• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি : ফুল না কাঁটা


চন্দন আনোয়ার অক্টোবর ৩১, ২০১৭, ০১:০০ পিএম
রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি : ফুল না কাঁটা

চন্দন আনোয়ার মূলত কথাসাহিত্যিক। তবে নিবন্ধ- প্রবন্ধও রচনা করে থাকেন । এ যাবতকাল তার ১৫টির অধিক বই বের হয়েছে। তার মধ্যে গল্প, উপন্যাস, নিবন্ধ-প্রবন্ধ রয়েছে। বেশ কিছুকাল ধরে ‘গল্পকথা’ নামে কথাসাহিত্যের পত্রিকাটি সম্পাদনা করছেন। যুক্ত রয়েছেন শিক্ষকতায়।

ঢাকা : রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এই সুখবরটি শতবছর ধরে বাঙালির জীবনে সুবাতাস ছড়িয়েছে, বর্তমানে ছড়াচ্ছে এবং যে নবজাতক জন্ম নিয়েছে সেও এই সুখবর শুনতে শুনতে বড় হয়ে উঠবে। রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি ছিল  অখণ্ড বাঙালির আধুনিক বিশ্ববিজয়ের প্রথম ঘটনা। তাই এই প্রাপ্তির আÍশ্লাঘাবোধে বাঙালি যেমন উজ্জীবিত, তেমনি প্রাপ্তিকে ঘিরে অনেকগুলো জিইয়ে থাকা প্রশ্ন বা বিতর্ক, যাই বলি  না কেন, বাঙালির জন্য অস্বস্তিকরও বটে।

১৯০১ থেকে ১৯১২ অর্থাৎ একযুগের মধ্যে যে ১৩ জনকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল, তারা সবাই ছিলেন ইউরোপীয়। একযুগ পরে কী ভেবে এবং কোন বিচারে বাঙালি কবিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যাই দিয়েছে তখনকার নোবেল কমিটি। ‘গীতাঞ্জলি’ ইংরেজি সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে বলেই প্রায় অপরিচিত পীতবর্ণের বাঙালি কবিকে নোবেল পুরস্কারে না দিয়ে পারেনি। এ রকম গণেশ উল্টানোর ঘটনায় নোবেল কমিটি ও নোবেল পুরস্কার যৎসামান্য বিতর্কের মুখে পড়েছে অবশ্য কিন্তু আখেরে লাভটাও হয়েছে তাদেরই।

রবীন্দ্রনাথকে বড় করেছে সন্দেহ নেই,  রবীন্দ্রসাহিত্যও পৌঁছে গেছে বিশ্বের অলি-গলিতে। বড় প্রেমের মতো বড় প্রাপ্তিও কখনো-সখনো যন্ত্রণাবিদ্ধ করে। পীতবর্ণের বাঙালি, আমৃত্যু কবিতা লিখলেন বাংলায়, বাংলার জল-মাটি-বাতাস তাঁর কবিতার রক্ত-মাংস-প্রাণ সবেরই যোগানদাতা, আর তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হবে ইংরেজি সাহিত্যের সমৃদ্ধি করেছেন বলে, এই পুরস্কারের সম্মান বাঙালি কবির তিলকে কী নিয়তি লিখে দিতে পারে ? বাংলা সাহিত্যেরই বা কী আসে যায়। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন অনেক আছে, যুক্তি-পাল্টা যুক্তি আছে, তর্ক-বিতর্ক আছে, আছে ঘৃণা, আছে ভালবাসা, আছে প্রত্যাখ্যান ও নির্মম আঘাতে রক্তাক্তের ইতিহাস। যারা পশ্চিমে রবীন্দ্রনাথকে আমদানি করেছে, বাঙালি কবির কবিতা বোগলদাবা করে কৃষ্ণনৃত্য করেছে, সেই সব সুহৃদ বন্ধুরা নোবেল প্রাপ্তিতে শুধু অখুশি নন, রীতিমত বিষ-তীর ছুঁড়েছে।

