• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যে রাতে খুলে গিয়েছিল নরকের দরজা


নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ১৫, ২০১৭, ০১:১৫ এএম
যে রাতে খুলে গিয়েছিল নরকের দরজা

ঢাকা : ‘সেই রাতে আকাশে একটিও নক্ষত্র ছিল না, সেই প্রাতে সূর্যালোক বন্দী ছিল কৃষ্ণ গ্রহের সেই রাতে ঈশ্বর তাই দেখতে পাননি, পৃথিবীতে কী ঘটেছিল!’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট চ্যান্সেলর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর।

১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে ৮টার দিকে গণভবন থেকে বাড়ি ফেরেন। ওই রাতে কারওয়ান বাজারে একটি ট্যাংক, পিজি হাসপাতালের সামনে একটি ট্যাংক, মতিঝিলের কাছে আরো একটি ট্যাংক দেখতে পান রাজধানীবাসী। এক কিলোমিটারের ব্যবধানে ৩টি ট্যাংক আবার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের সামনে আরেকটি ট্যাংক দেখেও কারো মনে কোনো প্রশ্ন আসেনি। কৃষ্ণপক্ষের ওই অন্ধকার রাতে খন্দকার মোশতাক আহমেদের ৫৪নং আগামসি লেনের বাসায় মেজর রশিদ এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের একান্ত বৈঠক হয়। পরদিন বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা জানানো হবে বলে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কাজ করে মুজিবপুত্র কামাল সেদিন মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন।

১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বেরিয়ে আসে বর্বরোচিত ঘটনার নৃশংস চিত্র। শিশুপুত্র রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ঘুমাচ্ছিলেন দোতলায়। শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামাল তিনতলায়, শেখ জামাল ও রোজি জামাল এবং বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের ঘুমিয়েছিলেন দোতলায়। ঘুমাচ্ছিল বাংলাদেশ। শুধু জেগেছিল চক্রান্তকারীরা। ঘাতক এজিদ, সীমার আর দুর্যোধনের অট্টহাসিতে বিদীর্ণ হয় রাত্রির নিঃস্তব্ধতা। পৈশাচিক উল­াসে আবারো খণ্ড বিখণ্ডিত হয় রক্তে কেনা বাংলাদেশ।

পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, অপারেশন ১৫ আগস্টের নেতৃত্বে ছিল কর্নেল ফারুক। তারই পরিকল্পনায় ৭৫ থেকে ১৫০ জন সৈন্যের বড় বড় তিনটি দল সাজানো হয়। তিনটি দলের প্রধান টার্গেট শেখ মুজিব, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাড়ি। শেখ মুজিবের বাড়ি আক্রমণের জন্য প্রথমে দায়িত্ব দেয়া হয় বহিষ্কৃত সেনা কর্মকর্তা মেজর ডালিমকে। রাষ্ট্রপতি পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের কারণে হয়তোবা ডালিম বঙ্গবন্ধুর ওপর সরাসরি আক্রমণ চালাতে ব্যক্তিগতভাবে নারাজ হয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করার পরিবর্তে সেরনিয়াবাতের বাড়ি আক্রমণ করার দায়িত্ব নেয় ডালিম। আর জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম ঘটনার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নূর ও মহিউদ্দিনকে। তাদের সঙ্গে ছিল এক কোম্পানি ল্যান্সার। খুনি ফারুকের অত্যন্ত আস্থাভাজন রিসালদার মুসলেহউদ্দিনকে দেয়া হয় শেখ মনির বাড়ি আক্রমণের। খুনিদের ওপর নির্দেশ ছিল সবাইকে হত্যা করার। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু পরিবার ও সেরনিয়াবাতের পরিবার এবং শেখ মনিকে যেন কোনোভাবেই বাঁচিয়ে রাখা না হয়।

