• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা জানত গোয়েন্দারা!


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৭, ২০১৭, ০৫:৫৮ পিএম
মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা জানত গোয়েন্দারা!

ঢাকা: মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি ও নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ সাহেদুল আলম বিপুলকে ছিনিয়ে নেয়ার ছক সম্পর্কে আগেই জেনে গিয়েছিল গোয়েন্দারা। তারপরও দুর্ধর্ষ এ হামলাটি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। হামলার অংশ হিসেবে সম্প্রতি কাশিমপুর কারাগার ও এর আশপাশের এলাকা রেকিও করে জঙ্গিরা। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রশিক্ষিত একটি দলের সহযোগিতায় এ হামলার ছক কষে জঙ্গিরা। পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে তিন জঙ্গিকে সম্প্রতি গ্রেপ্তারও করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

গাজীপুরের টঙ্গিতে প্রিজনভ্যানে বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে জঙ্গিরা। সোমবার (৬ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৫টায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গি সরকারি কলেজ গেট এলাকায় দুর্ধর্ষ এ ঘটনা ঘটে। বোমা বিস্ফোরণের পর ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে হামলার ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। এর আগে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে একই কায়দায় প্রিজনভ্যানে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে জেএমবির এক সদস্যদের ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা।  

প্রিজনভ্যানে বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত মোস্তফা কামাল নামে জেএমবির এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে হামলায় জড়িত বাকি জঙ্গিরা পালিয়ে গেছে। আটক মোস্তফা ময়মনসিংহের তারাকান্দার পাগলী গ্রামের মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে। ঘটনাস্থল থেকে বিস্ফোরিত হাতবোমার স্প্লিন্টার, সাউন্ড গ্রেনেড, দুটি চাপাতি অবিস্ফোরিত ১২-১৫টি বোমা ও নগদ ১০ হাজার টাকাসহ একটি ব্যাগ জব্দ করেছে পুলিশ।

এ বিষয়ে টঙ্গি থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, দুটি প্রিজনভ্যানের একটিতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি ও জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানও ছিলেন। তাকে ছিনিয়ে নিতেই এ হামলা চালানো হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। এক হামলাকারী গ্রেপ্তার করা গেলেও বাকিরা পালিয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, সোমবার (৬ মার্চ) বিকেলে ঢাকা থেকে দুটি প্রিজনভ্যান কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে যাচ্ছিল। ভ্যান দুটি টঙ্গি কলেজ গেট এলাকায় পৌঁছালে পাশের একটি নার্সারীতে দাঁড়িয়ে তিন যুবক প্রিজনভ্যানটি লক্ষ্য করে পর পর কয়েকটি হাতবোমা ছুড়ে মারতে মারতে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।

লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বোমা দুটি রাস্তায় পড়ে বিস্ফোরিত হয়। হামলার একপর্যায়ে আশপাশের লোকজন জঙ্গিদের ধাওয়া দেয়। এতে দু’জন পালিয়ে যেতে পারলেও মোস্তফা কামাল নামে এক জঙ্গিকে ধরে ফেলে স্থানীয় জনতা। পরে পুলিশ এসে আটক মোস্তফা কামালকে টঙ্গি থানায় নিয়ে যায়। বোমা বিস্ফোরণের পর জনবহুল কলেজ গেট এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য আশপাশের এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি চালায়।

মুফতি হান্নানকে ছিনতাই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানত গোয়েন্দারা: মুফতি হান্নানকে ছিনতাই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও শাহজাহানপুর থেকে আবু বক্কর সিদ্দিক মাহমুদ ওরফে আল হাদি (২২), জাভেদ হোসাইন (১৯) ও সালেহ আহমদ (৪৯) নামে তিন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। গত ১ মার্চ শাহজাহানপুর থানা এলাকা থেকে সালেহকে এবং ২২ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুর থেকে মাহমুদ ও জাভেদকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাদের কাছ থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ছক সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর ও শাহজাহানপুর থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। ওই দুটি মামলায় জঙ্গি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়। মামলা উল্লেখ করা হয়, কারাগার থেকে আদালতে নেওয়ার পথে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনায় জড়িত রয়েছে সালেহসহ হুজিবির ৪-৫ জন সদস্য।