অন্যদিকে, দেশে তো আছেই সক্রিয় ও শক্তিশালী রবীন্দ্রবিরোধী জোট। যারা ইংরেজের দালালির সুযোগ্য সম্মানি হিসেবে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি বলে মনে করে; যারা ব্রিটিশ সরকারের ‘নাইট’ উপাধি প্রদানের প্রস্তাবের পরে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে প্রচার করেছে। এছাড়াও এতকালের শোষণে-শাসনে জীর্ণকায় ভারতের জন্য একটা সান্ত্বনা পুরস্কার দেবার প্রয়োজন ছিল ইউরোপের। ভাগ্যচক্রে তা রবীন্দ্রনাথের জুটেছে, এমন রাজনৈতিক মেরুকরণের কথাও বাজারে আছে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়টি হল, আমজনতার একটা বড় অংশ মনে করে নোবেলপ্রাপ্তির কৃতিত্বের দাবিদার আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস। তিনি নিজে যেমন দাবি করেন, রবীন্দ্রবিরোধী দুর্মুখেরাও প্রচার করে। নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে যত রকমের ফ্যাসাদের আর দ্বিধা-দ্বন্দ্বের তৈরি তার বেশির অংশটার  দায় রবীন্দ্রনাথ নিজের, বাকিটা অবশ্য তাঁর মিত্র-শক্র সবার। রবীন্দ্র-সাহিত্যের এই বিতর্কের শেষ নেই।

নোবেল কর্তৃপক্ষ যে বিবেচনায় বা যে ব্যাখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজ কবি এবং তাঁর কবিতাকে ইংরেজি কবিতার সমৃদ্ধি বলেছে, তার খোরাকদাতা কবি নিজেই, এ রকম মনে করার যথেষ্ট কারণও আছে। তাঁর কবিতা দেহ থেকে বাঙালি ও বাংলা তথা ভারতীয় ঐতিহ্যের পোশাক খুলে পশ্চিমের পোশাক পরিয়ে দিয়ে এক প্রকার আÍঘাতী ভ‚মিকায় নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পশ্চিমে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেলেন, নোবেল পুরস্কার পেলেন কিন্তু সবকিছুতেই একটি অস্বস্তি, একটি আরোপের বিষয় ছিল; বিরোধ-প্রতিরোধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। বাঙালির মাটি অন্বিষ্ট বাস্তব জীবনকাব্য পোশাক পাল্টে হয়ে গেল ধর্মকাব্য। এই সত্যটি না বললে চলছে না যে, রবীন্দ্রনাথ নিজ হাতেই এই কাজটি করেছিলেন। আবাল্য পশ্চিমা সভ্যতার দিকে সম্মোহনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।

পশ্চিমের রুচি ও খোরাকের কথা বিবেচনা করে ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাকে ধর্মগীতে রূপ দিয়েছিলেন। বাঙালির চির আদরের বৈষ্ণব প্রেমরসে সিক্ত গীতিকাব্য ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগুণ বিবর্জিত নিরেট ধর্মের আপ্তবাক্যে পরিণত হল। কবি রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমে গিয়ে হয়ে গেলেন ঋষি রবীন্দ্রনাথ। নোবেল কমিটিও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত করলেন পশ্চিমের আশির্বাদধন্য ও খ্রিস্টধর্মের অনুকরণে একেশ্বরবাদী ধারণার স্রষ্টা রাজা রামমোহন রায়ের দিকে, যিনি ইংল্যান্ডে খ্রিস্টধর্মের প্রতি অনুরাগী ছিলেন এবং তাঁর ব্রাহ্মসমাজের ধারণা খ্রিস্টধর্মের আনুগত্যের ফলে সৃষ্ট। মানবিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাসহারা প্রায় যান্ত্রিক জনজীবন দৈত্যের মতো চেপে বসেছিল ইউরোপে, রক্তকরবীর সম্পদলোলুপ রাজার মতোই সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক বৈকল্য ক্রমশ ইউরোপকে নিয়ে যাচ্ছিল অনির্দিষ্ট গন্তব্যে। বিশ্বযুদ্ধের নকীব দরজায় দাঁড়িয়ে তখন। এই বাস্তবতায়, আর কিছুতেই দাঁড়াবার মত জায়গা ছিল না পশ্চিমের। যে আনুষ্ঠানিক খ্রিষ্টধর্মকে অকার্যকর বলে পিছনে ফেলে এসেছে সেখানে ফিরে যাবার সুযোগ ছিল না।

