• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যে সকালটা বুলেটবিদ্ধ ছিলো


দীপংকর গৌতম আগস্ট ১৪, ২০১৮, ০৮:৩০ পিএম
যে সকালটা বুলেটবিদ্ধ ছিলো

ঢাকা : ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ একদিনের ফসল নয়। টংক, তেভাগা, নানকারসহ বিভিন্ন কৃষক-মেহনতী মানুষের সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ থেকে আলাদা ঘটনা নয়। মানুষ সংগ্রামের মধ্য থেকে থেকে শিক্ষা নিয়েছিলো, সংগ্রাম ছাড়া পরিবর্তন সম্ভব না। সে ভাবেই একরে পর এক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আসে ৫২, ৬২, ৬৯। সেসব সংগ্রামের শহীদদের রক্তের পথ বেয়ে আসে বাঙালির মুক্তির মাহেন্দ্রক্ষন- মুক্তিসংগ্রাম। নয় মাসের পাকিবাহিনীর বর্বরতা, আতংকিত প্রহর বেষ্টিত রাত ও এক নদী রক্তের পথ বেয়ে আসে স্বাধীনতা। কিন্তু বাঙালীর এই গনসংগ্রাম এক প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে নস্যাৎ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন উবে যায় একের পর এক সামরিক উর্দির ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে।

বাঙালীর ইতিহাসের সবচে বর্বরতম নিঃষ্ঠুর ইতিহাস হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা । নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলো সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী ও বিপথগামী কিছু কর্মকর্তা। গোলাবিহীন কতগুলো ট্যাংকের গর্জনকে ভয় পেয়ে কেউ সামনে এগিয়ে আসেনি। বলা যায় খুনীরা বিনা প্রতিরোধে তিনটি বাড়িতে ঢুকে ,অপারেশন পরিচালনা করে চলে গেছে। রব সেরনিয়াবাত, ফজলুল হক মনি ও জাতির পিতাকে সপরিবারে ঠাণ্ড মাথায় হত্যা করেছে খুনীরা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ৪৩ টি বছর কেটে গেলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার দিনটির ঘটনা জানতে মানুষের আগ্রহের কিন্তু একটুও কমতি নেই। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে এখনও জ্বলজ্বল করছে সেই মহান ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি। পৃথিবীর নৃশংস ও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের সে দিনের ঘটনা মনে করে গোটা বাঙালি জাতি আজও ডুকরে কেঁদে ওঠে। তবে একটু ফিরে তাকালে আজ সবই স্পষ্ট। সেদিন রাতে কী ঘটেছিল, কারা জড়িত ছিল ইতিহাসের সেই নৃশংসতম-বর্বর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে, কী ছিল ঘাতকদের উদ্দেশ্য তা দেশের মানুষের কাছে আজ আর অজানা নয়। তার পরও সেদিনের ঘটনা বছর বছর প্রতিটি বাঙ্গালীর জানতে চায়। বিশেষ করে শোকের মাস আগস্ট আসলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্ট ভোর রাতে সপরিবারে নিহত হলেও  খুনী মেজর ডালিমের ঘোষনার আগে সবাই ছিলো অন্ধকারে। পাশের বাড়ির মানুষেরাও ভাবতে পারেনি যে বাঙালির আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি কথা হয় আশালতা চক্রবর্তীর সঙ্গে। ১৯৭৫ সালের  ১৫ আগস্টের নির্মমতার সময় ও আতংকিত প্রহরে যিনি অসহায়ত্ব নিয়ে ঘরের ভেতরে থেকে এক অস্ফুট আতংক নিয়ে নির্বাক হয়ে বসেছিলেন । তিনি তখন বাস করতেন  বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ৩২ নম্বরের রাস্তার উল্টোপাশের ৯৪ নং শুক্রাবাদ( বর্তমান নিউ মডেল কলেজের পাশের গলিতে বাড়িটি ছিলো।) ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন প্রয়াত বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ও আশালতা চক্রবর্তী দম্পতি।

আশালতা চক্রবর্তীর সাথে আলাপ হলে তিনি সেদিনের ঘটনা বর্ননা করেন। আমার বয়স এখন ৬৮ বছর। কিন্তু ঢাকায় যখোন এসেছিলাম সে বাহাত্তর সালের কথা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছে। আমার স্বামী চাকরি করতেন মিলিটারি একাউণ্টসে(সিভিল)। ১৯৭২ সাল থেকে যে অবস্থা ছিলো ১৯৭৫ সালের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছিলো। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তখোনই তার বিরোধীরা বিভিন্ন রকমের গুজব ছড়াচ্ছিলো। পথে ঘাটে এসব শোনা যাচ্ছিলো।

অন্যদিকে  গ্রামে-গঞ্জে ডাকাতি, জাসদ ভীতি প্রকট আকার ধারন করেছিলো। চালের দামসহ দ্রব্যমূল্য বাড়তে শুরু করে। জাসদের পত্রিকা পড়লে মনে হতো  দেশ ধংস হয়ে যাচ্ছে । তবুও সাধারণ মানুষের  অপেক্ষা ছিলো  মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ সহজেই কি পরিবর্তন সম্ভব? বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে পরিবর্তন আসবেই। স্বাধীন যখোন হয়েছি, এখন সবই হবে। এভাবেই দিন কাটছিলো।

