• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

লতিফ জোয়ার্দার-এর সুগন্ধি আতরের গল্প


লতিফ জোয়ার্দার জানুয়ারি ২, ২০১৮, ০৫:৪০ পিএম
লতিফ জোয়ার্দার-এর সুগন্ধি আতরের গল্প

ঢাকা : নবীরের মৃত্যুটা ছিলো অস্বাভাবিক। ভরাসন্ধ্যা বেলায় নির্জন তিনরাস্তার মোড়ে তার লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিলো সুখচাঁদ আর জাফর। শরীরে কোথায়ও কোন জখমের চিহ্ন ছিলো না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল বটগাছের নীচে একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে। তবে একটু ভাল করে লক্ষ করলেই যে কেউ বুঝবে, নবীরের এ মৃত্যু স্বাভাবিক কোন মৃত্যু নয়। হয়তো তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে।

অথচ যখন লোকজন তাকে দেখলো, তার ঠোঁটের লালাগুলো শুকিয়ে গেছে তখন। চোখ দু’টি উল্টে আছে। মৃত্যু যন্ত্রণা তাকে নতুন মুড়ির মোয়া বানিয়ে ফেলেছিলো। দলে দলে লোকজন এসে, নবীরকে দেখেই ফিরে যাচ্ছিল। এই গ্রামের কারো যেন, এ মৃত্যু নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। কে মেরেছে নবীরকে, কারা মেরেছে সব যেন ধূয়াশায় থেকে গেল সবার কাছে। অন্তরালে পড়ে রইলো অনেক কথা।

মৃত্যু সংবাদ খুব দ্রুতই ছড়ায় সবখানে। নবীরের মৃত্যু সংবাদও এক কান দুই কান করে সবার কাছে পৌঁছে গেল। আর তারপর থেকেই, এই নবীর আলির মৃত্যু নিয়ে নতুন গল্প তৈরি হলো। সে গল্প ছড়িয়ে পড়লো, আশে-পাশের কয়েক গ্রামে। তার উপর নবীর আলি ছিলো তন্ত্রে-মন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ। গাছ-গাছলা দিয়ে কবিরাজী করা মানুষ। রাত-বিরাতে জ্বীনের সাথে গল্প বলা মানুষ। তাই নবীরকে দেখে, কেউ কেউ বললো, তাকে জ্বীন-পরীতেই মেরেছে। বিষয়টা অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ায়, কেউ এনিয়ে কোন কথা তুলেনি। আর কথাটা যেহেতু বক্কার হাজি বলেছে। তার মত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি তো বানিয়ে কথা বলবে না। সে কারণে কয়েক গ্রামের মানুষ বিষয়টা মেনে নিয়েছিলো। বিষয়টার সত্যমিথ্যা যাচাই বাচাই এর পূবেই সবাই জেনে গিয়েছিলো, জ্বীন-পরীতেই ভর সন্ধ্যায় বেলায় গলা টিপে মেরেছে ফেলেছে নবীরকে। তারপরও তাকে নিয়ে টানা-হেচড়া হলো। নানাজন নানা কথা বললো,থানা থেকে পুলিশ এলো। কিন্তু তারা নবীরের লাশ একবারের জন্য ছুঁয়েও দেখলো না। লাশের কাছে গেল না। বক্কার হাজির সাথে গোপন সাক্ষাত করেই ফিরে গেল।

