• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
জন্মদিনে শ্রদ্ধা অশেষ

রুনা লায়লার কিংবদন্তি হয়ে উঠার গল্প...


মিতুল আহমেদ, বিনোদন প্রতিবেদক নভেম্বর ১৭, ২০১৬, ০৬:৫৫ পিএম
রুনা লায়লার কিংবদন্তি হয়ে উঠার গল্প...

রুনা লায়লা। সংগীতের সাথে যার বসবাস গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ। তাকে কোনো বিশেষ শব্দযোগে বিশেষায়িত করাকে রীতিমত স্পর্ধাই বলা চলে। বাংলা সংগীতে তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। স্যার চার্লি চ্যাপলিনের খ্যাত হয়ে ওঠার মধ্যে যে একটা বাঁক বদল ছিল, নাটকীয়তা ছিল, আমাদের শিল্পী রুনা লায়লা’র কিংবদন্তি শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনেও ছিল তেমনি এক চরম নাটকীয়তা!

তার আগে চ্যাপিলনের বিষয়টিতে একটু ঢুঁ দেয়া যেতে পারে। পৃথিবী খ্যাত স্যার চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে যারা জানেন, তারা নিশ্চয় অবগত আছেন চ্যাপলিনের ঐশ্বর্যময় ক্যারিয়ারের শুরুর কথা! অথচ তার বিশ্বখ্যাত হওয়ার কথা কখনোই ছিলো না (চ্যাপলিন নিজেই তা বলেছেন বারবার)! কিন্তু সংকট, সুযোগ এবং সময় সব মিলিয়ে পৃথিবীর বুকে তার নাম চিরস্থায়ী হয়ে আছে। চ্যাপলিন যখন সেই ছোট্টটি, তখন তার মা তাকে নিয়ে দক্ষিণ লন্ডনের বার্লো স্ট্রিটে বস্তির মতন একটা জায়গায় থাকতেন। থিয়েটারে কাজ করে কোনোরকম সংসার চালাতেন মা। চ্যাপলিনের বয়স তখন পাঁচ। একদিন তার মা মঞ্চে গাইছিলেন। আর ছোট্ট চ্যাপলিন বসে বসে মায়ের অভিনীত গীতিনাট্য দেখছিলেন।

লন্ডনের খেটে খাওয়া শ্রমিক, আর মদ্যপ ভবঘুরেরা সাড়া দিন হাড়খাটুনি করে দিনশেষে বিনোদনের জন্য থিয়েটারে ভিড় জমাতো। মঞ্চে পারফর্মার হেরফের হলেই গাল-মন্দ শুরু করে থিয়েটার গরম করে ফেলত। এক সন্ধ্যায় মঞ্চে গান গাইছিলেন চ্যাপলিনের মা হ্যানা চ্যাপলিন। তার মা ছিলেন একটু অসুস্থ। গান গাওয়ার এক পর্যায়ে চ্যাপলিনের মায়ের গলার স্বর ভেঙে যায়, অসুস্থতায় কুকড়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেন তিনি। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষগুলো দিনশেষে নিজের টাকায় মউজ-মাস্তি করতে এসে তাতো মেনে নেবে না! তাদের তো বিনোদন চাই!

রুনা লায়লা
যখন তরুণী

ফলত মঞ্চ ভর্তি দর্শককে সামাল দেয়ার জন্য ছোট্ট চ্যাপলিনকে মঞ্চে তুলে দেয়া হল। পাঁচ বছর বয়সী চ্যাপলিন সেদিন পুরো মঞ্চ কাঁপিয়ে দিয়েছিল অভিনব কৌতুকী কায়দায়! আর এরপর থেকই অভিনয় এবং ধীরে ধীরে পৃথিবী খ্যাত হয়ে ওঠা তার। ঠিক এই বিষয়টির কিছুটা হলেও পেয়েছেন দশ হাজারের অধিক গান গাওয়া রেকর্ডধারী বাঙালি কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লা। কারণ রুনা লায়লা শুরুতে তো গান গাইতেন না! গান গাওয়ার পুরো আগ্রহ থাকা সত্বেও বাবার আগ্রহে মূলত গানের তালিম নিতেন তারই বোন দিনা লায়লা।

বোন দিনা গান শিখছেন, আর ছোট্ট রুনা বসে বসে তা দেখছেন। আর ভেতরে ভেতরে সুর পাকাচ্ছেন। যেমন চার্লি চ্যাপলিনের মা হ্যানা থিয়েটারে নাচতেন, গাইতেন আর পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে তা রপ্ত করতেন ছোট্ট চ্যাপলিন। সে যাই হোক, একদিন একটি অনুষ্ঠানে গাওয়ার কথা বড় বোন দীনা লায়লার। সবকিছু প্রস্তুত। সবাই উপস্থিত। আমন্ত্রিত অতিথি, দর্শক-শ্রোতা সবাই ভিড় জমিয়েছেন গান শুনবেন বলে। কিন্তু যিনি গাইবেন দেখা গেল তারই দেখা নেই!