কিন্তু ভক্তি ছাড়া মুক্তিরও আর কোনো পথ নেই। যে বিজ্ঞান ও সম্পদকে এতোকাল নিরাপত্তার রক্ষাকবচ জেনে এসেছে, তা যে একটি মানসিক বৈকল্যপ্রসূত চিন্তা, এই সত্যকেও অস্বীকার করে আর পার পাচ্ছিল না। ঠিক এই বাস্তবতায়, রবীন্দ্রনাথকে যখন আবিষ্কার করলেন ইউরোপেরই কৃতি ব্যক্তিরা তখন কী যে বিস্ময়কর আলোড়ন ও তোলপাড় ঘটে গেল তা কল্পনা করা যায় না। আবেগে-উচ্ছ্বাসে-উন্মদনায় আভোলা  হয়ে ইয়েটস, এজরা পাউন্ডের মতো খ্যাতিমানরা যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রশংসা আর প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন বলাবাহুল্য, বাঙালি কবির  ইউরোপে প্রবেশ ঘটেছে একপ্রকার বিজয়ের বেশে। মাইকেলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পার্থক্যের জায়গাটিও এখানে- মাইকেল বাংলাসাহিত্য জয় করে যাননি।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্টত্বের মুকুট ছিল রবীন্দ্রনাথের মাথায়। মাইকেল নিজের বাঙালি সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে খ্রিস্টান হয়েছিলেন বড় ইংরেজ কবি হবেন বলে, রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিভাবে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন নি বটে কিন্তু বাঙালি কবি তাঁর কবিসত্তাকে সাময়িক সময়ের জন্যে হলেও দূরে ঠেলে খ্রিষ্টানচেতনায় এতোটাই একনিষ্ঠ হয়েছিলেন যে,  বাংলার মাটিলগ্ন প্রেমের কাব্য ‘গীতাঞ্জলি’কে সর্বাংশে নিড়ানি দিয়ে খ্রিস্টীয় মিস্টিকচেতনার কাব্য বানিয়ে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ ছিল না।

বাঙালির প্রেমের কবি পশ্চিমে হয়ে গেলেন ধর্মগুরু, তাঁর  কবিতা হয়ে গেল বাইবেলের সম্পূরক, গীর্জার প্রার্থনাগীত। সৌমদর্শন ব্যক্তিত্ব ও ‘গীতাঞ্জলি’র ভক্তিগীত দুইয়ের সম্মিলনে রবীন্দ্রনাথ এক অপার বিস্ময় হয়ে গেলেন ইউরোপে, যার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পাশে বসাও সৌভাগ্যের বিষয় মনে করতেন তাঁরা।

তথাকথিত রক্ষণশীল নোবেল কমিটি, যারা শ্বেতকায় খ্রিস্ট সমাজের বাইরে আর কাউকেই মানুষ বলে মনে করে নি, খ্রিস্টধর্মের ভক্তিরসের বাইরের শিল্পসাহিত্যকে অনৈতিক ও ক্ষতিকর বলে নাকচ করেন, আর যেই বিবেচনায় লেভ তলস্তয়ের মত সাহিত্যিকও পুরস্কারের অযোগ্য,  সেই নোবেল কমিটি ‘গীতাঞ্জলি’র ভক্তিগীতে এতোটাই ইমপ্রেস্ট হয়ে গেল যে, দুঃসাহসিকতা নিয়ে বেরিয়ে আসল কালারব্যারিয়ার ভেঙে। আলফ্রেড নোবেলের প্রার্থিত ‘আদর্শগত প্রবণতা’ ষোল আনাই পাওয়া গেল বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। যদিও নোবেল কমিটির একজন হ্যারাল্ড হারানে প্রকারন্তরে মেনে নিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা পুরো বোধগম্য হয় নি তাদের। টামাস হার্ডি, এমিল ফগের মত মনোনীত শ্বেতকায় সাহিত্যিকদের পিছনে ঠেলে পাশ্চাত্য নোবেল বোদ্ধাদের মনোযোগ কেন্দ্রে চলে আসেন রবীন্দ্রনাথ।

