• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

যেভাবে ‘স্বর্ণ মাফিয়া’ হয়ে ওঠেন দিলদার!


বিশেষ প্রতিনিধি মে ১৫, ২০১৭, ১২:৫৯ পিএম
যেভাবে ‘স্বর্ণ মাফিয়া’ হয়ে ওঠেন দিলদার!

ঢাকা: পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারে একটি স্বর্ণের দোকানে চাকরি করতেন তিনি। পাশাপাশি চোরাই স্বর্ণ কিনতেন, আবার সেসব স্বর্ণ কমদামে বিভিন্ন পার্টির কাছে বিক্রি করতেন। এভাবেই চোরাই স্বর্ণের বাজারে নির্ভরযোগ্য ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেন তিনি। এই তিনিই এখন স্বর্ণ চোরাচালানের মাফিয়া।

গল্পটি কোনো রূপকথা কিংবা সিনেমার নয়, বাস্তবের। গল্পটি দেশের অন্যতম স্বর্ণ ব্যবসায়ী আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের। চোরাই স্বর্ণ কেনাবেচা করতে করতে একসময় স্বর্ণ চোরাচালানের ‘মাফিয়া ডন’ হিসেবে আবির্ভূত হন সেলিম। কয়েক দশক ধরেই দেশের শীর্ষ স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত তিনি।

দিলদার আহমেদ সেলিমের এক ব্যবসায়ী বন্ধুর কাছ থেকে তার সম্পর্কে এমন তথ্য মিলেছে। ওই বন্ধু আরো জানান, স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকায় দেশের অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিক ও শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সেলিমের উঠাবসা। অঢেল টাকা দিয়েই সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলেন তিনি।

সম্প্রতি তার ‘গুণধর’ ছেলে সাফাত আহমেদের ধর্ষণ কাণ্ডের কারণে সেলিম এখন ‘টক অব দি কান্ট্রি’। তাই ছেলের পাশাপাশি বাবাও ‘আলোচিত’ হচ্ছেন। ছেলের ধর্ষণ ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় সেলিমের ব্যবসা ও ব্যক্তিগত জিনিসও তদন্ত আওতায় এসেছে।

গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর দ্য রেইন ট্রি হোটেলে সেলিমের ছেলে সাফাত ও তার বন্ধুরা মিলে দুজন তরুণীকে রাতভর ধর্ষণ করে। ঘটনা ধামাচাপা দিতে হুমকি-ধমকিও দেয়া হয়। ১০ কোটি টাকার অফারও পুলিশকে দেয়া হয় বলে অনেকেই অভিযোগ তুলছেন। তবে একপর্যায়ে ধর্ষণের মামলা হয়। গ্রেপ্তার হয় সাফাত ও তার এক বন্ধু।

মামলার ঘটনা জানাজানি হলে আত্মগোপনে চলে যায় সাফাত ও তার বন্ধুরা। এ অবস্থায় গণমাধ্যমে ছেলের পক্ষে সাফাই গেয়ে আলোচনায় চলে আসেন দিলদার আহমেদ সেলিম। গণমাধ্যমে সেলিম মন্তব্য করেন, ‘আমার পোলা আকাম (ধর্ষণ) করছে, তো কি হইছে? জোয়ান পোলা একটু-আধটু তো এসব করবই। আমিও তো করি। আমার যৌবন কি শেষ হয়ে গেছে? আমি এখনও বুড়া হইনি।’ গণমাধ্যমে দিলদার আহমেদ সেলিমের এমন বেফাঁস মন্তব্যে তোলপাড় চলছে।

এদিকে ব্যবসায়ী সেলিমের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (সিআইআইডি)। এরই অংশ হিসেবে রোববার (১৪ মে)  রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে অবস্থিত আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি শোরুমে অভিযান চালিয়েছে সিআইআইডি। এর মধ্যে দুটি শোরুম সিলাগালা করে দিয়েছে।

