• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
ফিরে ফিরে আসে ১৫ আগস্ট

যা শেখার ছিল তা শেখা হলো না


শামছুজ্জামান সেলিম আগস্ট ১৫, ২০১৬, ০১:১৮ পিএম
যা শেখার ছিল তা শেখা হলো না

আজ ১৯৭৫ সালের সেই নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের দিন ১৫ আগস্ট। এ দিনটি বাঙালি জাতির জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’। সাগরসম অশ্রু, সীমাহীন ত্যাগ, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত সফল মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বাস ঘাতকদের পেছন থেকে আক্রমণে পরাজিত হয় এই দিনে।

৪০ বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া এ ‘ট্র্যাজেডি’ নিয়ে কোন বোঁধগম্য আলোচনার সূত্রপাত আজও হলো না, দুঃখটা এখানেই বড় করে বাজে। অথচ ‘১৫ আগস্টে’র দগদগে ঘায়ের অভিঘাত আজও আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে প্রতিদিন পীড়া দেয়-বিড়ম্বনার মুখোমুখি করে। মুক্তিযুদ্ধের টর্নেডোসম আঘাতে লণ্ডভণ্ড পাকিস্তানপন্থিরা স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে কেমন করে মুক্তিযুদ্ধকে পেছন থেকে মরণ আঘাত হানল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা নিচের আলোচনায় যেতে পারি।

আমরা তিন পর্বে বাংলাদেশকে দেখতে পারি। ১. মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকার- যারা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, ২. ১৬ ডিসেম্বর ‘৭১ সাল থেকে ১০ জানুয়ারি ‘৭২ পর্যন্তথ যখন স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু এবং ৩. ১০ জানুয়ারি ‘৭২ সাল থেকে ‘৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্তথ যখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র সাংবিধানিক উপায়ে পরিচালিত হচ্ছিল। পণ্ডিতজনেরা হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, বর্তমান বাংলাদেশ কী তাহলে অবয়ব শূন্য কোন বস্তু? বর্তমান বাংলাদেশ অবশ্যই অবয়বশূন্য নয়। কিন্তুু সেই ‘অবয়বের’ হালদশা যে কী সে আলোচনার প্রবেশদ্বারটা উন্মুক্ত করার প্রয়াস থেকেই এ অবতারণা।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের সময়ের ঘটনাবলি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে অনেক মূল্যবান দলিল প্রকাশিত হয়েছে- এখন যা সহজলভ্য। এসবই ওপরতলার ঘটনাবলি। এসব দলিলে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাবলির বিশ্লেষণ থাকলেও একটি প্রশ্নে সবাই একমত, যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারীদের ভেতর থেকেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের চেষ্টা করা হয়েছিল। আর এ অপচেস্টার প্রধান হোতা ছিল সেই বহুল আলোচিত ‘মুজিব বাহিনী’ বা ‘বিএলএফ’ এবং মোশতাক গং।

এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষীর মতো তো কোন কিছুই বলতে পারব না। কারণ আমরা ছিলাম প্রশিক্ষণে। ওপর তলার নয়, তবে তৃণমূলের কিছু ঘটনাবলির কথা নির্ধিদ্বায় বলতে পারি। ট্রেনিংয়ের দীর্ঘ ঝক্কিঝামেলা শেষ করে যেদিন আমাদের বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি সেদিন সকালে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডে এক ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে ঘটনাক্রমে দেখা হয়ে গেল। তিনি নিজেও মুক্তিযোদ্ধা। 

খুব উৎফুল হয়ে বললেন, ‘দোস্ত তোমরা এসে গেছ! এদিকে... ভাই আগরতলা থেকে টেলিগ্রাম পাঠাঁইছে তোমরা বাংলাদেশে ঢুকতে যাচ্ছ। আমরা যেন তোমাদের মেরে দিয়ে প্রচার করি রাজাকারদের এ্যামবুশে তোমরা মারা পড়েছ! আমরা, এফএফরা মুজিববাহিনীকে বলে দিয়েছি, আমরা একাজ কখনই করব না। আর তোমরাও করতে চেষ্টা কর না। করলে তোমাদের পরিণতিও ভালো হবে না।’ এ সংবাদটি শুনলাম মহাবিস্ময় নিয়ে এবং প্রথম শুনলাম, যে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করবে? বাস্তব কারণেই ‘টেলিগ্রাম পাঠানো ভাইয়ের’ নাম উল্লেখ করলাম না। তিনি এখনো জীবিত এবং একটি রাজনৈতিক দলের নেতা।

