্মীয় স্বজনসহ সব জায়গায় খোঁজ খবর নেন। কিন্তু কেউই বলতে পারেনি আমি কোথায়। অবশেষে মা বাড়িতে কান্না শুরু দেয়।

এই যখন বাড়ির পরিস্থিতি তখন সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে অনেক মানুষের গলা শুনতে পাই। বুঝতে পরি কিছু একটা ঘটেছে। ভয়ে ভয়ে সাইকেলে বেল দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ি। দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কোনো গ্রহ থেকে এসেছি আমি। মা সোজা এসে জিজ্ঞাস করলো, কোথায় গেছিলি? মার রুদ্রমূর্তি। পাশ থেকে কেউ কেউ বলছে, এত রাত হবে, বাড়িতে জানাতে পারিস না.. ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসময় রুদ্রমূর্তির মা জলচৌকিতে বসা থেকে উঠে এসে গালে সজোরে থাপ্পড় কষে দিল। সেই থাপ্পড় খাওয়ার পর থেকেই পহেলা বৈশাখে দূরে কোথাও যাওয়ার ঝুঁকি নিতে পারিনি।

লেখক: সংবাদকর্মী

সোনালীনিউজ /ঢাকা/এআই

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!