• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
আটক করে করে ফেরত

রাতের আঁধারে আসছে রোহিঙ্গারা


জেলা প্রতিনিধি নভেম্বর ২২, ২০১৬, ১০:৩২ পিএম
রাতের আঁধারে আসছে রোহিঙ্গারা

কক্সবাজার: দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কড়া নজরদারির মধ্যেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। তবে দিনে নয়, রাতের আঁধারে বাংলাদেশি দালালদের মাধ্যমে তারা আসছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে।

এদিকে, অনুপ্রবেশের দায়ে গত এক সপ্তায় বিজিবি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে ৫ শতাধিক রোহিঙ্গা। তাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বিজিবির কর্মকর্তা ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

কক্সবাজার ও বান্দরবানের সঙ্গে মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তপথ রয়েছে। এর মধ্যে ৫৪ কিলোমিটার জলসীমান্ত। এসব সীমান্তে বসবাসরত লোকজন জানিয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে টেকনাফের হোয়াইক্যং, দমদমিয়া, নোয়াপাড়া, ঝিমংখালী, সাবরাং, হ্নীলা, নাজিরপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, খারাংখালী এবং লেদা এলাকায় অনুপ্রবেশ বেড়েছে।

রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। সীমান্ত চৌকিগুলোতে অতিরিক্ত তিন প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। দিনের আলোতে বিজিবির তৎপরতা থাকায় অনুপ্রবেশ হচ্ছে না। তবে রাতের আঁধারে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে দালালদের সহায়তায় তারা অনুপ্রবেশ করছে।

স্থানীয়রা জানান, গত সোমবার (২১ নভেম্বর) ভোরে প্রায় ১৫টি রোহিঙ্গা পরিবার উখিয়ার কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নেয়। বস্তির বাসিন্দা আবু তৈয়ব বলেন, ভোর থেকে অনেক রোহিঙ্গা পরিবার বস্তিতে এসেছে। তারা বস্তির বিভিন্ন ঘরে আশ্রয় নিয়েছে।

মোহাম্মদ হাসেম নামে এক অনুপ্রবেশকারী জানান, আমার বাড়ি মংডুর কেয়ারিপাড়া গ্রামে। মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা ৪০ দিন জঙ্গলে কাটিয়েছি। এরপর প্রায় ৬ মাইল পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে উনচিপ্রাং সীমান্ত দিয়ে কুতুপালং বস্তিতে এসে আশ্রয় নিয়েছি। আরেক অনুপ্রবেশকারী কামাল আহমদ বলেন, তারা একসঙ্গে ২০টি পরিবার উনচিপ্রাং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে।

একই দিন দুপুরে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের হোয়াইক্যং বাজার এলাকায় দেখা মেলে মিয়ানমারের আরেক নাগরিক সুফিয়া বেগমের সঙ্গে। পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি জানান, ভোরের আলো ফোটার আগেই ছোট নৌকা করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে তারা ১৫ জন সীমান্তের লম্বাবিল হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। যাবেন কক্সবাজারের চকোরিয়ার একটি গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তার বাড়ি মংডুর কুইকখালী এলাকায়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তির ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক জানান, গত ২ দিনে ৩৫টি পরিবারের প্রায় আড়াই শতাধিক রোহিঙ্গা কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে গত ১৮ নভেম্বর রাতে নাফ নদীর জলসীমার শূন্যরেখা অতিক্রম করে ছোট সাতটি নৌকা নারী-পুরুষ ও শিশু নিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এ সময় কোস্টগার্ডের একটি টহল দল তাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য করে।

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ঝিমংখালী পয়েন্ট দিয়ে ১৮ নভেম্বর গভীর রাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে মিয়ানমারের রাইম্যাঘোনা, রইগ্যাদং, নাইংজং ও কেয়ারিপাড়া এলাকার অনেকে। এরা হলেন- নূর বেগম, শাহানুর, মৌলভী ছৈয়দ করিম, শমিলা বেগম, গরিবুল্লাহ, আয়েশা বেগম, ফরিদুল কালাম, আজিজ কালাম, সামিন আরা, খুরশিদা বেগম প্রমুখ। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের অনেকে বর্তমানে টেকনাফের অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির লেদায় আশ্রয় নিয়েছেন।

