• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
সুইডিশ রেডিওর প্রতিবেদন

র‌্যাবের ক্রসফায়ারের গোপন তথ্য ফাঁস


নিউজ ডেস্ক এপ্রিল ৬, ২০১৭, ১০:৪৬ এএম
র‌্যাবের ক্রসফায়ারের গোপন তথ্য ফাঁস

ফাইল ছবি

ঢাকা: সুইডিশ রেডিও বাংলাদেশে ক্রসফায়ারে হত্যা, গুম ও নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছে র‌্যাবের এক কর্মকর্তার জবানিতে। ওই কর্মকর্তার বক্তব্য গোপনে ধারণ করা হয়েছে বলে তারা দাবি করেছে। তবে কথিত র‌্যাব কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করা হয়নি।

রেডিওর সাড়ে আট মিনিটের প্রতিবেদনের প্রায় পুরোটাই র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) কর্মকর্তার কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে। এর সঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও রয়েছে।
 
প্রতিবেদনে গোপন কথোপকথনের ওই ব্যাক্তিকে র‌্যাবের ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে কোথায় এবং কবে গোপন সাক্ষাৎকারটি ধারণ করা হয়েছে, তা বলা হয়নি। তারা দাবি করেছে, তাদের সোর্সকে সুরক্ষা দিতেই তারা তা  প্রকাশ করেনি।

মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ
প্রতিবেদনের শুরুতে ওই র‌্যাব কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘যদি তাকে খুঁজে পাও, তবে যেখানেই থাকুক না কেন গুলি করো এবং তাকে মেরে ফেলো। এরপর তার পাশে একটি অস্ত্র রেখে দাও’ – মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি এটাই হলো র‌্যাবের নির্দেশ।

সংবাদমাধ্যমটির দাবি, ‘একটি গোপন আলাপচারিতায় র‌্যাবের এক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এসব কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।’

এ কথোপকথন ভিত্তিও করে সুইডিশ রেডিও বলছে, ‘বাংলাদেশে র‌্যাব কিভাবে তার টার্গেটকে অপহরণ করে এবং হত্যা করে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোন ব্যক্তিকে হত্যা করতে হবে এবং কোন সহিংস পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে, তা র‌্যাব যেভাবে বাছাই করে তারও বিস্তারিত জানিয়েছেন তিনি। যারা গুরুতর অপরাধী বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু বিচারে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত কিংবা পুনর্বাসন করা অসম্ভব; তাদেরকেই র‌্যাবের এ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়।’

সুইডিশ রেডিওর প্রতিবেদনে  বলা হয়, ‘সংলাপটি বাংলায় ছিল এবং নিজস্ব সূত্রকে সুরক্ষা দিতে এর ভাষান্তর এমন দেশে করা হয়েছে যেখানকার লোকজনের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা নেই।’

সুইডিস রেডিও জানায়, ‘আলাপচারিতা চলার সময় ওই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, কিভাবে র‌্যাব বাছাইকৃত টার্গেটকে হত্যা করে। কীভাবে পুলিশ অপরাধীদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়, কীভাবে তারা ওই টাকাগুলো অস্ত্র কেনার জন্য ব্যবহার করে এবং নিহতের পাশে সে অস্ত্র রেখে দেয়। অস্ত্র পাশে রেখে দেয়ার মধ্য দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্য বোঝা যায় এবং র‌্যাব যে আত্মরক্ষার্থে এ কাজ করেছে তার প্রমাণ হাজির করা যায়।’
 
দুই ঘন্টার কথোপকথন
স্পর্শকাতর ওই রেকর্ডিংটি  প্রায় দুই ঘণ্টার বলে দাবি করে সুইডিশ রেডিও। তবে প্রতিবেদনে মাঝে মাঝে কিছুটা অস্পষ্ট ইংরেজি বক্তব্য শুনিয়ে প্রতিবেদক ইংরেজিতে তার ধারা বর্ণনা দেন। বাংলায় কোনো কথা বা বক্তব্য নেই। সুইডিশ রেডিও দাবি করেছে, ওই র‌্যাব কর্মকর্তার নিরাপত্তার স্বার্থে তারা তার মূল বাংলা ভাষার বক্তব্য প্রচার করেনি। সেটাকে ইরেজিতে অনুবাদ করেছে। প্রতিবেদনে র‌্যাব কর্তকর্তার বক্তব্য হিসেবে প্রচার করা হয়েছে অন্য একজনের কন্ঠে ইংরেজিতে দেয়া বক্তব্য। সুইডিশ রেডিও দাবি করেছে যে, তারা গোপনে ধারণ করা বক্তব্য পরীক্ষা করে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে।

রেডিওটি আরো দাবি করেছে, ‘উচ্চ পর্যায়ের ওই কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায় যে, গুমকে বাস্তবায়ন করতে তিন ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। সেগুলো হলো – টার্গেটকে ধরা, তাকে হত্যা করা এবং মরদেহটি উধাও করে দেয়া।’

ওই কথোপকথনে বলা হয়, ‘মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়ার আগে এর সঙ্গে কংক্রিটযুক্ত করার ব্যাপারে তারা কথা বলছেন। ওই কর্মকর্তা বর্ণনা করছেন, পুলিশ কীভাবে ঘটনার শিকার ব্যক্তি নিয়ে মিথ্যা কথা বলে। বন্ধুর কাছে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে তারা তাদেরকে হত্যা করে।’