সাম্প্রতিক সময়ের আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। অসুস্থতার খবর শুনে এফএফের একজন প্লাটুন কমান্ডার আমাকে দেখতে এসেছিলেন হাসপাতালে। প্রাথমিক খোঁজখবর নেয়ার পর চলে এল মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনাবলির নানা স্মৃতিকথা। এই কমান্ডার একজন দুর্ধষ মুক্তিযোদ্ধা। নিজের জীবনকে হাতের মুঠোয় রেখে যে কোন ঝুঁকি নিতে পিছপা হতেন না তিনি। তিনি যখন একটি ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন তখন আরেকবার বিস্ময় নিয়ে শুনলাম। তিনি বলে গেলেন কোন বিরতি না দিয়েই।

কমান্ডার বলছিলেন, একদিন এফএফদের কোম্পানি কমান্ডার, প্লাটুন কমান্ডার এবং তাদের টুআইসিদের নিয়ে মিটিং ডাকলেন দুই মুজিববাহিনী কমান্ডার। এদের একজন জেলা সদর থেকে এসেছিলেন, আরেকজন স্থানীয়। উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা এবং করণীয় নির্ধারণ করা। পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় তারা বলেছিলেন, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং বঙ্গবন্ধু জীবিত ফিরতে নাও পারেন। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থিরা নেতৃত্বে চলে আসতে পারে এবং তাজউদ্দীন সরকার স্থায়ী হয়ে যাবে। তাজউদ্দীন ভারত-রাশিয়ার দালাল। 

এ অবস্থা হলে আমাদের তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। এরপরই তারা বলেছিলেন, কমিউনিস্ট গেরিলারা অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের এলাকায় ঢুকবে। আগরতলা থেকে খবর পাঠিয়েছে... ভাই। ওরা ঢুকলে এ্যামবুশ দিয়ে মেরে ফেলতে হবে এবং প্রচার করতে হবে রাজাকাররা মেরেছে। এবার সভায় হট্টোগোল শুরু হয়ে যায়।

উপস্থিত এফএফ কমান্ডাররা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এ নির্দেশ মানা হবে না। ‘মুক্তিরা’ ‘মুক্তিদের’ খুন করতে পারে না। আর তাজউদ্দীন সরকারের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করতে যাব কেন? উনি তো আমাদের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এ হট্টোগোলের মধ্যে জেলা সদরের মুজিববাহিনী কমান্ডার সভাস্থল ত্যাগ করেন এবং স্থানীয় কমান্ডার নিশ্চুপ হয়ে যান।

হাসপাতাল ত্যাগ করার আগে তিনি আমাকে আর একটি তথ্য জানিয়ে গেলেন। তারা যখন সদ্য ট্রেনিং শেষ করে ফিরেছেন তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জাঁদরেল ছাত্রলীগ নেতা (এখন বিএনপি করেন) তাদের নিয়ে সভা করেন। ওই সভায় সেদিন বর্তমান আওয়ামী লীগের একজন বিখ্যাত নেতাও উপস্থিত ছিলেন। ওই ছাত্রলীগ নেতা প্রথমেই জানতে চাইলেন, ‘আপনারা কি মুজিব ভাই জীবিত ফিরে আসুক তাই চান? সবাই একবাক্যে বললেন, হ্যাঁ, চাই। 

তখন তিনি আসল কথাটি পাড়লেন। মুজিবভাইকে জীবিত ফেরত চাইলে মুশতাক ভাইয়ের প্রস্তাব সমর্থন করতে হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন না করলে মুজিব ভাইকে জীবিত পাওয়া যাবে না। উপস্থিত ‘মুক্তিরা’ না না ধ্বনি তুলে বলেন, আমরা স্বাধীনতা ছাড়া অন্যকিছু বুঝি না। ‘স্বাধীনতা চাই’। অবস্থাবেগতিক দেখে ওই নেতারা তাড়াতাড়ি কেটে পড়েন (ওরা মুজিববাহিনীর নেতা ছিলেন)।

মক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারের সময়ের বা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের ইতিহাসের অন্ধকার দিকগুলোর সবটুকু আজও উন্মোচিত হয়নি। বাঙালি জাতির ট্র্যাজেডি এখানেই।
আমি তৃণমূলের প্রত্যক্ষ ঘটনার বিবরণ দিয়ে নিবন্ধটা শুরু করেছি। আরেকটি ঘটনার উল্লেখ না করলে বিবেকের কাছে সৎ থাকতে পারব না। ঘটনার উৎস শহীদ কর্নেল রশিদথ যিনি জিয়া হত্যার তথাকথিত অভিযোগে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মেজর ছিলেন। তার সঙ্গে একসঙ্গে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি।