সমকালীন পত্রিকার পাতায় ও সুধীজনের দৃষ্টিতে, কাব্যগুণে নয়, ‘গীতাঞ্জলি’তে বাইবেলের প্রতিধ্বনি আছে, এ কারণে ইংরেজ পাঠকের মনোযোগ রবীন্দ্রনাথে দিকে ঝুঁকেছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে অবশ্য বিষয়টিকে খুব বেশি আমলে নেন নি এবং একপ্রকার নাকচ করেছেন এই বলে যে, বাইবেল পাঠই হয় নি তাঁর। তাতে অবশ্য খুব বেশি যায় আসে না। গোটা ইউরোপে ‘গীতাঞ্জলি’র কদর ও নোবেলপ্রাপ্তির কারণ যে  বাইবেলের প্রতিফলন ঘটেছে বলে, এই সত্যের প্রমাণ আছে সমকালীন পত্রিকায় ও লেখালেখিতে। আবু সায়ীদ আইয়ুব ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে অবশ্য বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা আমার দৃষ্টিতে সেটিই হওয়া সম্ভব বলে মনে হয়।

‘গীতাঞ্জলি’র ভাবকে খ্রিস্টীয় ধর্মী চেতনা হিসেবে পশ্চিমারা এবং দেশীয় দুর্মুখেরা যেভাবে প্রচার ও গ্রহণ করছে, সেই ভাব ভারতের কবীরের মধ্যে ছিল, যার উত্তরাধিকার বহন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আর তা প্রমাণের জন্য শেষতক রবীন্দ্রনাথকেই কবীরের অনুবাদ করতে হয়েছিল।

এছাড়াও একেশ্বরবাদী চেতনার ধারক বিশ্বমানবতার পতাকাধারী একজন কবির কবিতায় যিশুখ্রিস্টের মত মানবমুক্তির দূতের বাণীর কিছু নৈকট্য থাকবে না, এই রকম না ভাবার কারণ নেই। প্রতিষ্ঠিত ধর্ম-দর্শনের একটি অখণ্ড সত্যের ভিত্তির থাকে, রবীন্দ্রকাব্যের প্রধান ভিত্তি সেই অখণ্ড সত্য। কিন্তু তর্ক একটি জš§ নিয়েছে, প্রশ্ন একটি সৃষ্টি হয়েছে, এর পক্ষে-বিপক্ষে গ্রুপ-এন্টিগ্রুপ শতবছর আগে যেমন সক্রিয় ছিল, বর্তমানেও আছে। পূর্বেই বলেছি, এই তর্কের যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করে দিয়ে গেছেন রবীন্দ্র্রনাথ নিজেই। ‘নিজের কবর রবীন্দ্রনাথ নিজেই খুঁড়েছিলেন’ এমন নিষ্ঠুর ও কঠিন মন্তব্য করেছেন রবীন্দ্র আলোচক ই জে টমসন (রবীন্দ্রনাথ টেগোর হিজ লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্ক গ্রন্থের লেখক)। বাঙালির মৃত্তিকাতন্বিষ্ট নিরেট প্রেমের কবি, পদাবলির প্রেমের কবি রবীন্দ্রনাথ যেন ‘গীতাঞ্জলি’ পর্বে এসে আর পদাবলির সেই প্রেমকে ভাল চোখে দেখছেন না কিংবা ইউরোপবধের জন্য জুতসই মনে করছেন না। এই রকম একটি সন্দেহের কথা বলেছেন আবু সায়ীদ আইয়ুব। এই তর্কের শেষ নেই, এবং কোনোকালে হবে বলে মনে হয় না। বরং শতবছরে বিতর্কের আরো ডাল-পালা গজিয়েছে। খুঁটিনাটি নানা বিষয় জড়িয়ে গেছে বিতর্কের সঙ্গে।       

পূর্ব-পশ্চিমের সেতুবন্ধনের স্বপ্নবিলাসী কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল, দুই সভ্যতার আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব একটি একক মানবিক ও সাংস্কৃতিক প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াবে, তৈরি হবে একটি নতুন বিশ্বসভ্যতা। তখন প্রকৃতির নিয়মেই সরে যাবে পূর্ব-পশ্চিমের বিভেদের পর্দা। আর এই যুক্তিতেই,  পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী চেহারাকে অনুমোদন না দিতে পারলেও বা নিন্দা করলেও অগ্রসরমান পশ্চিমা সভ্যতাকে সাগ্রহে বরণ করার জন্য নিজে যেমন উদ্গ্রীব ছিলেন, তেমনি পূর্ববাসীদেরকেও গ্রহণ করে নিজেদেরকে সার্থক করার পরামর্শ তাঁর। আর গ্রহণ করতে অপারগ হলে বা প্রত্যাখ্যান করলে ‘কালের অমোঘ বিধান’কে অস্বীকার করা যাবে না বলে সতর্ক করেন। স্বকালে রবীন্দ্রনাথের পূর্ব-পশ্চিম মিলনভাবনা চরম বৈপরিত্যের জন্ম দিয়েছিল। এই বৈপরিত্যের মূল উপাদান রবীন্দ্রনাথের মধ্যে চরম স্ববিরোধিতা নিয়ে বহমান ছিল।