এ ছাড়া খুনিদের পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে বা পরবর্তী সময়ে খুনিদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন যে কাউকেই প্রয়োজনবোধে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কর্নেল ফারুক। খুনি গ্রুপ ছাড়াও হত্যাকাণ্ডে বাধা আসতে পারে এমন স্থানেও কিছু সৈন্য মোতায়েন ও ট্যাংক প্রস্তুত করে রাখে হায়েনারা। যেন কেউ প্রতিহত করতে আসার আগেই পৃথিবী থেকে চিরতরে তাকে সরিয়ে দেয়া যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, একটা ট্যাংক বিমানবন্দরের রানওয়ে আটকাবে আর সৈন্যরা মিরপুর ব্রিজ নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্য দলগুলোকে পাঠানো হবে রেডিও স্টেশন, বঙ্গভবন আর নিউমার্কেটের পাশে পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস (বর্তমানে বিজিবি- বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) সদর দপ্তরে। এ ক্ষেত্রে খুনিরা ওই রাতের জন্য আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেনি। কারণ উৎসবের আনন্দে সজ্জিত প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষায় ছিল রাত পোহানোর, প্রিয় ক্যাম্পাসে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেয়ার জন্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রহর গুনছিলেন বাগ্মী বঙ্গবন্ধুর অনলবর্ষী আরেকটি ভাষণ শোনার জন্য। আর ঢাকা সেনানিবাসে ইতিহাসের ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে ব্যস্ত কর্নেল ফারুক বেঙ্গল ল্যান্সারের উদ্দেশে ভাষণে ধর্মের দোহাই দিয়ে মুজিবকে শেষ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়। খুনি ফারুক বলে, ‘যদি তোমরা ব্যর্থ হও, তাহলে মুজিব সেনাবাহিনীদের শেষ করে দেবে এবং ল্যান্সারদের বাতিল করবে। অতএব আর দেরি নয়। এবার আঘাত হানার সময় এসেছে।’

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভোর ৪টা ৮ মিনিটের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে যায় খুনী বাহিনী। রক্তপিপাসু ঘাতক চক্র তিন দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে। মাত্র দুই কিলোমিটার দূরেই তাদের লক্ষ্যবস্তু। গভীর রাতে রক্ষীবাহিনী তড়িঘড়ি করে শেরেবাংলা নগরে এমএনএর হোস্টেলের সামনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে অবস্থান নিলেও অজ্ঞাত (!) কারণবশত কিছুক্ষণ বাদেই ফেরত যায় (কার নির্দেশনায় ফিরে যায়, এ প্রশ্নের উত্তর আজো পাওয়া যায়নি)। একটি ট্যাংক পুরনো এয়ারপোর্টের রানওয়ে দিয়ে এসে একটি দেয়াল ভেঙে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে ট্যাংকের বন্দুকের নলটি তাক করে। সে রাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ৩০টি ট্যাংক অবস্থান নেয়। মুজিব ও তার ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবত এবং ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির বাড়ি ট্যাংক দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। মূল দলটি ৩টি উপদলে বিভক্ত হয়ে ভোর ৫টার মধ্যেই ঘেরাও করে ফেলে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি এবং তার আশপাশের এলাকা। ১২টি ট্রাক ও কয়েকটি জিপে করে আক্রমণকারী ল্যান্সার ও আর্টিলারির প্রায় ৫০০ জন রাইফেলস ট্র–পস আশপাশে ছেয়ে যায়। খুনি মেজর মহিউদ্দীন, মেজর হুদা, মেজর পাশা, মেজর নূরের নেতৃত্বে আউটার ও ইনার দুটি বৃত্তে ঘেরাও করে ফেলে ওই বাড়িটি।

আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। প্রথমে গেটে ঢুকতে গিয়েই গোলাগুলির সূত্রপাত হয়। তারপর তা প্রবল আকার ধারণ করে। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে পুলিশ গার্ডরা অবিরাম গুলি চালিয়ে সেনাদের আক্রমণে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। আর্টিলারির শামছুল আলমের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা যায়। আরো একজন আহত হয়। সঙ্গীদের ঢলে পড়তে দেখে আর বঙ্গবন্ধু ভবনের ভেতর থেকে প্রচণ্ড প্রতিরোধের কারণে সৈন্যরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সৈন্যরা চারদিক থেকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। একটি বুলেট বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই নাসেরের হাতে লাগে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের মতো এবারো বাড়ির সকলে শেখ মুজিবের শোবার ঘরে আশ্রয় নেন।

শেখ মুজিব কয়েকজন অফিসারকে ফোন করেন এবং বারান্দায় এসে পুলিশদের ফায়ার বন্ধ করতে বলেন। বেগম মুজিব শাড়ির এক অংশ ছিঁড়ে দেবর নাসেরের রক্তাক্ত হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন। কামাল ওপর থেকে নিচে নেমে এসে গার্ডদের অবস্থান নেয়ার জন্য বলেন কিন্তু ততক্ষণে গার্ডরা নিরস্ত্র, এই মুহূর্তে মেজর হুদা কয়েকজনকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলে গার্ডরা হুদাকে স্যালুট দেয়। এতে আক্রমণকারী সৈন্যরা বিনা বাধায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশের সহজ সুযোগ পেয়ে যায়। ঢুকেই তারা নিচতলার প্রতিটি কক্ষ তল­াশি করে এবং মেজর হুদার সঙ্গে থাকা একজন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে কামালকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। শেখ কামাল ও শেখ জামাল সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্টেনগান হাতে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি কামাল। ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে সিঁড়ির সামনে লুটিয়ে পড়েন তিনি।