সংস্থাটি বলছে, এক ক্যারেট (দশমিক ২ গ্রাম) ডায়মন্ডও বৈধভাবে আমদানি করেনি আপন জুয়েলার্স। অথচ গুলশান, বায়তুল মোকাররম ও উত্তরার আপন জুয়েলার্সের শোরুমে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ডায়মন্ডের অলংকার। মূলত কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে এসব ডায়মন্ড শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে আনা হয়েছে। সিআইআইডির অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে বৈধভাবে আমদানি করা ডায়মন্ডের প্রাপ্ততথ্যে দেখা গেছে, অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে সামান্য পরিমাণ ডায়মন্ড আমদানি করেছে। এ তালিকায় আপন জুয়েলার্সের নাম নেই। এরপর আপন জুয়েলার্সের বিগত দুই বছরের আমদানির তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি এক ক্যারেট ডায়মন্ডও বৈধভাবে আমদানি করেনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আপন জুয়েলার্স তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে শাড়ির ব্যবসার মাধ্যমে। ওই ব্র্যান্ডের নাম ছিল ‘আপন শাড়ি’। এরপর তারা জুয়েলারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। এ ব্যবসার মধ্য দিয়েই তাদের ভাগ্যের চাকা ফেরে। নিজস্ব সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে আপন জুয়েলার্স চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

সূত্রমতে, স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী থেকে দিলদার আহমেদ সেলিমের ‘স্বর্ণ মাফিয়া ডন’ হয়ে ওঠার পেছনে গল্পটা এখন আস্তে আস্তে সবার সামনে চলে আসছে। তবে তার ব্যাপারে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কেউই কোনো তথ্য দিতে চাচ্ছেন না। অসততা আর অনৈতিকতার মধ্য দিয়েই দিলদার আহমেদের উত্থান হয়েছে। তার শিক্ষাগত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। লোভী-স্বার্থপর প্রশাসনিক কর্মকর্তা আর রাজনৈতিক নেতাদের কাঁধে ভর দিয়েই আজ মাফিয়া হয়ে উঠেছেন দিলদার। তার অসংলগ্ন কথাবার্তা আর মুর্খের মতো যুক্তি প্রয়োগে স্তম্ভিত দেশবাসী।

জুয়েলারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাই তাদের উত্থানের গোপন রহস্য কম-বেশি জানেন। বিভিন্ন সময় এ নিয়ে তার সমালোচনাও করা হয়েছে। কারও সমালোচনার তোয়াক্কা না করে সিন্ডিকেট পরিচালনার মাধ্যমে রাতারাতি ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে যান তারা (আপন জুয়েলার্সের মালিক)।

বিগত বিএনপি সরকারের আমলে রাইফেলস স্কয়ারে (বর্তমানে সীমান্ত স্কয়ার) আপন জুয়েলার্সের শোরুমে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে আনা বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার জব্দ করে। পরে সেটিকে ধামাচাপা দেয়া হয়।

আপন জুয়েলাসের এক কর্মকর্তা বলেন, সেলিমের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হলেন ডা. দৌলা ও জনৈক রাজনৈতিক নেতা। এদের মধ্যে ডা. দৌলা যুবলীগ নেতা মিল্কী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন। পরে সেলিমই প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করে তার জামিনের ব্যবস্থা করেন। আর রাজনৈতিক দলের জনৈক নেতা একাধিক হত্যা মামলার আসামি। অভিযোগ আছে, তাকে নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পাঁচতারকা হোটেলে মদপান করেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেন, দিলদার হোসেন সেলিম শূন্য থেকে কোটিপতি। প্রায় সব সময়ই সে মাতাল অবস্থায় থাকে। এছাড়া তার আশপাশে অপরাধী ও স্মাগলারদের ঘোরাফেরা। 

সেলিমের পরিবারিক অবস্থার বিষয়ে তার সাবেক পুত্রবধূ এশিয়ার টিভির সাবেক পরিচালক ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা বলেন, ‘তার মাতলামির কথা বলে শেষ করা যাবে না। এসব কারণে বড় ছেলে তো নষ্ট হয়েছেই, এখন ছোট ছেলে ইফাতও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছেলের বন্ধু হলেও নাঈমকে (দুই নম্বর আসামি নাঈম আশরাফ ওরফে হালিম) দিয়ে তিনি শোবিজের উঠতি মডেলদের ভাড়া করতেন। 

অনেক মডেলকে নিয়ে তিনি থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরেও গেছেন। বাবাকে দেখে তার ছেলেও এসবই শিখেছে। সাফাতও আপন জুয়েলার্সের মডেলদের নিয়ে বিদেশে যাওয়া শুরু করেছে। কিছুদিন আগে সে একজন আলোচিত মডেল নিয়ে ভারতে যায়। ওই মডেলের সঙ্গে সাফাতের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে।’

সোনালীনিউজ/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!