সুইডিশ রেডিওর কথিত গোপন সাক্ষাৎকারে ওই র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, ‘গুমের ক্ষেত্রে সবাই বিশেষজ্ঞ নন।এক্ষেত্রে খুব সাবধানে কাজ করতে হয়। কোনো আলামত বা চিহ্ণ যেন না থাকে তা আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হয়। কোনো আইডি কার্ড যেন পড়ে না যায়। গ্লোভস পরে নিতে হয়। পায়ের ছাপ যেন না থাকে তা খেয়াল রাখতে হয় এবং এর জন্য আমাদের জুতায় কাভার পরে নিতে হয়। আর এ অপারেশন চলার সময় ধূমপান করা যায় না।’

সুউডিশ রেডিও দাবি করছে কথিত ওই কর্মকর্তা নির্যাতনেরও বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, ‘একটি অন্ধকার রুমের মাঝখানে একটি বাতি জ্বালানো থাকে আর সেখানে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে নগ্ন করে হাতকড়ায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়। তার গোপনাঙ্গে ইট বেঁধে দেওয়া হয়। নির্যাতিত ব্যক্তি একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।’

সুইডিস রেডিওর দাবি অনুযায়ী, ‘উচ্চ পর্যায়ের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রতিদিন লোকজন গুম হচ্ছে। নির্দোষ ব্যক্তিরাও গুম হচ্ছেন, এভাবে যে কেউই হত্যার শিকার হতে পারে। রাজনৈতিক বিরোধীদের থেকে পরিত্রাণ পেতে এটি একটি উপায় হতে পারে। এটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমানোর একটি উপায় হয়ে থাকতে পারে বলেও মত দেন তিনি।’

সুইডিশ রেডিওর দাবি, ওই রেকর্ডিংয়ে এত ভয়াবহতার বিবরণ আছে যে ভাষান্তরকারীকে কয়েকবার উঠে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে হয়েছে।

অ্যামনেস্টি ও সুইডিশ মন্ত্রী যা বলেন
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল লন্ডনের বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ওলোফ ব্লোমকবিস্ট বলেছেন, ওই রেকর্ডিং শুনে তিনি মর্মাহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ রকমের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কেউ এতটা স্বাভাবিক ও ঠান্ডা মাথায় কথা বলছে তা শোনাটা ভীষণ হতাশাজনক। আমরা নিজে নিজে তা নিশ্চিত করতে পারব না, কিন্তু এটি এমন কিছু যা অবশ্যই তদন্ত করা প্রয়োজন।’ 

রেকর্ডিংয়ের ব্যক্তিকে ঊর্ধ্বতন র‌্যাক কর্মকর্তা বলেই বিশ্বাস করতে চান ওলোফ ব্লোমকবিস্ট। তিনি বলেন, ‘এ রেকর্ডিংয়ে আমরা র‌্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত যা শুনেছি তার সঙ্গে কয়েক বছর ধরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রাপ্ত তথ্যের মিল রয়েছে।’

তিনি আরো  বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্যাতনবিরোধী ভালো আইন রয়েছে। কিন্তু তা কাগজে কলমে। সমস্যা হলো এ আইনের চর্চা হয় না।’ এই প্রেক্ষাপটে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং দায়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে অ্যামনেস্টি।

এদিকে সুইডিশ রেডিওতে প্রচারিত প্রতিবেদনে কথা বলেছেন সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্গট ওয়ালস্ট্রম। তিনি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। র‌্যাবের সমালোচনা করে সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশকে দায়িত্ব নিতে হবে। সুইডিশ রেডিওর অনলাইন সংস্করণে তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘একটি বিষয়ই বলার আছে – এটা ভয়াবহ ঘটনা এবং দ্রুত এর অবসান দরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো দেশটির পরিস্থিতির যে চিত্র তুলে ধরেছিল সেটাই এখানে নিশ্চিত হয়েছে।’

র‌্যাবের বক্তব্য
এ বিষয়ে র‌্যাবের বক্তব্য জানতে বুধবার র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠিয়েও জবাব পাওয়া য়াযনি। তবে তিনি বুধবার বাংলা দৈনিক ‘প্রথম আলো’-কে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘র‌্যাব আইন বহির্ভূতভাবে কিছু করে না। ক্রসফায়ারে এখন পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছেন, তারা সশস্ত্র, কুখ্যাত সন্ত্রাসী, ডাকাত ও জঙ্গি। ওদেরকে ধরার জন্য যখন অভিযান চালানো হয়, তখন তারা র‌্যাবের ওপর গুলি ছোঁড়ে। তখন র‌্যাবকেও গুলি ছুঁড়তে হয়।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘শুধু র‌্যাবের গুলিতেই সন্ত্রাসীরা নিহত হয়েছে ব্যাপারটা তেমন নয়, র‌্যাবের কর্মকর্তা ও সদস্যরাও নিহত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।’

মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্য
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘সুইডিশ রেডিওর প্রতিবেদনের কথা শুনেছি। কিন্তু পুরো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তবে এটার তদন্ত হতে পারে। আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুরো তথ্য দিলে আমরাও তদন্ত করে দেখতে পারি। আগে ওই প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য যে সম্প্রতি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম বা নিখোঁজ বেড়ে গেছে। এটা মানুষকে শঙ্কিত করছে। আমরা এগুলো দেখতে একটা ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’ করব। আর ক্রসফয়ারের ঘটনা যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করতে হবে। যদি কোনো কাজ বেআইনি হয় আর তার সঙ্গে যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ সূত্র: ডয়েচে ভেলে।

সোনালীনিউজ ডটকম/ঢাকা/এআই

Wordbridge School
Link copied!