• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মেডিকেল শিক্ষার্থীদের হাতে অবৈধ কঙ্কাল!


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ৩০, ২০১৭, ০৪:১২ পিএম
মেডিকেল শিক্ষার্থীদের হাতে অবৈধ কঙ্কাল!

ঢাকা: দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাতনামা লাশগুলো গলিয়ে কঙ্কাল বানিয়ে তা বিক্রি করার কাজে জড়িত আছে একাধিক চক্র। এসব কঙ্কাল চলে যাচ্ছে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। একেকটি কঙ্কালের দাম ৬০ হাজার থেকে লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পুরনো কঙ্কাল বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩৫ হাজার টাকায়। কঙ্কাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থী, সরকারি হাসপাতালের কতিপয় চিকিৎসক, অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডোম এবং মর্গ সংশ্লিষ্ট লোকজন।

কঙ্কাল মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ। চিকিৎসাবিদ্যার উপকরণটি এখন অবৈধ ব্যবসার বড় হাতিয়ার হিসেবে হয়ে উঠেছে। কারণ চাহিদার তুলনায় বৈধ কঙ্কালের সরবরাহ খুবই নগণ্য। দেশে বছরে মানব কঙ্কালের চাহিদা সাড়ে আট হাজারেরও বেশি। 
সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরাই এর প্রধান ক্রেতা। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলো বেওয়ারিশ লাশ তাদের শিক্ষার উপকরণ হিসেবে যাচ্ছে নিয়মিত।

দেশে ২২টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, একটি ডেন্টাল কলেজ ও নয়টি ডেন্টাল ইউনিট মিলিয়ে মোট আসনসংখ্যা তিন হাজার ৩৮৯টি। এর মধ্যে মেডিকেল কলেজে দুই হাজার ৮১১টি ও ডেন্টালে ৫৭৮টি আসন রয়েছে। অপরদিকে ৫২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে চার হাজার ২৭৫টি ও ১২ ডেন্টাল কলেজে প্রায় সাড়ে আট শ আসন রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতি বছর আট হাজার ৫১৪ জন নতুন শিক্ষার্থী চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা শুরু করেন। আর এই সাড়ে আট হাজার শিক্ষার্থীকে প্রথমবর্ষ থেকেই নিজ দায়িত্বে কঙ্কাল সংগ্রহ করতে হয়। যদিও কেউ কেউ তৃতীয়বর্ষের কোনো শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পুরনো কঙ্কাল সংগ্রহ করে থাকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কঙ্কাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এক শিক্ষার্থী জানান, বিকল্প পথে অবৈধভাবে কঙ্কাল সংগ্রহ করেন তারা। পুরনো এক সেট কঙ্কাল ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় আর নতুন সেট ৬০ হাজার থেকে লাখ টাকায়ও ক্রয় করেন শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থীদের জন্য বেওয়ারিশ লাশ ব্যবহার করা হয়। বেসরকারি মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা কোথা থেকে লাশ বা কঙ্কাল সংগ্রহ করে তা আমার জানা নেই। ঢাকা মেডিক্যালের মর্গ সহকারী ডোম সেকান্দার জানান, বেওয়ারিশ লাশগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দেওয়া হয়। এরপর সেই লাশগুলোর কী হয় তা তাদের জানা নেই।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সংগ্রহ করা সেই লাশগুলো ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় ফুটন্ত পানিতে ডুবিয়ে রাখা হলে লাশের শরীরের মাংস ও চর্বি আস্তে আস্তে আলাদা হয়ে যায়। এরপর ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করে পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটিতে জড়িত একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র। আবার শাহবাগ ও মিটফোর্ড ওষুধের ফার্মেসি, ঢাকাসহ বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসে মোবাইল নম্বরসহ কঙ্কাল বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। 

অনলাইনেও বসেছে কঙ্কাল কেনাবেচার হাট। এসব বিজ্ঞাপন দেখে মেডিক্যাল কলেজের প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা নম্বর সংগ্রহ করে কঙ্কাল কেনার জন্য যোগাযোগ করেন। পরে চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত টাকায় ওই সব মোবাইল নম্বরে বিকাশের মাধ্যমে পাঠানোর পর নির্ধারিত জায়গায় কঙ্কালটি পৌঁছে দেওয়া হয়।

ফেসবুক থেকে নেয়া

জানা গেছে, মেডিকেলের ছাত্রনেতারাই বাইরে বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে কঙ্কাল তৈরি করে বিক্রি করছেন। বিনিময়ে তারা মোটা অঙ্কের কমিশন পেয়ে থাকেন। পুরান ঢাকার বেসরকারি ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের কিছু শিক্ষার্থী অবৈধ কঙ্কাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অনুসন্ধানে এই মেডিকেলের সাবেক ছাত্র মাসিয়াত ফারুক তুষারের নাম উঠে আসে। গত বছরের ৫ নভেম্বর রাজধানীর কাফরুলে ২৫ সেট কঙ্কাল এবং তা প্রক্রিয়াজাতকরণের উপকরণসহ গ্রেফতার হন একই মেডিকেল কলেজের এন-১৮ ব্যাচের ছাত্র নুরুজ্জামান। দীর্ঘদিন ধরে ভাড়াবাসায় কঙ্কালের এ অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন তিনি। নুরুজ্জামান গ্রেফতারের পর ন্যাশনাল মেডিকেলে কঙ্কাল কেনাবেচা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন এন-১৯ ব্যাচের তারিক মাহমুদ আবির এবং তানভীর আলম। তাদের অবৈধ কঙ্কাল ব্যবসা এখন রমরমা। এ ছাড়া কঙ্কাল ব্যবসার সঙ্গে একই মেডিকেল কলেজের এন-২০ ব্যাচের ফয়সাল নামে এক ছাত্রের জড়িত থাকার বিষয়টিও উঠে এসে অনুসন্ধানে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এন-২০ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী জানান, ন্যাশনাল মেডিকেলে কঙ্কাল বিক্রির জন্য আবির, তানভীর ও ফয়সালের খ্যাতি আছে। তিনি নিজেও আবিরের কাছ থেকে কঙ্কাল কিনেছেন বলে জানান।

ঢাকার দুটি সরকারি মেডিকেল কলেজের ডোমরা কঙ্কাল বিক্রির হোতা হিসেবে ন্যাশনাল মেডিকেলের আবির ও তানভীরের নাম বলেন। নাম্বার নিয়ে এ প্রতিবেদক কঙ্কালের ক্রেতা সেজে আবিরকে ফোন করেন। ফোনে আবির জানান, আমাদের কাছে লাল ও সাদা রঙের কঙ্কাল আছে। সাদা কঙ্কালের দাম একটু বেশি। কঙ্কাল কিনতে চাইলে সময় করে পুরান ঢাকার কলতাবাজারের বিসমিল্লাহ হোটেলেও যেতে বলেন এ প্রতিবেদককে। এরপর ফোন করা হয় আরেক কঙ্কাল ব্যবসায়ী ও ন্যাশনাল মেডিকেলের শিক্ষার্থী তানভীরের কাছে। একাধিকবার ফোন দিয়েও তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি। 
শিক্ষার্থীরা কঙ্কাল ব্যবসায় জড়িত-এ বিষয়ে জানতে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আবুল বাশারকে ফোন করা হলে তিনি কথা বলতে চাননি।

গত বছরের ৫ নভেম্বর রাজধানীর কাফরুল থেকে বিপুল পরিমাণ মানব কঙ্কাল ও মাথার খুলিসহ ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী নুরুজ্জামানকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এআই

Wordbridge School
Link copied!