• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত আইয়ুব বাচ্চু

মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় আইয়ুব বাচ্চু


বিনোদন প্রতিবেদক অক্টোবর ২০, ২০১৮, ০৭:২৭ পিএম
মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় আইয়ুব বাচ্চু

ঢাকা : বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র আইয়ুব বাচ্চুকে জন্মস্থান চট্টগ্রামে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে।

শনিবার (২০ অক্টোবর) বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে চৈতন্য গলির বাইশ মহল্লা কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

শনিবার বেলা ১১টার দিকে ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে আইয়ুব বাচ্চুর কফিনবন্দি মরদেহ চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে পৌঁছালে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এই শিল্পীর মরদেহ গ্রহণ করেন। এসময় বাচ্চুর স্ত্রী, ছেলেমেয়ে আর স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন।

বাদ আছর নগরীর জমিয়াতুল ফালাহ জামে মসজিদ মাঠে আইয়ুব বাচ্চুর চতুর্থ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তার আগে দুপুর থেকে এখানে শিল্পীর প্রতি সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের অঙ্গনে ‘গিটারের জাদুকর’ হিসেবে খ্যাত আইয়ুব বাচ্চু গত বৃহস্পতিবার ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।

তিনি ছিলেন, একাধারে গীতিকার, সুরকার ও প্লেব্যাক শিল্পী। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া আইয়ুব বাচ্চুর শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় নানা বাড়িতেই কেটেছে। দাফনের আগে এই শিল্পীকে শেষবার দেখতে সেই বাড়িতেই ভিড় করেছেন বন্ধু, স্বাজন, আত্মীয় আর অগণিত ভক্ত।

চট্টগ্রামে কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে বাচ্চু গড়ে তোলেন একটি ব্যান্ডদল। শুরুতে ‘গোল্ডেন বয়েজ’ নাম দিলেও পরে বদলে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’।

সেসময় পাড়া মহল্লার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চলত তাদের পরিবেশনা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হোটেল এবং বিয়ের অনুষ্ঠানেও বন্ধুদের নিয়ে গান গাইতেন বাচ্চু। ১৯৭৮ সালে পেশাদার ব্যান্ডশিল্পী হিসেবে বচ্চুর ক্যারিয়ার শুরু হয়। ব্যান্ড দল ‘ফিলিংস’এর সঙ্গে সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে পারফর্ম করতেন তিনি। দুই বছরের মাথায় যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড দল সোলসে।

টানা দশ বছর সোলসের লিড গিটার বাজানোর পর ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চু গড়ে তোলেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি। শুরুতে এলআরবির পুরো নামটি ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’, পরে তা বদলে নাম হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’।

শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত আইয়ুব বাচ্চু : এর আগে এ রকম বহুবার ঘটেছে। হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করছে আর প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মঞ্চে উঠেছেন আইয়ুব বাচ্চু। প্রিয় গিটার নিয়ে যখন তিনি মঞ্চে উঠতেন, তখন উপস্থিত শ্রোতাদের মুহুর্মুহু করতালি প্রতিধ্বনি তুলত।

গতকাল শুক্রবারও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। অপেক্ষা ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। তিনি এসেছেন, তবে গিটারটা নেই। মঞ্চও ছিল না। গিটারের তারে স্ট্রোক করে বলেননি, ‘কী, কেমন আছেন, সবাই?’ তিনি এসেছেন, গিটার ছাড়া, তবে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর রেখে যাওয়া শত শত গানের সুরের মূর্ছনাকে সঙ্গে নিয়ে।

বুকে আইয়ুব বাচ্চুর সেসব সুর ধারণ করে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে হাজারো মানুষ অশ্রুসজল চোখে উপস্থিত হন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাতে। স্কয়ার হাসপাতাল থেকে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নিয়ে গাড়িটা যখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছে, তখন ঠিক সকাল সাড়ে ১০টা। ভিড় আগে থেকেই ছিল। আইয়ুব বাচ্চু পৌঁছার খবরে ভিড় বেড়ে যায় আরো বেশি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের একপাশে রাখা হয় সংগীতশিল্পীর মরদেহ। পেছনে কালো ব্যানার। তাতে লেখা, আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি জাতির শ্রদ্ধাঞ্জলি। কফিন আগলে রাখেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ, শাফিন আহমেদ, রবি চৌধুরী, মানাম প্রমুখ। আরো ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মী ও শিল্পীরা। মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে এ সময় দীর্ঘ লাইন ধরে অপেক্ষা করেন।

শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সংস্কৃতিবিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতাঙ্গনে গিটারের জাদুঘর হিসেবে খ্যাত আইয়ুব বাচ্চু হার্ট অ্যাটাক করে গত বৃহস্পতিবার মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার ও প্লেব্যাক শিল্পী। চার দশক বাংলাদেশের তরুণদের গিটারের মূর্ছনায় মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি। গিটার বাদনে তার খ্যাতি ছিল পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই।

গতকাল শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চুর ভক্ত, অনুরাগীসহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও শামিল ছিলেন। শ্রদ্ধা জানাতে এসে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরসহ অনেকে যেমন চোখের জলে ভেসেছেন, তেমনি শোকসন্তপ্ত হয়ে তার সৃষ্টিকে স্মরণ করেছেন ভক্ত-অনুরাগীরা। আজীবন কেবল সঙ্গীত সাধনায় আইয়ুব বাচ্চুর মেতে থাকার কথাও বারবার ফিরে এসেছে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা নানা মানুষের কথায়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ব্যান্ড সঙ্গীতকে তিনি এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস, নতুন প্রজন্ম তার দেখানো পথে চলে নবচেতনায় উজ্জীবিত হবে। আইয়ুব বাচ্চুর অকালে চলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, আমরা জানি প্রতিটি কনসার্ট তিনি জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু করতেন। আইয়ুব বাচ্চুর সহশিল্পীসহ সঙ্গীত ও সংস্কৃতি জগতের বিভিন্ন জনের কথাও তরুণদের উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে তার অবদানের কথা ফুটে উঠে।

