• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রুপালী পর্দার রাজা তিনি


বিনোদন প্রতিবেদক আগস্ট ২১, ২০১৭, ০৯:৪১ পিএম
রুপালী পর্দার রাজা তিনি

ঢাকা: কলকাতার অলিতে গলিতে তখন ফুটবল ক্রেজ ছিলো ভীষন রকমের। ফুটবলে তিনি ছিলেন অসাধারণ। গোলকিপার হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে গিয়েছিলো গোটা এলাকায়।ডানপিটে এক দুস্টু ছেলে যার একমাত্র ইচ্ছে যেভাবেই হোক হতে হবে ফুটবলার। অথচ ছোট্ট একটি ঘটনায় ঘুরে যায় তার জীবন। স্কুলে যিনি তার গেইম টিচার তিনি তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। ফুটবলীয় দিকনির্দেশনার বদলে টিচার তাকে জানালেন, শিশুতোষ নাটক ‘বিদ্রোহ’র কেন্দ্রীয় চরিত্রে তাকে মঞ্চে অভিনয় করে দেখাতে হবে। স্বরসতী পূজা উপলক্ষ্যে করা সেই নাটকটি দিয়েই অভিনয়ে প্রথম কদম ফেলেন তিনি।

হয়তো গেইম টিচার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বুঝতে পেরেছিলেন ৭ম শ্রেনীতে পড়ুয়া এই ছেলে এক সময় ফুটবলের থেকে অভিনয়েই বেশি নাম করবে। নাম তো তিনি করেছেন-ই!সেই ছোট্ট ফুটবলার পরবর্তীতে অভিনয়ে এতটাই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন যে তিনি অর্জন করেছেন বাংলার ‘নায়করাজ’ খেতাব।

১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারিতে পৃথিবীর আলোয় নিজের আগমনী বার্তা জানান দেন তিনি। আকবর হোসেন ও নেসারুন্নেসা তাদের পুত্রের নাম রেখেছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। কলকাতার টালিগঞ্জে জন্ম নেয়া রাজ্জাক অভিনয়ে আসবেন এমনটা ভাবার অবকাশ খুব একটা ছিলো না। নায়ক রাজ্জাক এর পিতা এবং দুই ভাই যেহেতু ব্যাবসায়ী ছিলেন, রাজ্জাক ও তাদের পথ অনুসরন করবেন এমনটাই হয়ত ভেবেছিলো তার পরিবার। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তিনি হয়ে উঠলেন প্রভাবশালী জনপ্রিয় চিত্রনায়ক। হয়ে উঠলেন বাংলা রূপালি পর্দার রাজা।

কলকাতার খানপুর হাইস্কুল থেকে রাজ্জাক মেট্রিক পাশ করে ভর্তি হন চারুচন্দ্র কলেজে। কলেজ এ পড়াকালীন সময়েই “রতনলাল বাংগালি” নামে ছবিতে একটি চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। অভিনয় করতে নিশ্চয়ই তার মন্দ লাগেনি।কারন এর পর থেকেই তিনি মূলত অভিনয়ের প্রতি ব্যাপক আগ্রহী হন। তখনকার দিনে টালিগঞ্জে ছিলো বেশ কিছু বড় বড় স্টুডিও। নায়ক রাজ্জাক নিয়মিত আড্ডা দিতেন স্টুডিওতে। চেহারায় নায়কোচিত ভাব থাকায় ভালো ভালো চরিত্রেই তার ডাক পড়তো। পীযুশ বোস নামে এক নির্মাতার নজরে আসেন তিনি।পীযুশ বোসের নাটকে অভিনয় করতে করতে তিনি তাদের রঙ্গসভার নিয়মিত নাট্যকর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। অভিনয়ের উতকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে তিনি ১৯৫৯ সালে বোম্বের ফিল্ম ইন্সটিউট ‘ফিল্মালয়’ এ ভর্তি হন নায়ক রাজ্জাক।

১৯৬২ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই নায়ক রাজ্জাক বিয়ে করেন খায়রুন্নেসাকে। ভালবেসে যাকে সবসময় লক্ষ্মী বলেই ডাকেন রাজ্জাক। বিভিন্ন সময় ইন্টারভিউ তে অভিনয় জীবনে সফলতার পিছনে তার স্ত্রী লক্ষীর অবদানের কথা উল্লেখ করেন তিনি। অভিনয়ে এত দূর আসা হয়ত হতো না যদি স্ত্রী লক্ষ্মী সহযোগিতা না করতেন এমনটাই মনে করেন নায়ক রাজ্জাক। ২০১২ সালে তারা উদযাপন করেন বিবাহবার্ষিকীর ৫০ বছর। তিন ছেলে বাপ্পারাজ,বাপ্পি, সম্রাট ও দুই মেয়ে শম্পা ও ময়নাকে নিয়ে সুখী পরিবার ছিল তাদের। কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়ে বড় মেয়ে শম্পা থ্যালাসিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৯২ সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান।

