• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মেয়েদের পিটানো সেই অনিক নাকি মিরপুরের বাঘ (ভিডিও)


নিজস্ব প্রতিবেদক মে ১০, ২০১৮, ০৫:১৮ পিএম
মেয়েদের পিটানো সেই অনিক নাকি মিরপুরের বাঘ (ভিডিও)

ঢাকা: মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান অনিকের ছাত্রী পেটানোর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। এরপর থেকেই সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। সবারই প্রশ্ন- কেন এই মেয়েদের এভাবে পেটালেন অনিক? কেন বার বার আলোচনায় আসে বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ?

এসব প্রশ্নের উত্তর চাইলে দীর্ঘ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কথা জানালেন ছাত্রলীগ নেতা অনিকের নির্যাতনের শিকার শুভ্র মাহমুদ ওরফে আসমতআরা সুলতানা।

তার কথায় অনিকের অপকর্মের বেড়াল থলে থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রকাশ পেয়েছে মুজিবুর রহমান অনিকের উত্থানের পেছনের তথ্য, হত্যা, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের ঘটনায় তিনটি মামলা নিয়েও কীভাবে সভাপতি হলেন?

শুভ্রর ভাষ্যে, মামলা প্রত্যাহারে তাকে ১০ লাখ টাকার সমঝোতার প্রস্তাব করা হয়েছিল।

অনিকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়ে শুভ্র গণমাধ্যমকে বলেন, অনিকের সঙ্গে আমার একটা লম্বা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। ২০১১-১২ সেশনে আমি বাঙলা কলেজে ভর্তি হলাম। ছোটবেলা থেকেই ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ওই সূত্র ধরেই এখানেও সম্পৃক্ত হলাম। অবশ্য তখন বাঙলা কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি ছিল না, গণজাগরণ মঞ্চসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামে আমরা সম্পৃক্ত হতাম। ২০১৪ সালে কমিটি হলো; জাহিদ-অনিক পরিষদ। জাহিদ মাহমুদ সভাপতি, মুজিবুর রহমান অনিক সাধারণ সম্পাদক ছিল। আমি কোনো গ্রুপ করতাম না। এদের কারও সঙ্গে ছিলামও না। আমি মূলত শেখ হাসিনার গ্রুপ চিনি, ভাই-ব্রাদার গ্রুপ করি না। কিন্তু, অভিভাবক হিসেবে সব ছাত্রলীগ নেতাকে সম্মান করতাম। কেউ নির্যাতন করলে প্রতিবাদও করতাম।

তিনি বলেন, ‘তৎকালীন নারী নেত্রী ছিলেন জহুরা বৃষ্টি। সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান অনিক ছিলেন প্রচণ্ড লোভী ও হিংস্র। তিনি জহুরা বৃষ্টিকে নানাভাবে কলঙ্কিত করে এক পর্যায়ে শেষই করে দেন। কিন্তু, কাজটি এমনভাবে করেন, খুনের দোষ গিয়ে পড়ে জাহিদ মাহমুদের ওপর। তিনি গ্রেফতার হয়ে জেলও খেটেছেন। পরে ছাত্রলীগ থেকে তাকে অব্যাহতিও দেয়া হয়।’

এই ছাত্রলীগ নেত্রীর ভাষ্যে, পরে জাহিদ মাহমুদকে ফাঁসিয়ে সেই একই মামলার আসামি অনিক কোনো এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় বাঙলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হয়ে যান, এটা ২০১৫ সালের ঘটনা। এর মাঝে ছাত্রলীগের মেয়ে কর্মী বলে আর কেই নেই। আমিই তখন সিনিয়র। অনিকসভাপতি হয়ে কলেজে আসার পর নতুন রূপ ধারণ করলেন।

তিনি বলেন, ‘অনিক ছাত্রছাত্রীদের অত্যাচার করতেন, জিম্মি করে অর্থ আদায় করতেন। ওয়াসা, এশিয়া হল, কলেজের সামনের দোকানগুলো, বিপরীতে ড্যাব, ডেল্টা, ঢাকা হাসপাতাল থেকেও মাসিক চাঁদা তুলতেন। ভর্তি বাণিজ্য তো ছিলই। আমি এসবের প্রতিবাদ করতাম। ২০১৫ সালের শেষের দিকে আমার পরিচিত এক ছোট ভাইকে ভর্তি করতে গেলে, অনিক আমার কাছেও টাকা দাবি করে বসেন। আমি প্রতিবাদ করলে তখন তিনি হাসতে হাসতে বলেন- তুই বেশি সাহসী, প্রতিবাদী? বাঙলা কলেজে এত সাহসী ও প্রতিবাদী হওয়া ভালো না।’

