• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ১০, ২০১৭, ০২:৫৫ পিএম
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ

ঢাকা: মিয়ানমারের রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী নীপিড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বার্মিজ সেনাদের সেনাবাহিনী ও সরকার পরিকল্পিত নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতনকে জাতিসংঘ একে ‘জাতিগত নিধনের আদর্শ উদাহরণ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। 

মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) রোহিঙ্গাদের ওপর এই নীপিড়নের ঘটনায় বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। এ সময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য মো. নজরুল ইসলাম, সদস্য অধ্যাপক আখতার হোসেন, ইউএনডিপি হিউম্যান রাইটস প্রোগ্রামের চীফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজর শর্মীলা রাসুল। 

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। এই নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য কমিশন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মণ্ডলে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ সরকার ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এই অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা তদন্তের লক্ষ্যে একাধিকবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে। প্রথমবার ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পরিদর্শন শেষে কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে জনমত তৈরী করতে কাজ করাই বাংলাদেশের এ মুহূর্তে করণীয় বলে মন্তব্য করেন। 

গত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখ মাননীয় চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ মানবাধিকার সম্পর্কিত এনজিও ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করেন এবং রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানান। বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার কমিশনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে তাদের স্ব স্ব সরকারের সাথে আলোচনাপূর্বক মিয়ানমার সরকারের ওপর এই নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য কূটনীতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করার অনুরোধ জ্ঞাপন করে পত্র প্রেরণ করেছে। 

এছাড়াও, Global Alliance for National Human Rights Institutions (GANHRI), ASEAN Intergovernmental Commission on Human Rights, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসমূহের আঞ্চলিক ফোরাম (APF) ও কমনওয়েলথ সচিবালয়ের মানবাধিকার বিষয়ক ইউনিট, শিশু নির্যাতন বন্ধে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংস্থা (SAIEVAC), অরগানাইজেশন অফ ইসলামিক স্টেটস (OIC) এর মহাসচিব, ইউনিসেফ, আইওএম কে অনুরূপ পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। 

উল্লেখ্য, পত্রের জবাবে মিয়ানমারের মানবাধকার কমিশন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকট মোকাবেলা করার প্রস্তাব দিয়েছে। পরবর্তীতে, গত ৯ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি দল দ্বিতীয়বারের মতো কক্সবাজারের কুতুপালংসহ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এ দলের উদ্দেশ্য ছিল ভুক্তভোগী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে সেখানকার অবস্থার তথ্যানুসন্ধান করা। 

সেই তথ্যানুসন্ধানের প্রাথমিক প্রতিবেদন কুয়ালালামপুরে পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আয়োজিত গণ-আদালতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বক্তব্য তুলে ধরেন কাজী রিয়াজুল হক। 

তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতি বর্বর অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ তুলে ধরেছেন। উল্লেখ্য, গণআদালতের রায়ে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতন ও গণহত্যায় দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি ও সেনা প্রধানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ রায় বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলেছে এবং বাংলাদেশের সরকারপ্রধান মানবতার পরিচয় দিয়েছেন বলে প্রশংসিত হয়েছেন। 

গত ২৫-২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে তুরস্কের ইস্তানবুলে তুরস্কের মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ওম্বুডসম্যান কনফারেন্সে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অংশগ্রহণ করে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরেন এবং রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকার জন্য তুরস্কের মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। উক্ত কনফারেন্সে ওআইসি ও আসিয়ান সদস্য দেশসমূহ অংশগ্রহণ করেছে।  

কমিশন মনে করে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবাধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব মিয়ানমার রাষ্ট্রের।  মিয়ানমার সরকারকেই এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে। যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের পৈতৃক নিবাসে পুনর্বাসিত করতে হবে। আর এটা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকার, বিভিন্ন দেশী/ বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।  

ইতিমধ্যে, ইউএনএইচসিআর উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিবৃন্দ গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান ও সদস্যগণের সাথে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকে ইউএনএইচসিআরকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে সহায়তা প্রদান ও তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। সর্বশেষ গত ০৮-০৯ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ কমিশনের অনুসন্ধান দল ও ইউএনডিপি প্রতিনিধিদল, সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের মানবাধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যদিও কিছু অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এসময় সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক প্রধান ক্রিস্টফ ফুকস উক্ত পরিদর্শনে পর্যবেক্ষক হিসাবে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।  

কমিশনের সুপারিশমালা
১। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকার কর্তৃক পরিচালিত চলমান নির্যাতন অবিলম্বে বন্ধ করা
২। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের জন্য বাফার জোন তৈরি করা
৩। জাতিসংঘের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে দি-পাক্ষিক আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা
৪। বাংলাদেশে বসবাসরত দশ লাখ রোহিঙ্গার মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক বাংলাদেশকে সহায়তা প্রদান
৫। কোন ধরণের জটিলতা সৃষ্টি না করে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নপূর্বক মিয়ানমার রাষ্ট্র কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান
৬। প্রয়োজনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক/ বানিজ্যিক/ অস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে অবরোধ আরোপ করা
৭। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী  রাখাইন রাজ্যে যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে, তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে- এ কারণে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এআই

Wordbridge School
Link copied!