অস্ত্র জমা দেয়া শেষ করে আমাদের বাহিনীর সর্বশেষ ভাতা নেয়ার জন্য পাবনা সার্কিট হাউজে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। সার্কিট হাউজের বারান্দায় এমপি বগা ভাইয়ের সঙ্গে বসেছিলেন তিনি। ভাতা বুঝে নেয়ার পর আমি একটি দরখাস্ত তার সম্মুখে রাখলাম। দরখাস্তে ছিল অস্ত্র জমা দিয়েছি, এখন চাকরিতে যোগ দেয়ার অনুমোদন দরকার। আমার দরখাস্তটি পড়ার পর জানতে চাইলেন, কোথায় এবং কি চাকরি করি। বললাম, পাকশি পেপার মিলে শ্রমিকের চাকরি করি। এবার কত বেতন পাই তাও জানতে চাইলেন! বলতে হলো একশ আশি টাকা পাই।

ড্রয়ার টেনে এক তা সাদা কাগজ বের করে আমাকে তার নিচে স্বাক্ষর করতে বললেন। কিছুটা বিব্রত হয়ে জানতে চাইলাম, কেন স্বাক্ষর করব! বলেছিলেন, আর্মিতে সে. লেফেটন্যান্টের চাকরি পাবেন। বেতন পাবেন আটশ টাকা। তারপরও রেশন আছে। এবার আমার পালা। উত্তরে বলেছিলাম, রশিদ ভাই, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী। কমিউনিস্ট পার্টি করি, ইউনিয়ের নেতা। আমাকে কারখানায় ফিরতেই হবে। এবার মেজর রশিদ তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসে খানিকটা উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘আপনারা, রাজনীতিবিদরা একাই দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবেন? 

মুক্তিযুদ্ধে পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা পাবে না, একথা মনে রাখবেন। আপনাদের মতো মুক্তিযোদ্ধারা সামরিক বাহিনীতে না আসলে স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনী প্রাণ পাবে কি করে? পশ্চিমের দিকে আঙ্গুল হেলিয়ে একটু ইঙ্গিত করে বললেন, অল্পদিনের মধ্যে ওরা ফিরবে হাজারে হাজার। হয়তো তখন বুঝতে পারবেন আমার কথা!’ শহীদ কর্নেল রশিদ কি সেদিন ভুল বলেছিলেন? নিজের জীবন দিয়ে তার কথার সত্যতা প্রমাণ করে গেছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু সরকার কি প্রবাসী সরকারের অভিজ্ঞতা এবং শহীদ কর্নেল রশিদের মতো দেশপ্রেমিক সামরিক কর্মকর্তাদের মতামতকে মূল্য দিয়েছিলেন? ঠিক তার উল্টো, তাজউদ্দীনকে বরখাস্ত করে বিশ্বাসঘাতক মোশতাককে রেখে দিলেন তার মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধু! এক দিনের জন্যও তাজউদ্দীনের কাছে শুনতে চাননি প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম। আর আওয়ামী লীগ? নতুন করে বাঙালি জাতিকে পুনর্গঠনের কর্তব্যকে অনুধাবন করতে সক্ষম ছিল? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সক্ষম ছিল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সরকার? তৃণমূল থেকে ওপর তলা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ব্যস্তছিল লুটপাটে।

আওয়ামী লীগের এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হয়েছে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি। বিরোধীদলের ভূমিকায় নেমে জাসদ পালন করেছে ধ্বংসাত্মক ভূমিকাথ যা কিনা সাহায্য করেছে ১৫ আগস্ট পন্থীদের। কর্নেল তাহের জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে সমগ্র বাঙালি জাতিকে বন্দী করে ফেললেন। আমরা বন্দী হয়ে গেলাম পাকিস্তানপন্থিদের দ্বিজাতিতত্ত্বের কাছে দ্বিতীয় বারের জন্য।

প্রবাসী সরকারের সময়ে ১৫ আগস্টের ট্র্যাজিডির বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ করা হয়েছিল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার, শাসকদল আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ নেয়া বিরোধীদল কেউই সেদিনের আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না। যার পরিণতি জাতি এখনো ভোগ করেই চলেছে। সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিডি, ১৫ আগস্ট থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারক শক্তি আজ পর্যন্তও কোন শিক্ষাগ্রহণ করল না। বিকলাঙ্গ বাংলাদেশকে ঘাড়ে বহন করে চলেছি, আমরা বাঙালিরা! (সংকলিত)

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এএম

Wordbridge School
Link copied!