এই তিন জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক উপকমিশনার দাবি করেন, ‘হুজি নেতা মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। আমরা তাদের অপতৎপরতা রুখে দিতে সর্বোচ্চ সজাগ রয়েছি।’

গোয়েন্দারা আরাও জানায়, মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী বিপুলকে ছিনিয়ে নেওয়ার পুরো পরিকল্পনার সঙ্গে সালেহ ছাড়াও জড়িত জঙ্গি সালমান ও জুনায়েদ। কলাবাগানে জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয় হত্যার সঙ্গে জুনায়েদ সরাসরি জড়িত ছিল।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি জুনায়েদ। এক সময় জঙ্গিবাদে যার যাত্রা শুরু হয় মুফতি হান্নানের দল দিয়ে। পরে ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর মুফতি হান্নান গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর পর্যায়ক্রমে দলটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কয়েক বছর আগে জুনায়েদ আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সঙ্গে যুক্ত হয়। হুজিবির পুরনো সদস্য জুনায়েদ ও এবিটির সদস্য সালমান মুফতি হান্নান ও বিপুলকে ছিনিয়ে নিতে মাহমুদ ও জাভেদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে। পরে তাদের দায়িত্ব দেয়া হয় ছিনতাইয়ের ছক কষার।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মাহমুদ ও জাভেদ জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে কাশিমপুর কারাগার এলাকা রেকি করে তারা জুনায়েদ ও সালমানের নির্দেশে। জুনায়েদ তাদের জানায়, আত্মীয় পরিচয়ে আপেল নিয়ে কারাবন্দি বিপুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। এর পরই পুলিশের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আসতে থাকে দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ছক কষা হচ্ছে। এবিটির সালমানের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী একটি পরিবারের সদস্যদের গোপন যোগাযোগের কিছু তথ্য পেয়েছে পুলিশ। ওই পরিবারের কাছ থেকে সালমান নিয়মিত টাকা নিত।

মুফতি হান্নানের হরকাতুল জিহাদ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ওপর গ্রেনেড হামলা, কোটালিপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা, রমনা বটমূলে বোমা হামলাসহ সারা দেশে ১৩টি বড় ধরনের জঙ্গি হামলায় জড়িত। এসব হামলায় প্রাণহানি হয়েছে ১০১ জনের, আহত হয়েছেন ৬০৯ জন। প্রতিটি হামলায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন মুফতি হান্নান।

 একসময় জঙ্গিবাদে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল হাতে তৈরি বোমা দিয়ে। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ স্বাধীনতার পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর হামলা চালাতে জোট সরকারের আমলে মুফতি হান্নানের হাতে তুলে দেওয়া হয় ৩২টি আর্জেস গ্রেনেড। যে গ্রেনেড পাকিস্তানে তৈরি। জঙ্গি হামলা চালাতে পাকিস্তানশাসিত জম্মু-কাশ্মীর থেকে মজিদ ভাট নামে এক জঙ্গিকে ভাড়াও করা হয়।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় এখন সে কারাবন্দি। কাপড়ের ব্যবসায়ী পরিচয়ে এই জঙ্গি বাংলাদেশে বিয়েও করেন। সূত্র জানায়, ১৩টি বড় ধরনের জঙ্গি হামলার ঘটনায় মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা হয়। যার দুটির বিচার শেষ হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার দায়ে মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি ও দুজনের যাবজ্জীবন হয়েছে।

এদিকে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে জেএমবির মজলিশে শুরা সদস্য সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন, হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান এবং জাহিদুল ইসলাম ওরফে মিজান ওরফে বোমা মিজানকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। এ সময় হামলাকারী জঙ্গিদের গুলিতে এক পুলিশ সদস্য নিহত হন।  

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!