মিয়ানমারের রাইম্যাঘোনার বাসিন্দা মৌলভী ছৈয়দ করিম ও কেয়ারিপাড়া এলাকার হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আত্মীয়-স্বজনকে ধরে নিয়ে গুম ও হত্যা করেছে। নির্যাতন থেকে বাঁচতে পরিবার-পরিজন নিয়ে হোয়াইক্যং ঝিমংখালী এলাকা দিয়ে ১৮ নভেম্বর মধ্য রাতে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছি।’ জাম্বুনিয়া এলাকার নাজমা বেগম বলেন, সেনাবাহিনী ঘরে আগুন দিয়ে আমার সামনেই ৭ ও ৯ বছরের ২ ছেলেকে আগুনে নিক্ষেপ করেছে। নিরূপায় হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি।

রইগ্যদং এলাকার নুর বেগম, শাহানুর, শমিলা বেগম জানান, বাড়ি থেকে তাদের বাবা ও স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। খোঁজ-খবর না পেয়ে নিজেরা বাঁচতে লেদা সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে চলে এসেছেন। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লালু বলেন, রাত বাড়লেই সরব হচ্ছে নাফ নদী। গত কয়েক দিনে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের প্রবণতা বেড়েছে। বিজিবির দৃষ্টি এড়িয়ে ১৯ নভেম্বর থেকে ২০ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত কয়েকশ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে খবর পেয়েছি। তারা বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে।

একই কথা জানিয়েছেন সীমান্তের খারাংখালী এলাকার আরেক ইউপি সদস্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ১৯ নভেম্বর রাত থেকে সোমবার (২১ নভেম্বর) ভোর পর্যন্ত সীমান্তের মীনা বাজার, খারাংখালী, লম্বাবিল পয়েন্ট দিয়ে প্রচুর রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। তারা সবাই ছোট নৌকা নিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।

কক্সবাজার জেলা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, কোনো অবস্থায়ই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সুযোগ দেয়া যাবে না। তারা অনুপ্রবেশের সুযোগ পেলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়েও সংকট তৈরি হবে।

টেকনাফের ২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, রোহিঙ্গারা নাফ নদী পার হয়ে নৌকায় করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ইতিমধ্যে সীমান্ত চৌকিগুলোতে জনবল বাড়ানো হয়েছে। নাফ নদীতে সার্বক্ষণিক টহল দিচ্ছে বিজিবি। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে-এ রকম ঘটনা বিজিবির জানা নেই বলে জানান তিনি।

লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ আরো বলেন, সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত লোকজন ও জেলেদের সঙ্গে বৈঠক করে নাফ নদীতে মাছ ধরা ও চলাফেরা সীমাবদ্ধ রাখতে প্রচার চালাচ্ছে বিজিবি। রোহিঙ্গারা যাতে কোনোভাবেই অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। রাতে মাছ শিকার করতে না গিয়ে দিনে নাফ নদীতে যাওয়ার জন্য জেলেদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ সময় তারা যাতে শূন্যরেখা অতিক্রম না করে সে ব্যাপারেও সতর্ক করা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো ঘটনা জেলেদের কাছে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হলে বিজিবিকে জানাতে বলা হয়েছে।

বর্তমানে উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে মোট ৩১ হাজার ৭৫৯ জন নিবন্ধিত শরণার্থী অবস্থান করছেন।

প্রসঙ্গত, গেল ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালানো হয়। এতে সীমান্ত পুলিশের ৯ সদস্য নিহত হয়। সেই হামলার জন্য রোহিঙ্গাদের দায়ী করে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রাখাইন রাজ্যে হামলা চালায়। এরপর থেকেই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা।

সোনালীনিউজ/এমএন 

Wordbridge School
Link copied!