একদিকে ঔপনৈবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে উদ্ধত কণ্ঠস্বর তাঁর, কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন দাঁতাল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজকে, অন্যদিকে ইংরেজ সভ্যতার প্রতি ছিল  প্রায় অন্ধপ্রেম। আদান-প্রদানের মাধ্যমে মিলবে-মিলাবে বলে তাঁর যে প্রচেষ্টা, বাস্ততাবর্জিত একটি প্রচেষ্টা হিসেবেই চিহ্নিত। মিলবে-মিলাবে কিভাবে ? কোনো দিক থেকে সেই সমতা ? পূর্ব-পশ্চিমের দিকে রবীন্দ্রনাথ চর্মচোখে তাকান নি ? ঔপনৈবেশিক শোষণে-লুণ্ঠনে-লুটপাটে ভারতবর্ষ প্রায় রক্তশূন্য রোগীর মতো কোনো রকম একটি চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বিপরীতে, পূর্বের সম্পদে পশ্চিম ফুলে-ফেঁপে বিশালকায় এক হস্তির ন্যায় চেহারা নিয়ে সারা দুনিয়াটাকেই শাসাচ্ছিল। মোদ্দাকথা, কোনো দিক থেকেই পশ্চিমের সঙ্গে মেলা সম্ভাবনা ছিল না।

এই অসম্ভাবনাকে সামনে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে গিয়েছিলেন পশ্চিমে। অনন্ত দুইজন ভারতীয়ের আশির্বাদ ছিল  এই অদম্য পুরুষের সঙ্গে- এর একজন হলেন দাদা প্রিন্স দারকানাথ ঠাকুর, অন্যজন রাজা রামমোহন রায়। বলাবাহুল্য, তারাই রবীন্দ্রনাথকে পশ্চিমের পথ চিনিয়েছে  বাল্যে। পাশ্চাত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পকলা এই সব রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের একটি বিশেষ দিকও বটে, কারো মতে, ‘রবীন্দ্রনাথ is the product of European culture’।

ভারতীয় আধ্যাত্মিবাদের উত্তরাধিকার এবং পাশ্চাত্যের খ্রিস্টীয় মিস্টিজমের সম্মিলনে রবীন্দ্রনাথের যে বিশ্ববীক্ষণ, আইরিশ কবি ইয়েটসের সঙ্গে আশ্চর্যরকমভাবে মিলে গিয়েছিল। আমাদের রবীন্দ্রনাথের মত তাঁর মধ্যেও দ্বৈধসত্তা ও দ্বিধা ছিল। ভারতের মতোই আয়ারল্যান্ড ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল, ফলে  ভেতর থেকে একটি সুতীব্র ঘৃণা লালন করতেন ইংরেজদের প্রতি; বিপরীতে, ইংরেজের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের গৌরবও করতেন, নিজের পরিচয় দিতেন ইংরেজ কবি হিসেবে। ভারতের মত ধর্ম-সম্প্রদায়ের বিভেদে বিধ্বস্ত আয়ারল্যান্ডকে একটি ঐক্যের উপরে দাঁড় করানোর জন্য রবীন্দ্রকাব্যের বিশ্বমিলনের ধারনাকে ইয়েটসের কাছে নতুন একটি বিস্ময় নিয়ে উপস্থিত হয়। ফলে নিজেরে সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্র পরিণত হয় রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য ভারতীয় আধ্যাÍবাদ চর্চায় একনিষ্ঠ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয়ের আগেই।

