• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বঞ্চিত কওমির শিক্ষার্থীরা


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৬, ০৯:১৩ পিএম
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বঞ্চিত কওমির শিক্ষার্থীরা

বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকৃত ইতিহাস, পাকিস্তানপ্রীতি ইত্যাদি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্য বই সংশোধন করলেও বিকৃতি রয়ে গেছে কওমি মাদ্রাসার পাঠ্য বইয়ে। সমালোচনার মুখে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী লেখকদের নাম বাদ দেয়া হলেও তাদের লেখা রয়েছে পাঠ্য বইগুলোতে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, এই তথ্যের বদলে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, এমন তথ্য রয়েছে পঞ্চম শ্রেণির ইতিহাস পাঠ বইতে। সরকার স্বীকৃত পাঠ্যসূচি না থাকায় কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা পাঠ করছে ভুল তথ্য ও বিকৃত ইতিহাস। ফলে সঠিক ইতিহাস, সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত কওমির শিক্ষার্থীরা। কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যবই ঘেঁটে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি কওমি বোর্ডের পাঠ্য বইয়ের ভুল ও বিতর্কিত লেখকদের লেখা নিয়ে সমালোচনা হলে বিতর্ক এড়াতে কৌশলে পাঠ্যবই সংস্কার করা হলেও, তাতে তথ্য বিকৃতি দূর হয়নি। ভুলে ভরা এসব বইয়ে নেই আধুনিকতার ছোঁয়া এবং প্রযুক্তি নিয়ে কোনো তথ্য। কোনো কোনো শ্রেণির ইতিহাস বইয়ে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থাকলেও তা বিভ্রান্তিতে ভরা। এমনকি নেই স্বাধীনতাদিবসের তথ্যও।

কওমি মাদ্রাসা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৪ হাজার ৯৩১টি। মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এসব মাদ্রাসার নেই কোনো সরকারি স্বীকৃতি ও নিয়ন্ত্রণ। পাঠ্যসূচিও অনুমোদিত নয়। দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ১৭টি জাতীয় ও আঞ্চলিক বোর্ড। এর মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড হচ্ছে, হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)। প্রায় ছয হাজার মাদ্রাসা রয়েছে এই বোর্ডের অধীনে। বেফাকের প্রণীত পাঠ্য বইগুলো পড়ানো হয় অন্যান্য বোর্ডের মাদ্রাসাগুলোতেও।

কওমি মাদ্রাসার পাঠ্য বই ঘেঁটে দেখা গেছে, বেফাকের পঞ্চম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের ৬১ পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম’ প্রবন্ধে। যদিও প্রথম প্রকাশের সময় এই প্রবন্ধ ছিল না। ২০১৪ সালে তৃতীয় সংস্করণের সময় ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম’ প্রবন্ধটি যুক্ত করা হয়েছে। তবে এই প্রবন্ধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উল্লেখ থাকলেও নেই স্বাধীনতা দিবসের কোনো তথ্য।

এ ছাড়া ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এমন তথ্য রয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০১৫ সালে বইটি সংশোধন করে বাদ দেয়া হয় স্বাধীনতার ঘোষক অংশ। ২০১৬ সালে পুনরায় সংশোধন করা হয় বইটি। সেখানে সংযুক্ত করা হয়েছে ‘এমনই এক নাজুক সময়ে ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।’ যদিও জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক বলে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন।

কওমি মাদ্রাসার বোর্ডের বিভিন্ন শ্রেণির ‘সাহিত্য সওগাত’ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ) বইতে গদ্য, পদ্য ও প্রবন্ধ থাকলেও কোথাও লেখক পরিচিতি বা লেখকদের নাম নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা লেখক সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে পারছে না।

তৃতীয় শ্রেণির ‘ভূগোল ও সমাজ পরিচিতি’ বইয়ের ৩৬-৩৭ পৃষ্ঠায় ‘বাংলাদেশের প্রথম, দীর্ঘতম, বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠ’ শিরোনামে লেখায় শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে রয়েছে আব্দুল আলীম, শ্রেষ্ঠ কারী মাওলানা ইবরাহীম উজানী, শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, শ্রেষ্ঠ খতিব মুফতি আমীমুল ইহসান, শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস মাওলানা সাঈদ আহমদ সন্দ্বীপির নাম রয়েছে। তবে কিসের ভিত্তিতে এই শ্রেষ্ঠত্ব বাছাই করা হয়েছে, তার উল্লেখ নেই।

জানা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বেফাকের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাদের প্রভাব বেশি। বেফাকের মজলিসে আমেলার মধ্যে কমপক্ষে সাতজন রয়েছেন জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতা। বেফাকের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মজলিসে আমেলার (নির্বাহী কমিটি) সদস্যসংখ্যা ৫৫ জন। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দীর্ঘদিন ধরে কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস সংস্কার, ছাত্র বৃত্তি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন দাবি উঠলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এসব নেতা রাজনৈতিক দল ও বেফাক উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছেন নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। এর মধ্যে বেফাকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রভাব বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশফাক হোসেন বলেন, দেশের সঠিক ইতিহাস জানা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। এ ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকে সঠিক ইতিহাস থাকা জরুরি। রাষ্ট্রের স্বীকৃত ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তি সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব।

‘স্বাধীনতার ঘোষক’ প্রসঙ্গে পাঠ্য বইয়ের ভুল সম্পর্কে জানতে চাইলে বেফাক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জব্বার জাহানবাদী বলেন, ‘এমন কিছু থাকলে বাদ দিতে হবে। নজর এড়িয়ে গেছে হয়তো। সংশোধন করতে হবে।’

পাঠ্য বইয়রে ভুল প্রসঙ্গে আব্দুল জব্বার জাহানবাদী বলেন, ‘ভুল তো থাকতেই পারে। বইগুলো যাদের দিয়ে করানো হয়, তাদের তথ্য দেয়া হয়। এখন কী আর করা যাবে। পরের সংস্করণে সংশোধন করতে হবে।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!