জ্যেষ্ঠ এই শিল্পীর স্মৃতিচারণ করে শিরোনামহীন ব্র্যান্ডের সাবেক ভোকাল তানযীর তুহিন বলেন, বাচ্চু ভাই আমাদের চেয়ে বড় হলেও সবসময় তরুণই ছিলেন। অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে তিনি ব্র্যান্ড মিউজিক করতেন। আমরা যেন সেটা ধরেই বেঁচে থাকি। ব্যান্ডদল ফিডব্যাকের ফুয়াদ নাসের বাবু বলেন, গানের জন্য তার পরিশ্রম, সাধনা ও প্যাশন ছিল সার্বক্ষণিক। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে একজন আইয়ুব বাচ্চু। গিটারের অবিরাম সুরের মূর্ছনায় আইয়ুব বাচ্চু ভক্তদের যেভাবে মাতিয়ে তুলতেন, সে প্রসঙ্গও উঠে আসে এই মিউজিশিয়ানের কথায়।

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া আইয়ুব বাচ্চুর কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলো কেটেছে সেখানেই। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে বাচ্চু গড়ে তোলেন একটি ব্যান্ডদল। শুরুতে ‘গোল্ডেন বয়েজ’ নাম দিলেও পরে বদলে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’। পাড়া মহল্লার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চলত তাদের পরিবেশনা। পেশাদার ব্যান্ডশিল্পী হিসেবে বচ্চুর ক্যারিয়ার শুরু ১৯৭৮ সালে। ব্যান্ড দলে ‘ফিলিংস’ এর সঙ্গে সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে পারফর্ম করতেন তিনি। দুই বছরের মাথায় যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড দল সোলসে। টানা ১০ বছর সোলসের লিড গিটার বাজানোর পর ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চু গড়ে তোলেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি।

শুরুতে এলআরবির পুরো নামটি ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’, পরে তা বদলে নাম হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। আইয়ুব বাচ্চুর কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কান্নাভেজা চোখে বিষণ্ন মনে শহীদ মিনার এলাকায় হাঁটছিলেন জনপ্রিয় অনেক গান ও জিঙ্গেলের শিল্পী সুমনা হক। সুমনা হক বলেন, আশির দশক থেকে ওনার সঙ্গে কাজ করেছি। কত কত স্মৃতি! সবগুলো এখন একে একে হৃদয়ে বাজছে।

সঙ্গীত সাধনা ও জনপ্রিয়তার চূড়ায় থাকাবস্থায় তিনি চলে গেছেন। এই যে হাজার হাজার মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা জানাতে তাদের উপস্থিতি এটাই তার বড় প্রাপ্তি। শিল্পী রবি চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, সাফিন আহমেদ, নকিব খান, নাসিম আলী খান, তপন চৌধুরীদের মতো সতীর্থদের সামনে রাখা কফিনে সার বেঁধে শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব চলে। বাচ্চুর চট্টগ্রামের দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন সেখানে তার সঙ্গে কাজ করা ব্যান্ডশিল্পী নাসিম আলী খান। তিনি বলেন, বাচ্চু আমাদের ছোটবেলার বন্ধু। আমরা চট্টগ্রামে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সঙ্গীতের চর্চা শুরু করি।

শিল্পী তপন চৌধুরী বলেন, এখানে এসে আবার বুঝেছি, বাচ্চুর জন্য এত মানুষ পাগল! এটা একটা মানুষের অনেক বড় পাওনা। তার আত্মা শান্তি পাক। শিল্পী রবি চৌধুরী বলেন, কিছু বলতে আসিনি। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। বাচ্চু আমার চট্টগ্রামের বন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে উপ-উপাচার্য কবি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, সঙ্গীতের যে নতুন ধারা ব্যান্ড সঙ্গীত সেখানে আইয়ুব বাচ্চু উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার সঙ্গীত গণমানুষের সাথে সম্পৃক্ত, মানুষের জন্য তিনি গান গেয়েছেন।

এরআগে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। দুই ঘণ্টা পর এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচি। সেখান থেকে জাতীয় ঈদগাহে নেওয়া হয় আইয়ুব বাচ্চুর লাশ। সেখানে জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিএনপি কোনো নেতাকে দেখা না গেলেও জানাজায় ছিলেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন।

জানাজার আগে আইয়ুব বাচ্চুর ভাই জুয়েল বলেন, সঙ্গীতের বাইরেও মা-বাবার প্রতি ভাইজানের ছিল অসীম শ্রদ্ধা। আমাদের জন্য তার স্নেহ ও ভালোবাসা ছিল অফুরন্ত। জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মগবাজারে শিল্পীর নিজের এবি স্টুডিওতে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজার পর আইয়ুব বাচ্চুর তৃতীয় জানাজা হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। জানাজা শেষে এই শিল্পীর মরদেহ ফের হিমঘরে রাখা হয়। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে আইয়ুব বাচ্চুর মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব ও ছেলে আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুব দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। তাঁরা এলে চট্টগ্রামে শনিবার মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন আইয়ুব বাচ্চু।

মায়ের কবরের পাশেই দাফন : চট্টগ্রাম নগরীর বাইশ মহল্লা কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশেই দাফন করা হয়েছে জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে।

আইয়ুব বাচ্চু ভগ্নিপতি ওমর উদ্দিন আনসারী জানান, শনিবার সকালে মরদেহ চট্টগ্রামে আনা হয়েছে। এরপর বাচ্চুর নানাবাড়ি মাদারবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বাদ আসর চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!