• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে মাগুরায় দুই ভাইয়ের আত্মদান


মাগুরা প্রতিনিধি নভেম্বর ১৯, ২০১৬, ১০:১৬ পিএম
মুক্তিযুদ্ধে মাগুরায় দুই ভাইয়ের আত্মদান

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আহম্মদ ও মহম্মদ

নিরবে চলে গেলো মুক্তিযুদ্ধে দুই ভাইয়ের আত্মদানের দিন। ১৯ নভেম্বর মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের ইতিহাসে শোকাবহ দিন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপজেলা সদরে সংগঠিত পাক বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন সহোদর হাবিুবুর রহমান মহম্মদ (২৭) ও আহম্মদ হোসেন (২৫)। একই সাথে শাহাদৎবরণ করেন তৎকালিন ই.পি.আর সদস্য মহম্মদ আলী নামের আরেক বীর যোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধে  বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এদেশ শত্রুমুক্ত করতে এই তিনজন অসামান্য অবদান রাখলেও দিনটি পালনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কোনো কর্মসূচী না নেয়ায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। মহম্মদপুর উপজেলার দীঘা ইউনিয়নের পাল্লা গ্রামের আফসার উদ্দিনের  ছেলে মহম্মদ ও আহম্মদ। ইপিআর সদস্য মহম্মদ আলী যশোরের রূপদিয়া এলাকার বাসিন্দা। এই তিনজনেরই কবর বাড়ির পাশে নাগড়িপাড়া মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে।

এই যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী গোপালনগর গ্রামের বাসিন্দা তৎকালিন ইপিআর সদস্য মুক্তিযোদ্ধা তোজাম্মেল হোসেন জানান, ‘১৯ নভেম্বর ১৯৭১। ঈদুল ফিতরের আগের দিন শুক্রবার রাত আনুমানিক ৯টার দিকে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরের পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের ঝামা গ্রামে মধুমতি নদীর পাড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হতে শুরু করেন। লক্ষ্য মহম্মদপুর উপজেলা সদরের টিটিডিসি হলে ওয়েস্ট পাকিস্থান রাইফেলস (ডাব্লুউপিআর)এর রেঞ্জার্স ফোর্সের শক্ত ঘাঁটিতে অপারেশন পরিচালনা করা। মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক গোলাম ইয়াকুব, নূর মোস্তফা, আবুল খায়ের নেতৃত্বে দুইশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা টিটিডিসি হলের চারপাশ ঘিরে ফেলেন। ভোর চারটার দিকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ি মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পের চারদিক দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালায়।

চারটি দলের সাথে আমি প্রথম রাজাকারদের ক্যাম্পে গুলি চালাই। উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ সময় গুলি বিনিময় চলতে থাকে কিন্তু সুসজ্জিত ওয়েস্ট পাকিস্থান রাইফেলস রেঞ্জার্স ফোর্স অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় আমাদের চারটি দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। সুরক্ষিত কংক্রিটের বাংকার থেকে ভারি অস্ত্রের গুলি ছুড়তে থাকে অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে কোন নিরাপত্তা ব্যুহ ছিলনা। একপর্যায়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন ছোট ভাই আহম্মদ হোসেন। গুলিবিদ্ধ আহম্মদ হোসেনকে সরিয়ে এনে সড়কের পাশে পুকুরের পাশে আশ্রয় নেওয়া হয়। তখন আহম্মদের সমস্ত রক্ত আমার শরীরে। এর কিছুক্ষণ পরেই যুদ্ধে অংশ নেওয়া বড় ভাই হাবিবুর রহমান মহম্মদ ভাইকে বাঁচাতে এসে তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। এক পর্যায়ে আমার দুই হাতের উপর শহীদ হন দুই সহোদর। আহম্মদ-মহম্মদের মৃতদেহ একপর্যায়ে পুকুরের পানিতে পড়ে যায়। আমরা চলে গেলে রাজাকাররা আহম্মদ-মহম্মদের লাশ নিয়ে উল্লাস করতে থাকে। এই যুদ্ধে পাকিস্থানি দোসরদের ১০/১৫ জন নিহত হয় বলে তারা জানতে পারেন।’

মহম্মদ ও আহম্মদ দুই ভাই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। হাবিবুর রহমান মহম্মদ ঝিনাইদহ সদরের সাগান্না প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আহম্মদ হোসেন পাল্লা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ছিলেন। শহীদ মহম্মদের স্ত্রী  আনোয়ারা বেগম (৬৫),  তিন ছেলে ও এক মেয়ে আছেন। শহীদ আহম্মদ হোসেন ছিলেন অবিবাহিত।

শহীদ মহম্মদের স্ত্রী  আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘স্বামী তার ছোট ভাইসহ তিনজন বীর যোদ্ধা একই সাথে শহীদ হন। অনেক কষ্ট  ত্যাগ হয়ত সহ্য করেছি। তবে না পাওয়ার কোন বেদনা বা অতৃপ্তি নেই। কারণ তারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন।’

শহীদ হাবিবুর রহমান মহম্মদের বড় ছেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দুই সহোদরের আত্মবলিদানের ঘটনা খুবই বিরল। তাদের ত্যাগ দেশেকে শত্রুমুক্ত করতে প্রেরণা যুগিয়েছিল। পরিবারের উদ্যোগে নিজ গ্রাম পাল্লায় আলোচনা, কবর জিয়ারত, মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। মহম্মদপুর উপজলা পরিষদের উদ্যোগে শহীদ সহোদরের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।  


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!