রাজ্জাক বাংলার নায়করাজ। কিন্তু বাংলায় তার আগমন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইস্যুকে কেন্দ্র করে। টালিগঞ্জ থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারনে ঢাকায় পরিবার নিয়ে চলে আসেন রাজ্জাক। এটি ১৯৬৪ সালের কথা। ঢাকায় তিনি কমলাপুরে থাকতেন। ‘মুখ ও মুখোশ’ এর পরিচালক জব্বার খানের সাথে যোগাযোগের পর তার রেফারেন্সেই চাকরি পান তৎকালীন জনপ্রিয় চলচিত্র প্রযোজনা সংস্থা ইকবাল ফিল্মসে। “উজালা”ছবিতে তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন কামাল আহমেদের অধীনে।

সহকারী হিসেবে কাজের পাশাপাশি ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ ছবিতে ছোট একটি চরিত্রে কাজ করে নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন তিনি। ‘ঘরোয়া’ নামের একটি ধারাবাহিকেও কাজ করে তিনি দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। মেধাবী এই অভিনেতাকে কিংবদন্তী পরিচালক জহির রায়হান করে দেন সবচেয়ে বড় সুযোগ। ‘বেহুলা’ ছবিতে জহির রায়হান নায়ক চরিত্র রুপায়নের জন্য ডাকলেন রাজ্জাককে। নায়ক হিসেবে এটি ছিলো রাজ্জাকের প্রথম ছবি। ‘বেহুলা’ দিয়েই ঢাকাই সিনেমায় পদার্পন হয় তুখোড় এক নায়কের। ১৯৬৬ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। এই ছবির পর বাকিটা শুধু ইতিহাস। একটানা ৯০ দশক পর্যন্ত তিনি সদর্পে রাজত্ব করেন ঢাকাই সিনেমায়।

‘নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা’ অসম্ভব জনপ্রিয় এই গান শোনেননি এমন মানুষ বোধহয় পাওয়া যাবে না। রাজ্জাক-কবরী জুটির সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবির গান এটি। একসময় সিনেমা বলতেই মানুষ রাজ্জাক কবরী জুটির কথা বলতো। রাজ্জাকের বিপরীতে অনেক নায়িকা অভিনয় করলেও দর্শক রাজ্জাক-কবরী জুটিকেই পছন্দ করতো সবচেয়ে বেশী। শুধু অভিনয় নয়, নায়ক রাজ্জাক পরিচালক হিসেবেও ছিলেন সমান সাবলীল। ১৬ টির বেশী সিনেমার পরিচালনা করা নায়ক রাজ্জাকের রয়েছে নিজ মালিকানায় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘রাজলক্ষী প্রডাকশন”। সর্বশেষ তিনি পরিচালনা করেন ‘আয়না কাহিনী’(২০১৪) ।

অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হন তার ক্যারিয়ার জুড়েই। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের বিশেষ শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেছেন রাজ্জাক। ৭ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ২০০৯ সালে চ্যানেল আই চলচ্চিত্র মেলায় রাজ্জাকের পরিবারকে সম্মাননা দেয়া হয় চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য। জাতীয় চলচ্চিত্র আজীবন সম্মাননা পান ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালে পান মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা। চলচ্চিত্র অঙ্গনের একমাত্র তিনিই জীবদ্দশায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পান। ২৫ শে মার্চ, ২০১৫ তারিখে শেখ হাসিনার কাছ থেকে এই পুরস্কার তিনি গ্রহন করেন।

তবে, অগনিত পুরষ্কার ছাপিয়ে তার সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে ভক্ত, সমর্থকদের ভালবাসা। এই ভালবাসা-ই তাকে বাচিয়ে রাখবে কাল থেকে কালান্তরে। রূপালী পর্দার রাজার এমন বর্নালি রাজত্ব বেঁচে থাকুক ভক্তের ভালোবাসায়।

সোনালীনিউজ/বিএইচ

Wordbridge School
Link copied!