সেই রাত্রীবেলাতেই একটা পুরনো খেঁজুরের পাটিতে জড়িয়ে, লাশ এনে নবীরের ঘরে রাখা হলো। নিস্তব্ধ রাতের আকাশ চেয়ে চেয়ে দেখলো একজন নবীরের প্রস্থান। রাতের নক্ষত্র দেখলো কিভাবে মিথ্যেগুলো সত্য হয়। মধ্যরাতে আকাশে মেঘ জমলো। যে মানুষের জন্য কান্নার কেউ নেই। তার লাশ আবার পাহাড়া দেবে কে? তবে সবকিছুর সাথে সম্পর্কহীন নবীরের লাশ নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হলো সকাল বেলায়। ধর্মে বিশ্বাস ছিলো না বলেই, গোরস্থানে জায়গা হলো না নবীরের। তিন গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবেরা, তার জানাজা পড়াতে রাজি হলো না। তবে কেউ কেউ অবশ্য বলেছিলো, বিরাণমাঠে ফেলা দেওয়া হোক নবীরের লাশ। শেয়াল কুকুর শকুনের খাবার হোক নবীর। তিনকুলে কারো কেউ না থাকলে যেমন হয়। অবশেষে নবীরের ঠাই হয়েছিলো সতীষ ঘোষের বাঁশঝাড় তলায়। যেখানে আর কোন কবর ছিলো না। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, গ্রামবাসী কয়েকজন রাজাকারকে মেরে মাটিচাপা দিয়েছিলো যেখানে । অতঃপর  দিনের বেলাতেও জ্বিন-পরী অথবা ভ‚ত পেতের ভয়ে এ মুখ মুখি হতো না কেউ।

বক্কার হাজির বাড়িতে মাস চুক্তি কাজ করে রব্বেল। সতের আঠার বছরের মত বয়স তার। মহিষের মত কালো শরীর। শীত গরম নেই গোসলের পর সমস্ত শরীরের সরিষার তেল মাখে। তবে খুব একটা বেশি উচা-চওড়া না রব্বেল। সতীষ ঘোষের বাঁশঝাড়ের তিন জমি পরেই বক্কার হাজির পাটের ক্ষেত। নবীরের মৃত্যুর কয়েক দিন পর সেখান থেকে ঘাস কেটে বাড়ি ফিরছিলো রব্বেল। কালভাদ্রে এদিকে কেউ না আসলেও, রব্বেল একাকিই আসতো মাঝে মধ্যে। তার বুকে ছিলো অসীম সাহস।

তারপরও আজ ,নবীরের কবর বরাবর এসে থমকে দাঁড়ালো সে। তার  মনে হলো, নিকট কোথা থেকে আতরের গন্ধ ভেসে আসছে। মাথা থেকে ঘাসের বোঝা নামিয়ে এদিক ওদিক তাকালো রব্বেল। কিন্তু কোথা থেকে আতরের গন্ধ আসছে ঠিক বুঝতে পারলো না। এবার নবীর আলির নতুন কবরের দিকে এগিয়ে গেল। কবরের সামনে গিয়ে দেখলো, কবরের উপরে বোনা মাষ কালাইলের বীজগুলো অঙ্কুরিত হয়ে কয়েক পাতা গজিয়েছে। রব্বেল জানে না কেন কী কারণে! কবরের উপর মাষ কালাই বোনা হয়। কী কারণে খেঁজুরের ডাল পোতা হয়। একটু ভর্য়াত ভাবে এদিক ওদিক তাকালো রব্বেল। একটু ভালো ভাবে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো, অন্য কোথা নয়! নবীর আলির কবর থেকেই আতরের গন্ধ আসছে। বিষয়টা অন্যরকম মনে হলো রব্বেলের। বার বার আল্লাহর নাম জপতে থাকলো। নবী রাসুলকে ডাকতে থাকলো। তারপরও অল্প সময়ের মধ্যে পুরো শরীর ঘেমে উঠলো রব্বেলের। আর কোনদিকে না তাকিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো সে।

যহরের নামাজের আযান শেষ হয়েছে মাত্র। বক্কার হাজি নামাজ আদায়ের জন্য বাড়ি থেকে বের হতেই রুব্বেল সামনে পড়লো। ঘাস না নিয়ে খালি মাথায় ফিরে এসেছে রব্বেল। গরু বাছুরগুলো সকাল থেকে শুননো আউর খেয়ে আছে।

-রব্বেল যে?