কিন্তু ১৪ আগস্ট শেষ রাতে বা ১৫ আগস্টের শুরুতে আমাদের ঘুম ভাঙে গুলির বেপরোয়া শব্দে। আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পাছিলাম না। গুলির শব্দ  ছাড়া চারদিক শুনসান। আসপাশের সব মানুষ আমাদের বারান্দায় ভিড় করে। কি হচ্ছে? কেউ জানেনা। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে কি ঘটতে পারে কেউ ভেবে পাচ্ছিলো না। কারো মুখে রা শব্দটি নেই। সবাই যেন মুক, বধির। তখনো মাথায় আসেনি বঙ্গবন্ধুকে কেউ হত্যা করতে পারে।

পাকিস্তানিরা বর্বর, খুনী তারাই যাকে হত্যা করতে পারেনি তাকে কোন বাঙালি হত্যা করবে এটা মাথায়ও আসেনি। শংকায় বহু সময় কাটার পর আমাদের পাশের বাসার অপেক্ষাকৃত কম বয়সী রতন অধিকারী বাইরে যাওয়ার সাহস করে। রাস্তায় নেমেই দেখে মিলিটারি। তারা এক দেখে ইশারায় বাড়িতে ঢুকতে বলে। সে এসে একথা বললে আরো আতংকিত হই। পরে রেডিওতে এক কর্কস কণ্ঠের ঘোষনা শুনে সবাই হত বিহবল হয়ে যাই। বিস্মিত হই স্বাধীনতার প্রান পুরুষকে হত্যা করে তা রেডিওতে এনাউন্স করা হচ্ছে। দেশের কি হলো। শেখ মুজিবের মতো রাষ্ট্র নায়ককে পরিবার পরিজনসহ মারার কি হলো। সবখানে আতংক। পাখিও ডাকছিলো না। বাজার-ঘাট বন্ধ। অফিসে যেতে হবে তাই আমার স্বামীও অফিসে যেত। কিন্তু না ফেরা পর্যন্ত আতংকে থাকতাম। এই আতংক যে পেয়ে বসলো তা আর যাচ্ছলো না। তখনো বহু গুজব।

‘শেখ কামাল ডালিমের বউকে তুলে নিয়েছিলো বলে সামরিক বাহিনী রাগ হয়ে এটা করেছে’ বঙ্গবন্ধু নামাজ পড়তেন না-এমন বহুকথা। আমাদের  দেখলে বঙ্গবন্ধুর সমর্থক বলে এসব কথা পাশের বাড়ির লোকেরা বেশী করে বলতো।  মন খারাপ হতো। এধরনের হত্যা যে শুধু তাদের সমর্থক হলেই মেনে নেয়া যায় তা নয় কিন্তু। যেকোন নারকীয় হত্যাকে সমর্থন করার কোন কারন নেই। দীরে ধীরে শুনেছি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কাহিনী। তার পরিবারের সবাইকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে গুলি।ব ছোট শিশু রাসেল মার কাছে যেতে চাইচিলো তাকেও হত্যা। এ বর্বরতাকে মেনে নেয়া যা না।

পুরো হত্যাকাণ্ডের বিবরণে যা জানা গেছে, তাতে যে কোনো বিবেকবান মানুষের মন স্বাভাবিক থাকতে পারে না। দীর্ঘ ৪৩ বছর পরও সে হত্যাকাণ্ডের নারকীয় বর্বর কাহিনী শুনলে মানুষের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে । কিন্তু পাষণ্ড ঘাতকদের মন একটুও গলেনি। তারা শিশু রাসেলের মতো নিষ্পাপ শিশু এবং মহিলাদেরও রেহাই দেয়নি। মুহুর্মুহু গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাদের। খুনীদের বিচার যতই হোক ১৫ আগস্ট ভোরে (পোনে ৫টায়) ঘাতকরা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর নিজ বাসভবনে হামলা চালিয়ে যে বর্বরতা চালায় সে দিনের কথা চোখ বুজলে এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই। আমৃত্যু সেই আতংকিত প্রহর বেষ্টিত রাত , খুনীদের বুটের শব্দ কোনদিন ভুলবো না।

তারপরও প্রত্যাশা ছাড়িনি, ভাবতাম জেলে যেসব নেতারা বন্দী আছেন তারা মুক্তি পেলে কিছু একটা হবে। কিন্তু জেল হত্যা হলো। মানুষ হতাশ হলো আরও। তারপর ৭ নভেম্বর আরেক অঘটন। ক্ষমতা দখলের জন্য একের পর এক লড়াই। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপরার শরনার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করেছি। মুক্তি সঙগ্রাম দেখেছি। দেশে ফিরেছি। সব কষ্ট ভুলে ভাবতাম দেশ হবে স্বপ্নের মতো। কিন্তু কই কিছুতো হলো না?

বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বেশীর ভাগের বিচার হয়েছে বা পলাতক যারা তাদেরও হবে। কিন্তু দেশ যেজন্য স্বাধীন হলো সেই সাধারণ মানুষের ছোট খাট চাওয়াও পূরণ হয়নি। যে থাকলে এটা হতে পারতো তিনি বঙ্গবন্ধু। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে হয়ে ওঠা এ গণনেতার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন পূরণ হতো। তাই আজকের এই দিনে তাঁকে, তার পরিবার পরিজনকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!