আয়োজকরা পড়ে গেলেন মহা সমস্যায়। কারণ দীনা লায়লা অনুষ্ঠানের আগেই অসুস্থ হয়ে গেছেন। তার শরীরের যা অবস্থা কোনোভাবেই মঞ্চে এসে গান গাওয়ার মত নয়। হাতে সময় খুবই অল্প, অথচ শেষ সময়ে এসে তাদের ভাবতে হচ্ছে দীনা লায়লার বিকল্প কাউকে। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে কোথা থেকে শিল্পী যোগার করবেন, এই নিয়ে যখন ভাবছিলেন তখন কে যেন দীনার ছোট বোন রুনাকে দিয়ে গান করানোর প্রস্তাব করলেন। কিন্তু আয়োজকরা কেনই বা একেবারে আনকোরা একটা মেয়েকে এতগুলো মানুষের সামনে গান করতে পাঠাবেন।

তাছাড়া রুনারই বা বয়স কত, ছোট্ট একটি মেয়ে! এমন প্রস্তাবে আয়োজকরা খুব একটা পাত্তা দিলেন না। কিন্তু এই তাড়াহুড়োর মধ্যে জুঁতসই কোনো বিকল্পও বের করতে পারলেন না। অগত্যা দীনার বদলে ছোট বোন রুনাকেই গান গাইতে তুলে দেয়া হল অসংখ্য দর্শক-শ্রোতার সামনে! ভরা মজলিশে ছোট্ট রুনা জীবনের প্রথমবার সাহস নিয়ে মঞ্চে ওঠলেন। হাতে তুলে দেয়া হল ‌তানপুরা।

সুন্দর করে তানপুরাটিকে ধরে একেবারে প্রাজ্ঞ সংগীতজ্ঞের মতোন মঞ্চে বসেই বাজাতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তানপুরা আর ছোট্ট মেয়ের কণ্ঠ ও সুরে মোহিত উপস্থিত দর্শক শ্রোতা। তুমুল কড়তালি তাকে উদ্দেশ করে। আয়োজকদের চোখে মুখেও তৃপ্তির ফোয়ারা। এত অল্প বয়সে এত অসাধারণ গায়কী শক্তি কারো থাকতে পারে, এটা সেসময়ে কারো মাথায়ই ছিল না! ফলে সবার নজড় কেড়ে নেন বারো বছর বয়সী রুনা।

আর এরপরের কথাতো রীতিমত ইতিহাস। এটা হচ্ছে মূলত একটা প্ল্যাটফর্ম। এরকম একটু ছোট্ট সুযোগই হয়তো পৃথিবীতে কারো কারো জন্য পরম আশীর্বাদ, তার নামকে পৃথিবীর বুকে চিরস্থায়ী করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। যদি সেই মানুষটির মধ্যে ইচ্ছাশক্তিটা থাকে। ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর জন্ম নেয়া রুনা লায়লা ঠিক এর পরের বছরেই পাকিস্তানি ছবি ‌যুগ্ন-তে গান গাওয়ারও সুযোগ করে নেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে রুনা লায়লা কণ্ঠ দেন -মারনা ভি নেহি আসান-এর মত গানে। ১৪ বছর বয়সে পাকিস্তানি ছবি ‌হাম দোনো-তে -উনকি নজরো সে মোহাব্বত কা জো পয়গাম মিলা- গেয়ে একেবারে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন তিনি।

গানের মঞ্চে

সংগীতে তার অবস্থান পাকাপোক্ত হওয়ারও ব্যবস্থা হয়ে যায়। তৎকালীন পাকিস্তানি সিনেমা মানেই রুনা লায়লার গান। একের পর এক পাকিস্তানি ছবিতে গান গেয়ে যখন আধিপত্য বিস্তার করে ফেলতে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই তিনি নোংরা রাজনীতির শিকার হলেন। অন্তত রুনা লায়লার সংগীত ক্যারীয়ার শুরুর দিকটা নিয়ে এমন কথাই প্রচলিত।

পপ সম্রাজ্ঞী নূর জাহানের ঈর্ষার ছুরিকাতলে পড়লেন রুনা। কিন্তু তিনি কি পিছিয়ে পড়ার পাত্রী? যার কণ্ঠে যাদু আছে, তাকে কি পলিটিক্স করে আটকে রাখা যায়। ফলত দেখা যায় শুধু পাকিস্তান নয়, পুরো ভারত বর্ষে সংগীত নিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন রুনা লায়লা। ভারত পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কায় অসংখ্য কনসার্টেও অংশ নিয়েছেন সেসময়। শুধু কি সেসময়, এই বয়সে এসেও রুনা লায়লা বিভিন্ন দেশে তার গানের সুবাতাস ছড়িয়ে চলেছেন। ১৭ নভেম্বর জন্ম নেয়া গানের পাখি খ্যাত এই কিংবদন্তি শিল্পী ও তার বর্ণাঢ্য সঙ্গীত জীবনকে শ্রদ্ধা....

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিএল

Wordbridge School
Link copied!