-জ্বি চাচা।

-সকাল বেলায় ঘাস কাঁটার কতা কইয়ে বাড়ি থেকি সেই যে বাড়ালু। আর এখন খালি হাতে ফিরি আসলু ব্যাপার খানা আমাক ক’তো দেকি ?
 রব্বেলের তখন শুকনো মুখ। মনে হয় কতদিন মুখে দানাপানি পড়েনি। তারপরও এক সময় আমতা আমতা করে, বক্কার হাজির কাছে বিষয়টা বলতেই। সে রব্বেলের মুখ চেপে ধরলো।

-যা দেখেছিস এ কতা আর একবারও মুখে আনবু নারে রব্বেল। তারচেয়ে তুই যেখানে যাক দেখপু তাকই কবু, নবীর আলীর কবর দিয়ে ধোয়া উড়তে দেখিছিস তুই। একোবরে নিজের চোখে দেখি আইছিস। আর তাতে করে লোকজন খুব সহজেই বিশ্বাস করবি, তুই সত্যি কথা কোসছিস। কারণ সে তো আর কোনদিন ধর্মকর্ম করতো না। তার কবরের উপর দিয়ে ধোঁয়া উড়তিই পারে। আগুন দেখা যাতিই পারে। কবরে যাওয়া মাত্রই সরাসরি গোর আজাব শুরু হইচে  তার। হাই মাবুদ মানুষকে ইমান দাও তুমি। ইয়া মাবুদ, না ফারমানি থেকে রক্ষা করো আমাদের।

কিছু সময় থেমে আবার বলতে থাকলো, কি বলবি তো। তুই তো আবার মিথ্যে কতা ভাল কোতি পারিস।

-না চাচা। আমি এই ডাহা মিথ্যি কতা কারুক কতি পারবো লা কো।

বক্কার হাজি মুখ-মন্ডল গম্ভীর হয়। মানবীক লোভ-লালসা গুলো লাপিয়ে দাঁড়ায়। বলে কী হারামজাদা! আমার খেয়ে পড়ে আমাকেই বলে কিনা, পারবো লাকো। তারপরও হঠাৎ কি যেন মনে করে, পাঞ্জবীর পকেটে হাত দেয়। এক শত টাকার এক নোট বের করে রব্বেলের হাতে ধরিয়ে দেয় বক্কার হাজি।

-কি রে রব্বেল, এবার কোতি পারবুনু তো।
- ঠিক আচে চাচা, এখন আপনে যা কোতি কন তাই কোবনে আমি।
-বুজিস কুনু রকম ভুল হয় না য্যান।
-এতা আপনেক ভাবতি হবিলা কো চাচা।  

দুপুরের আগে থেকেই দুই-এক জন করে মানুষ নবীরের কবরে ধূয়া দেখতে এলো। এক মুখ, দুই মুখ করে এই খবর ছড়িয়ে পড়লো চারদিক। এমন আন্দাজ কেউ কেউ অবশ্য করেছিলো। গোর আজাবের নমুনা আল্লাপাক নবীরকে দিয়ে দেখাচ্ছেন আমাদের। কেউ যেন ধর্ম বিমুখ না হয়!  কিন্তু নবীরের কবরের কাছে এসে, কেউ কোন কিছুই দেখতে পেল না। আতরের গন্ধও পেল না! আর কবরে ধুয়া উড়তে দেখলো না কেউ। সবাই ভাবলো এই ভর দুপুর বেলায় হয়তো ধূয়া দেখা যাবে না। তাদের হয়তো ভোর বেলায় আসতে হবে। এই খবর চারদিক পাখা বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়লো। একগল্প থেকে শত গল্প তৈরি হলো। পরেরদিন শত শত মানুষ নবীরের কবরের দিকে ছুটে গেল। সেখানে হুরাহুরি পাড়াপাড়ি হলো। কে আগে ধূয়া দেখবে তার জন্য সামান্য মারামারিও হলো।  কিন্তু সেদিনও কেউ কোন কিছু দেখতে না পেয়ে খিস্তি-খিউর করতে করতে বাড়ি ফিরতে লাগলো। কোন শালা কইলি রে করবে ধূয়া উড়ার কতা। শালাক ধইরি আন। এখনি ছাগল ছিলা করবো। এ খবর রব্বেলের কানেও পৌঁছালো। রব্বেল দৌঁড়াতে থাকলো, মাঠ বরাবর সামনের দিকে। সারাদিন তাকে আর কেউ দেখতে পেলো না।  