‘গীতাঞ্জলি’র খসড়া পান্ডুলিপিকে ঘষা-মাজা, কাটা-ছেঁড়া করে কিভাবে ইংরেজের রুচি-মর্জি মাফিক করে তোলা যায় সেই প্রচেষ্টা ছিল তাঁর। অকৃত্রিম  বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ জয়ের পথকে সহজ ও পিচ্ছিল করে দিয়েছিলেন ইয়েটস। এছাড়াও এজরা পাউন্ড নামে রাগীধাঁচের তরুণ কবি, যার কবিখ্যাতিও যথেষ্ট প্রসার ছিল, রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করে ‘ইউরেকা’ চিৎকারের মতই বিস্ময়ে আকুল হয়ে প্রায় পাগলের মত রবীন্দ্রকাব্যের সুধা শরীরের মেখেছিলেন। দুই খ্যাতিমান কবির সান্নিধ্য ও প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ বিজয়ের প্রধান ঘটনা, পরে দেখা যায় এটি রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রধান দুর্ঘটনাও বটে। এজরা পাউন্ড খুব বেশি সময় নেয়নি রবীন্দ্রকাব্যকে অবাঞ্জিত ঘোষণা করতে। বরং বিরোধ এতই মর্মান্তিক ছিল যে, প্রহসনমূলক গল্প লিখে কবিকে খাটো করতে মাঠে নেমে গিয়েছিলেন।

খুব অল্পদিনের মধ্যে, ইয়েটসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিরোধও প্রায় প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। বিরোধের কারণ অনেক, এরমধ্যে প্রধান কারণ ছিল, ইউরোপের উর্বরক্ষেত্র পেয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজের কবিত্ব সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে ঋষি ও দ্রষ্টা হিসেবে  আধ্যাবাদের বক্তৃতা নিয়ে ইউরোপ চষে বেড়াচ্ছিলেন। নতুন এই ধর্মগুরুর বাণী ও সৌম্যদর্শনে বিমুগ্ধ ইউরোপের হৈচৈকারী একশ্রেণির আড়ষ্টচিন্তার মানুষ রবীন্দ্রনাথকে দখলে নিয়েছিল।

কিন্তু ইয়েটস, এজরা পাউন্ডরা তো জাত কবি, তারা কোনো মতেই রবীন্দ্রনাথের ঋষি চরিত্রকে অনুমোদন দিতে পারেনি। অবশ্য খুব অল্পদিনের মধ্যেই ভাবান্তর ঘটে রবীন্দ্রনাথের। তিনি যে ধর্মগুরু নন, মূলত একজন কবি এই ইমেজকে প্রতিষ্ঠিত করতে একের পর এক বই অনুবাদ করে প্রকাশের জন্য দিতেন। রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা তখন আকাশ ছুঁই, ফলে বিনাবিচারে পাঠক কিনে নিচ্ছিল। কিন্তু অনুবাদ হিসেবে ছিল এগুলো নিতান্তই আনাড়ি টাইপের ও বিশৃঙ্খল; একজন নোবলজয়ী কবির জন্য বেমানান।

‘গীতাঞ্জলি’র সাফল্যের পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের অনুবাদ দক্ষতার উপরে বাড়াবাড়ি রকমের বিশ্বাস করতে শুরু করেন, এবং নিজেকে একজন ইংরেজ কবিই মনে করতেন। তাঁর কবিতার সামান্য সংশোধনের অনুমতি চেয়ে হিতাক্সক্ষীরা মাথাকুটেও পারেনি। একের পর এক ব্যর্থ অনুবাদ ছাপা বেরুতে থাকলে ইয়েটস ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন, সস্তা ‘সেন্টিমেন্টাল রাবিশ’ বলে গালমন্দ করেন, এবং রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে  মারাত্মক  সন্দেহ  পোষণ করেন। রুষ্টতার মাত্রা কী পরিমাণে ছিল জানার জন্যে তাঁর এই মন্তব্যই যথেষ্ট: ‘রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি জানে না। শুধু রবীন্দ্রনাথ  কেনো কোনো ভারতীয়ই ইংরেজি জানে না।’