শুভ্র জানান, অনিক আমাকে বলল, তুই ঘরে ঘুমিয়ে থাকলেও দলের পদ পাবি। এখানে কোনো মেয়েকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেব না। তখন তাকে আমি চ্যালেঞ্জ করি। এরপর থেকেই তার সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ দানা বাঁধল। আমার পিছনে কর্মীদের লেলিয়ে দিল। মামলা করলাম, ওরা জেলও খাটল। জেল থেকে বেরিয়ে অনিক আমাকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিলেন। এক পর্যায়ে নিজে আমার ডান হাতে কোপ দিলেন। সাতটা সেলাই লাগল। হুমকি দিল- ছেলেদের দিয়ে করালে তুই তাদের জীবন শেষ করে দিবি। তাই নিজে কোপালাম, যাতে কাউকে বিশ্বাস করাতে না পারিস। সত্যিই অর্থ দিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট করাল, আমার বিপক্ষে। মামলা করলাম। এরপরও ভয়ে ঘুমাতে পারতাম না। বিচার আর জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ছাত্রলীগের নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলাম। কিন্তু, কাউকে বিশ্বাসই করাতে পারলাম না অনিক আমাকে আঘাত করেছেন। এরপর দেড় বছর ধরে পুলিশ কমিশনার, ডিসি, ওসির কাছে ঘুরেছি। কিছুই করতে পারিনি তার। উল্টো আমার ভর্তি বাতিল হয়ে গেল। পরে ২০১৭ সালে লুকিয়ে বন্ধুবান্ধব দিয়ে ডিগ্রিতে ভর্তি হলাম। অনিকের হাত থেকে বাঁচতে এফিডেভিট করে নামও পরিবর্তন করেছি। কিন্তু, কোনো লাভ হল না। স্থানীয় এমপি আমাকে বাধ্য করল মামলা তুলতে। এরপর কলেজ শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলো, সেখানে সহ-সভাপতি হলাম।

তিনি জানান, পদ পাওয়ার পর অনিক ক্যাম্পাসে ডেকে নিয়ে সবার সামনে বললেন, এতদিন যা হইছে ভুলে যাই। তুই আমার ছোট বোন। আমরা এক সঙ্গে থাকতে চাই। কিন্তু পরে বুঝেছি সবই ওর নাটক ছিল।

২০১৭ সালের অক্টোবরের ২০ তারিখে একটি মেয়ে আমার সাহায্য চাইল। অনিক বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে তার সঙ্গে নাকি মেলামেশা করেছেন। পরে মেয়েটির বিষয়ে আমি অনিক ও জীবনের (সাধারণ সম্পাদক) সঙ্গে কথা বললাম। তখন অনিক বলল, কতজনই কত কিছু বলবে, এখন বিপদের সময় তোরা আমার পাশে থাকবি। কিন্তু, এটাও তার নাটক ছিল। সেদিনই একটি মেয়ে দারুস সালামে আমার বাসায় উঠল। টু-লেট দেখে সে এসেছে বলে জানাল। দু’দিন বাদে জানলাম অনিকের ধর্ষণের শিকার মেয়েটিই আমার বাসায় উঠেছে। মেয়েটি অনিকের সঙ্গে তার কথোপকথনের দেড় হাজার অডিও ক্লিপস দিল। ২২শ’র মত মেসেজ দেখাল। অনিকের সঙ্গে তার অনেকগুলো অন্তরঙ্গ ছবি দিল। পরে বুঝলাম এসবই ছিল অনিকের সাজানো চাল।

শুভ্র দাবি করেন, গতবছরে হঠাৎ একদিন আমার বাসায় অতর্কিত হামলা হলো। অনিক পুলিশ সঙ্গে নিয়ে মারধর করল। তাকে বললাম, আপনি আমার বাসায় এসে গায়ে হাত তোলার সাহস কই পাইলেন? তখন অনিক আমাকে বললেন, ‘তুই মুজিবুর রহমান অনিকরে চিনস না! আমি মিরপুরের বাঘ।’ আমার পেছনে লাগার মত কলিজা তুই কেন করছিলি? তুই চিনস না আমারে? অতীতে আমার প্রমাণ পাস নাই? আজকে তোরে মেরেই ফেলব।

তবে তার সহযোগীরা পরামর্শ দিলো, ভাই মেয়ে মানুষ মেরে ফেললে ফেঁসে যাবেন। তখন আমার একটি পা ভেঙে দেয়া হলো। কানে আঘাত করা হলো। কানের অপারেশন করাইছি। কিন্তু, এখনো টেনে টেনে হাঁটি।

তিনি বলেন, সে সময়ে বহিষ্কার করা হলেও এখন দেখছি বহিষ্কারাদেশ তুলে স্বপদে বহাল করা হয়েছে। এরপর যেখানে গেছি, সবাই বলছে, অনিক তোদের মারছে প্রমাণ কই?

শুভ্র বলেন, ‘এই মামলা তুলে নিতে অনিক আমাকে ১০ লাখ টাকা প্রস্তাব করেছে। ও নিজেও বলেছে। আবার মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মুন্নার মাধ্যমেও বলিয়েছে। আমি বলেছি, আমার টাকার দরকার নাই। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও জাকির হোসাইনের সামনে গিয়ে মাফ চাইলে মাফ করে দেব।’

উল্লেখ্য, সম্প্রতি ছাত্রলীগ নেতা মুজিবুর রহমান অনিকের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে দেখা গেছে, ছাত্রলীগ নেতা অনিক ও সাদেক প্রধানিয়া মিলে দুই তরুণীকে বেদম পেটাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিকটিম তরুণীদের একজন শুভ্র মাহমুদ ওরফে আসমতআরা সুলতানা ওরফে জ্যোতি। তিনি মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। আরেকজন তারই পরিচিত এবং রুমমেট।

পেটানোর ভূমিকায় অনিক মিরপুর বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাদেক প্রধানিয়া একই শাখার পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক।

ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ গত ৪ মে সরকারি বাঙলা কলেজ শাখার সব সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করেছে।

সোনালীনিউজ/জেএ

Wordbridge School
Link copied!