সংসার বিমুখ নবীর এ গ্রামে কবে কোথায় থেকে এসে একফালি জায়গা কিনে ঘর করেছিলো। এ প্রজন্মের কারো জানা না থাকলেও বয়ো-বৃদ্ধ অনেকেই জানে। নবীরের গল্প এখন হেঁটে বেড়ায়। চায়ের দোকান, পানের দোকান, হাটে মাঠে হাটে সবখানে।  কেউ কেউ বলে মধ্যরাতে একাকী ঘুরে বেড়াতো নবীর। কোথায় যায়! কার কাছে যায়। প্রয়োজনে না অপ্রয়োজনে তার ধার ধারতো না কেউ। তবে কেবলমাত্র ঝাড়-ফুর প্রয়োজনে সবাই দৌঁড়াতো নবীরের কাছে। তাবিজ-কবজের জন্যই দৌঁড়াতো নবীরের কাছে। সে শরীরে হাত দিলেই রোগ পালাতো। তার বাড়ির চারপাশে ছিলো অর্জুন, বহেরা, হরতকী, তুলসী বৃক্ষে ভরা। শিমুল, গাদা শতমূলী গাছ। উঠোন বলতে যতটুকুন জায়গা ছিলো, সেখানে এটা-ওটা লাগিয়ে ফাঁকা জায়গা বলতে আর কিছুই ছিলো না তার। নিজের দুটি মাত্র ঘর। একটা ঘরে নবীর নিজে থাকতো। আর আরেকটাতে কখনো কেউ এলে সেখানে থাকতো। তবে অন্যআরেকটি খানকাঘর ছিলো।

যেখানে সাধুদের আড্ডা হতো। নিজে নিজেই রান্না করে খেতো নবীর। তবে নিরামিষ ভোগী মানুষটা কারো সাথে তেমন একটা কথাবার্তা বলতো না। বছরে এক-দুইবার তার বাড়িতে অচেনা কিছু মানুষ আসতো। তারা রাতভর গান বাজনা করতো। তাদের সবার শরীরে ছিলো সাদা ধূতী আর সাদা পাঞ্জবী। কারো কারো আবার  লম্বা চুল-দাড়ি। তাদের দেখলেই কেমন যেন লাগলো। বুকে লু-হাওয়া বয়ে যেত। একেবারে নবীরের নিকটবর্তী কোন বাড়ি-ঘর ছিলো না বলেই। নবীর কারো ধার ধারতো না। গ্রামের কোন মোড়লকে তোয়াক্কা করতো না। সে কারণে নবীর একপ্রকার এক-ঘোরে ছিলো এই গ্রামে।

অথচ অনেকেই জানতো না! কত বিনয়ী এই সল্পভাষী মানুষটার হৃদয় যেন মধুরভান্ডার। তারপরও দূর থেকে মনে হতো সে যেন ব্যথার সাগর। তার ভিতর-বাহির নির্নয় করা বড় কঠিক। অনেকটা বৃক্ষের মত। তার কারো প্রতি কোন অভিযোগ নেই, কোন অনুযোগ নেই। কারো কাছে কোন যাওয়া পাওয়াও নেই তার। কিভাবে চলে তার, এমন প্রশ্নও কেউ কোনদিন করেনি তাকে। অথচ নবীর দিব্যি বেঁচে থাকার সংগ্রামের সাথে মানব সেবায় নিজেকে করেছে সংযুক্ত। কোন অস্থিরতার ভিড়ে নিজেকে বিলিনের কথা ভাবেনি সে। চৈত্র পূর্ণিমার রাতে নবীর একাকী রাত জেগে নিজের রচনা করা বিচ্ছেদী গান গাইতো। সারারাত তার চোখে ঘুম থাকতো না। রাতজাগা পাখির মত অবিরত গেয়ে যেত বিরহের গান। নবীরের মাটির ঘরের দেওয়াল ভেদ করে গানের কথামালা ইথারে ভেসে বেড়াতো।