বঙ্গবন্ধু যখন গোলাগুলির মধ্যে আক্রান্ত ছিলেন, তখন তিনি বাসা থেকে বিভিন্ন দিকে ফোন করে সাহায্য চাইলেন। তিনি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউ ফোন ধরছিল না। এরপর ফোনটি করেন তার মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল উদ্দিনকে। যাকে মাত্র ১৫ দিন আগে শেখ মুজিব বিশেষভাবে নির্বাচন করেছিলেন। তাকে বলেন, ‘জামিল তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোক আমার বাসায় আক্রমণ করেছে। শফিউল­াকে ফোর্স পাঠাতে বল।’ জামিল ফোন পেয়ে তাৎক্ষণিক ছুটে আসেন শেখ মুজিবকে বাঁচাতে। পোশাক পরিধানের সময় না পেয়ে পাজামার ওপর ড্রেসিং গাউনটি চড়িয়ে তার প্রাইভেট লাল কার হাঁকিয়ে ছুটে যান ঘটনাস্থল ৩২ নম্বরে, কিন্তু ততক্ষণে ৩২ নম্বর সড়কের ৬৬৭ নম্বর বাড়িটি কারবালার ময়দান। জামিল গাড়ি নিয়ে বাসায় ঢুকতে চাইলে, সৈন্যরা গুলি চালায় জামিলের বুকে আর মাথায়। টলতে টলতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনেই মৃত্যুর হিমশীতল পরশ আলিঙ্গন করে নেয়। নিজের জীবনের বিনিময়েও শেখ মুজিবের কোনো কাজে আসতে পারলেন না মুজিব সেনা জামিল।

অনেক চেষ্টার পর সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল­াকে পেয়ে যান বঙ্গবন্ধু। তাকে বলেন, ‘শফিউল­াহ, আমার বাসায় তোমার ফোর্স অ্যাটাক করেছে। কামালকে ওরা মেরে ফেলেছে। তুমি তাড়াতাড়ি ফোর্স পাঠাও।’ জবাবে শফিউল­াহ বলেন, ‘স্যার, ক্যান ইউ গেট আউট, আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং।’

এরপর ফোনে আর তার সাড়া পাওয়া যায়নি। শফিউল­াহ ফোনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। তখন ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিট। কিন্তু শফিউল­াহ রাষ্ট্রপতির সাহায্যার্থে একটি সৈন্যও মুভ করাতে পারলেন না। এর মধ্যেই বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে মেজর মহিউদ্দীন, হুদা, নূর চৌধুরীসহ ঘাতকের দল। দুতলায় ওঠার সিঁড়ির গোড়াতেই দেখা হয়ে যায় ঘাতকের কিলিং মিশনের প্রধান টার্গেট জাতির পিতার সঙ্গে। ধূসর রঙের চেক লুঙ্গি-সাদা পাঞ্জাবি আর ডান হাতে প্রিয় পাইপের চিরায়ত বাঙালির শাশ্বত রূপের প্রতিকৃতি বিশাল হৃদয়ের শেখ মুজিবের সামনে দাঁড়িয়ে মুহ‚র্তে বিচলিত হয়ে যায় খুনি মহিউদ্দীন। শেখ মুজিবকে হত্যার দৃঢ় মনোবল নিয়ে আসা মেজর মহিউদ্দীন আমতা আমতা করে বলে, স্যার আপনি আসুন। অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় গর্জে ওঠে সিংহ হৃদয়, ‘তোরা কী চাস? কেন বেয়াদবি করছিস? তোরা কি আমাকে খুন করতে চাস? ভুলে যা।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও তা পারেনি। তোমরা কি মনে কর, তা পারবে?’ শেখ মুজিব তাকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় ধমকেই যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘যে দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশের ও সেনাবাহিনীর আইনশৃঙ্খলা ও সংবিধান লঙ্ঘন করে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির বাসা আক্রমণ করতে পারে, আমি তার রাষ্ট্রপতি থাকতে চাই না। তবে তোমাদের মতো অধঃস্তন কর্মকর্তাদের কাছে পদত্যাগও করতে পারি না। তোমাদের সেনাবাহিনীর চিফ ও ডেপুটি চিফদের এখানে নিয়ে এসো, তাদের কাছে ইস্তফা পত্র দেবো।’