আর এইসব মন্তব্য যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ প্রায় হাতেনাতে জুটে গেল। জনপ্রিয়তা ভাটার দিকে টান ধরে। রাবিশ অনুবাদের বাইরে জনপ্রিয়তা কমে আরো একটি কারণ ছিল, ‘গীতাঞ্জলি’র আধ্যাত্মিকতায় বিমুগ্ধ পাঠক রবীন্দ্রনাথের বিশুদ্ধ কবিতাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। তারা ঋষি রবীন্দ্রনাথকেই গ্রহণ করেছে, কবি রবীন্দ্রনাথকে নয়। ‘গীতাঞ্জলি’র অনুবাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই, ইয়েটস  অনুবাদকে সামান্য কিছু কাটাকুটি ও পরিমার্জন করেছেন। এই রকম একটি সরল সমীকরণের মধ্যে নানা প্রশ্ন জড়িয়ে যায় যখন ইয়েটস ‘গীতাঞ্জলি’র অনুবাদের প্রধান কৃতিত্ব দাবি করেন এবং যারা তা অস্বীকার করেন তাদের উপরে তিনি চরম ক্ষিপ্ত হতেন।

অন্যদিকে, রবীন্দ্রবিরোধী জোট তো আছেই, যারা রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে সন্দিহান কেন, শিক্ষিত হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে নারাজ ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডিলিট  ডিগ্রির প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই বলে। ফলে দুর্জনেরা খুব ভালভাবেই এই অপপ্রচারটি চালাতে পারে এবং বিশ্বাস করাতেও পারে যে, ‘গীতাঞ্জলি’ ইয়েটস কর্তৃক পুনর্লিখিত। বাস্তবে, ৮৩টি কবিতার ১০০০০ (দশহাজার) শব্দের মধ্যে মাত্র ৪৫ টি শব্দ, প্রায় ৫০০ বাক্যের মধ্যে মাত্র ৪৩ টি বাক্য, আর কিছু যতিচিহ্নের পরিবর্তন করেছেন বলে জানা যায়। এইরকম অপ্রত্যাশিত বিতর্কে ত্যক্ত-বিরক্ত-ক্ষিপ্ত কবি চরম অপমানবোধ করেছিলেন, অপ্রত্যাশিত দুর্ব্যবহার করেছিলেন তাঁর বন্ধু-হিতাক্সক্ষীদের সঙ্গে।

‘সারাক্ষণ আমাকে এই সন্দেহ বয়ে বেড়াতে হয় যে আমি জালিয়াতির মাধ্যমে খ্যাতি পেয়েছি। আমার মনে হয় এর চেয়ে ভালো হত যদি এই সুযোগ যদি আমার জীবনে কখনোই না আসত, তাহলে নিজের ক্ষুদ্র কোণায় আমি অপরিচিত-অদৃশ্য থেকে যেতে পারতাম।-এরকম একটি হতাশা ও আক্ষেপ নিয়ে নোবেলজয়ী কবিকে বাঁচতে হয়েছে।

প্রকাশিত গ্রন্তের তালিকা

চন্দন আনোয়ার

চন্দন আনোয়ার
জন্ম : ৮ জানুয়ারি, ১৯৭৮, নাটোর, বাংলাদেশ। পেশা : অধ্যাপনা। বর্তমান বসতি রাজশাহী।

গল্পগ্রন্ত :
১. প্রথম পাপ দ্বিতীয় জীবন;
২. অসংখ্য চিৎকার
৩. পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর
৪. ইছামৃত্যুর ইশতেহার
৫. ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ
৬. নির্বাচিত ৩০ (কলকাতা থেকে প্রকাশিত)
৭. গল্পপঞ্চাশৎ : শূন্যদশকের গল্প (সম্পাদিত)

উপন্যাস  : শাপিতপুরুষ

প্রবন্ধগ্রন্ত :
 
১. হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য : বিষয়বিন্যাস ও নির্মাণকৌশল
২. বাংলা ছোটগল্প ও  তিন গোত্রজ গল্পকার : মানিক-হাসান-ইলিয়াস
৩. উজানের চিন্তক হাসান আজিজুল হক
৪. কথাসাহিত্যের সোজাকথা
৫.  নজরুল সাহিত্যে প্রেম
৬. বাঙালির চিন্তাবিভ‚তি : সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ
৭. হাসান আজিজুল হক : নিবিড় অবলোকন (সম্পাদিত)
৮. এই সময়ের কথাসাহিত্য ১ম ও ২য় খ­ (সম্পাদিত)

তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কথাসাহিত্যের পত্রিকা ‘গল্পকথা’।

chondon_anwar—yahoo.com

Wordbridge School
Link copied!