একদিন এসেছিলে এই ভবেতে আবার যাবে চলে রে বন্ধু...আবার যাবে চলে

সকল কিছু রইবে পড়ে যাইবা নাতো বলে রে বন্ধু...যাইবা নাতো বলে...

তার গানের মুগ্ধ শ্রোতা ছিলো সবজু প্রকৃতি। ফুল পাখি তরুলতা। মনে হতো সবাই যেন মনোযোগ দিয়ে তার গান শুনছে। এ সময় পাখির কলোরব থেমে যেত। দূর-দিগন্তের বাতাসে হারাতো তার সকল গানের কথামালা।

এইগ্রামে আসার আগে নবীর ছিলো চাপাই নবাবগঞ্জের এক নিভৃত পল্লীতে। গ্রামের স্কুলে নয় ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলো সে। তার বাবা ছিলো গরুর ব্যাপারী। ওপার থেকে এপারে গরু নিয়ে এসে ব্যবসা করতো। সাত ভাই বোনের সবার ছোট ছিলো সে। কিন্তু তার ছিলো নানা রকম পাগলামী। পড়তে ভালো লাগতো না। খেলতে ভালো লাগতো না। পাখির মত উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করতো তার। কিন্তু একবার বাবা তার ওপারে গরু আনতে গিয়ে আর ফিরে এলো না।

একদিন দুইদিন করে মাস চলে গেল। বড় ভাইয়েরা সবাই বিয়ে করেছিলো বলে, সবাই পৃথক হলো। কিন্তু নবীরকে কাছে রাখতে কেউ রাজি হলো না। মায়ের সাথে থাকতো খেতো নবীর। বছর গেল না একদিন বাড়ির পাশের একমাঠ থেকে ছাগল আনতে গিয়ে বর্জপাতে তার মাও চলে গেল। তারপর থেকে নবীর আরো একলা হয়ে গেল। সবাই থেকেই যেন তার কেউ নেই। অল্প টাকায় ভাইদের কাছে সামান্য জমি বিক্রি করে ঘর থেকে অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো একদিন।

এখানে আসার পর থেকেই, বক্কার হাজি মানুষটাকে পছন্দ করতো না নবীর। তার ভিতর-বাহির যেন পুরোপুরিই ভিন্ন। ধর্মের কথা বলে অধর্মের কাজ করে সে। এখনো যুবতি মেয়ে মানুষ দেখলে হা করে তাকিয়ে থাকে। নিজেই নিজেই গ্রামের সালিশে ফতোয়া দেয় সে। কথায় কথায় নাউযুবিল্লাহ বলে। গ্রামে ওয়াজ মাহফিল হলে সভাপতির আসনে বসে সে।

মানুষটাকে এখনো চিনতে পারেনি সানজিদা খাতুন। এই ত্রিশ বছর বিয়ের বয়সেও, অচেনা থেকে গেল মানুষটা। মানুষের ক্ষতি করা ছাড়া যেন তার আর কোন কাজ নেই । আর হাজি হবার পর থেকে তো তার আকামের পরিমান বড়েছে কয়েকগুন। এ কথা কেউ না জানলেও সানজিদা খাতুন ভালো জানে। প্রয়োজনে কতটা ভয়ংকর হতে পারে এই বক্কার হাজি।  

নবীর আর বক্কার হাজির দ্ব›দ্বটা দীর্ঘদিনের। তবে তা প্রকাশ্যে ছিলো না কোনদিন। কখনো রাত্রী বেলায় নবীরের বাড়িতে হঠাৎ করেই উপস্থিত হতো বক্কার হাজি।