এ সময় দুজন মেজর বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার জন্য বললে বঙ্গবন্ধু আবারো বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আমার সঙ্গে শেখ কামালকে যেতে দিলে আমি বেতার কেন্দ্রে যেতে পারি।’ পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বের কাছে নিতান্তই বেমানান খুনি তখনো একই গান গেয়ে যাচ্ছিল, স্যার, আপনি আসুন। আর অন্যদিকে থামছিল না মুজিবের ধমকানো।

কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে পড়ে যায় ল্যান্সার মহিউদ্দীনের পিস্তল। এমন সময় স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান নিয়ে দৌড়ে আসে ঘাতক নূর চৌধুরী। (যে এখনো কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছে)। বুদ্ধিমান শেখ মুজিব ধমকিয়ে তাদের সময় ও মনোবল নষ্ট করতে চাইছেন বুঝে ফেলে নূর চৌধুরী। মহিউদ্দীনকে ধাক্কা মেরে এক পাশে সরিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘স্টপ! দিস বাস্ট্রার্ড হ্যাজ নো রাইট টু লিভ।’ গর্জে ওঠে স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান। বৃষ্টির মতো গুলিতে ঝাঁঝরা ছয় ফুট বাই দুই ইঞ্চির বিশাল দেহ মুখ-থুবড়ে পড়ল সিঁড়িতে। বুকের ডান দিকে গুলির বিরাট ছিদ্র। যে উঁচু করা তর্জনী ছিল পাকিস্তানের ভয়ের কারণ আর সন্তানসম বাঙালির আস্থার প্রতীক, ঘাতকের ব্রাশফায়ারে উড়ে যায় সেই তর্জনীটি। তবুও ডান হাতে আঁকড়ে ধরা ছিল ধূমপানের প্রিয় পাইপ।

মসজিদের শহর খ্যাত ঢাকার মসজিদ থেকে ভেসে আসা পবিত্র আজানের ধ্বনিকে বিদীর্ণ করে ঘাতকদের মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলি। বিদীর্ণ করে বাংলাদেশের বুক। শহীদ হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার এক অপূর্ণ মহৎ স্বপ্ন। ভোরের সময়ই অস্তমিত হয়ে যায় জাতীয় গৌরবের প্রতীক সূর্যের মতো একটি অনন্য অধ্যায়। অন্ধকারের কালো মেঘে ঢেকে যায় বাংলার আকাশ। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে অন্ধকার এক সাম্প্রদায়িকতার চোরাগলিতে। ‘তবু তোমার বুকেই গুলির পর গুলি চালালো ওরা/ তুমি কি তাই টলতে টলতে বাংলার ভবিষ্যৎকে/ বুকে জড়িয়ে সিঁড়ির ওপর পড়ে গিয়েছিলে?’

মহাকালের মহানায়ক : ৫৫ বছরের সংগ্রামী জীবনের বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয়ে জাগ্রত মহাকাব্যের মৃত্যুঞ্জয়ী মহানায়ক হিসেবে। এ মহাকাব্যের আবেদন কোনোদিন শেষ হবে না। উজ্জ্বল বাতিঘর হয়ে জাতিকে অনুপ্রেরণা দেবেন। গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বলতা, নিপীড়িত জাতির স্বাধিকার অর্জন এবং মুক্তিসংগ্রামের অবিনাশী গান শোনাবে তার অমর কবিতা ৭ মার্চের ভাষণ। সে সঙ্গে বাঙালি জাতি পাবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে অবিনাশী প্রেরণা। মৃত্যুর পরও তার মহাকর্ম যুগ যুগ এদেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। কবির ভাষায়, ‘মোর লাগি করিয়ো না শোক/ আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক/ মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই/ পুণ্যরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিবে সবাই।’

আজ বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বুকে শোকের পাথর বেঁধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং পিতার আদর্শ নিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ আজ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বৈশ্বিক সম্পর্ক, খেলাধুলা, প্রযুক্তি, যুদ্ধাপরাধীর বিচার, নারীর ক্ষমতায়নে উন্নয়নশীল দেশের অগ্রপথিক বাংলাদেশ। দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা, খরা এসব শব্দগুলোর বিলুপ্তি ঘটিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায়। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তর করার দৃঢ় অঙ্গীকারে অঙ্গীকারবদ্ধ। স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত উচ্চারণ আজ নক্ষত্রের পথ দেখাচ্ছে। যেন পিতার প্রতিটি শব্দেই সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নপূরণে এগিয়ে যাচ্ছে ১৬ কোটি মানুষ, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!