-নবীর, এই সব গান বাজনা আর না ফারমানি কথাবার্তা ছাড়তে হবে তোকে। জানিস তো আমি দাওয়াতের কাজ করি। নবী রাসুলের কতা কই। আর তুই আমার গ্রামে থাইকি করিস যতসব বেদাত কাজ। একুনো সময় আচে। আমি রাইগি গেলি তোর বড় ক্ষতি হইয়ি যাবি কিন্তুক। সময় থাকতি সাবধান হ।
 প্রথম প্রথম নবীর অবশ্য বক্কার হাজির কথায় কান দিতো না। তার মত সে কাজ করে যেত। তবে জানতো, এই বেদাত না লায়েক বদ নসিব গুনাগার মানুষের জন্য কোন রহম নেই বক্কার হাজির। সময়ের অপেক্ষায় আছে সে। সময় পেলেই আর কোন রক্ষা পাবে না এই নবীর।

-হাজি সাহেব। আমার পথ ভুল না আপনার পথ ভুল। তা বিচারের মালিক এক আছে। সেই সব দেখছেন।  তবে আপনে আমারে ভুল বুঝেছেন। আমি কোন মানুষের ক্ষতি করিনি কুনুদিন।তবে গান গাই। গান বাধি। গাছ লাগাই। এ তো  এসব আমার মনের খোরাক হাজি সাহেব। আপনার পর্দায় ঢেকে থাকা দিল এসব বুঝবি না কুনুদিন।

-আমারে বুঝাতে আসিসনি রে নবীর। তালি কিন্তুক ভাল হবি লা কো।

কোন অপশক্তির কাছে মাথা নত করার লোক নয় নবীর। তাই বক্কার হাজির হুমকি-ধামকি কোনদিন আমলে নেয়নি সে। তার একটাই ভাবনা ছিলো, সে তো মানুষের সেবা করছে। স্রষ্টা তাকে নিশ্চয় দেখবেন।  

তবে মাঝে-মাঝে দুই এক মাসের জন্য হারিয়ে যেত নবীর। কোথায় যেত, কেন যেত। তার ধার ধারতো না যেমন গ্রামবাসী। নবীরও কোনদিন কাউকে বলেনি এ বিষয়ে। পারখিদিরপুর গ্রাম থেকে সারে তিনমাইল রাস্তা ভোর রাতের ট্রেনের জন্য ছুটে যেত গফুরাবাদ রেলস্টেশনে। নবীরের বেশ ভুষায় তাকিয়ে থাকতো কেউ কেউ। কোন ফকির ফিকির ভেবে কেউ কেউ কাছে আসতো। জীবন জগত নিয়ে কথা বলতো। অথচ কাউকেই নিজের গন্তব্যের কথা বলতো না নবীর। যাত্রাপথে যে কোন এক স্টেশনে অজান্তেই নেমে পড়তো। তার বোচকায় থাকতো অর্জন হরতকী বহেরার বীজ। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যেত আর বৃক্ষের বীজ ছিটাতো নবীর। পাগল ভেবে কেউ কিছুই বলতো না তাকে। আবার রাতের বেলায় স্টেশনে ফিরে আসতো। চিড়া-মুড়ি খেয়ে, কারো কাছ থেকে একটা পাটি ভাড়া নিয়ে প্লাটফর্মে ঘুমাতো। গভীর ঘুমের রাত্রী। নবীর স্বপ্ন দেখতো। চারদিকে অবারিত সবুজের মাঠ। বাতাসের হাসি দেখতে পেত নবীর। ক্লান্তির ঘুম শেষে ভোর রাতে জেগে উঠতো আবার। ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসতো। স্টেশনের কলপাড়ে গিয়ে চোখে মুখে জল ছিটাতো । হয়তো আবার নতুন গন্তব্যে ছুটতে হবে থাকে তাকে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!