• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষক দম্পতির প্লাস্টিক বোতলের বাড়ি


রেজাউল করিম মানিক, লালমনিরহাট মে ১১, ২০১৭, ১১:৩৫ এএম
শিক্ষক দম্পতির প্লাস্টিক বোতলের বাড়ি

লালমনিরহাট: ইট দিয়ে বাড়ি তৈরী হয় এমন কথা আমরা সবাই জানি, কিন্তু পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে বসবাস যোগ্য বাড়ি তৈরী করা সম্ভব এটা কজনই বা জানে।

পরিবেশ বান্ধব অথচ স্বল্প খরচ এমনি একটি বাড়ি তৈরী করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত নওদাবাস গ্রামের পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষক দম্পত্তি। ১৭শ’ স্কয়ার ফিট বাড়ি তৈরীতে তারা ব্যবহার করেনি কোন ইট। তাদের এ বাড়ি দেখতে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা উৎসুক মানুষ। রাশেদুল ওই এলাকার আব্দুল বারী ও সুফিয়া বারীর ছেলে।

সরেজমিনে জানা যায়, স্বামী রাশেদুল আলম ও স্ত্রী আসমা খাতুন দু’জনে ঢাকার শেখ বোরহান উদ্দিন পোষ্ট গ্রাজুয়েট কলেজে পার্ট টাইম শিক্ষকতা করতেন। তাদের দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে রাফিদুল মানসিকভাবে অসুস্থ। তারা নিজে শহরের কোলাহল ছেড়ে ও চিকিৎসকের পরামর্শে দূষণ মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেলেকে বেড়ে উঠার সুযোগ করে দিতে এ বছর শিক্ষক দম্পত্তি ঢাকা ছেড়ে উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের নওদাবাস গ্রামের বাড়িতে স্থায়ী ভাবে চলে আসেন।

থাকার জন্য বাড়ি করতে হবে, অথচ হাতে যথেষ্ট টাকা-পয়সা নেই। এ ভাবনায় অস্থির স্ত্রী আসমা খাতুন ইন্টারনেট ঘেটে জানতে পারে  পরিত্যক্ত প্লাসটিকের বোতল দিয়ে ইকো হাউস নামে চমৎকার বাড়ি তৈরী করছেন জাপানীরা। এতে উৎসাহিত হয় আসমা। জাপানীরা পেলে পরিবেশ বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে আমরা পারব না কেন, এমন ভাবনা থেকে পথ চলা তাদের।

শুরুতে অনেকে তাদের বাড়ি করা নিয়ে হাসি তামাসা করেছে। রাশেদুলের বড় ভাই শফিউর রহমান বোতল দিয়ে বাড়ি তৈরি হবে এমন কথা মানতে নারাজ। শুরুতে বাধা দিয়েছিলেন তিনি। এখন তিনি গর্ব করে বলেন, রাশেদুল পরিবশে বান্ধব বাড়ি তৈরি করে এক সময় দেশের মানুষের কাছে বোতল হাউজের উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত লাভ করবেন।

চার রুমের থাকার ঘর, দুটি বাথরুম, রান্নাঘর বারান্দা, ১৭শ’ স্কয়ারফিট বসতভিটায় সর্বত্র বিভিন্ন সাইজের বোতল ব্যবহার করেছেন তারা। এমনকি বাথরুমের সেফটিং ট্যাংক ও মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে প্লাসটিকের বোতল। বাড়ির ভিত্তি মূলে ১ লিটার এবং দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে হাফ লিটার প্লাসটিকের বোতল। প্লাসটিকের বোতলে বালি ঢুকিয়ে তা ইট হিসেবে সিমেন্ট দিয়ে লাগানো হয় বাড়ির কাজে। বোতলে বালি ব্যবহার করায় বোতল স্বাভাবিক ইটের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ গুন বেশি শক্ত হয় বলে দাবি করেন রাশেদুল। বালি গরমে তাপ শোষন করে ঘরকে রাখে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা।

প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন বোতলের তৈরি বাড়ি দেখতে আসছে। বাড়ির কাজে নিয়োজিত মিস্ত্রিরাও আনন্দিত এ কাজে অংশগ্রহণ করতে পেরে।

পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা আলিমুজ্জামান জানান, ‘বাহে, এত কম টাকায় মজবুত বাড়ি হয় আগোত জানলে হামরাও প্লাসটিকের বোতল কুড়িয়ে বাড়ি কইর বার পানু হায়’।

বাড়ির রাজমিস্ত্রী রুদ্রেশ্বর রায় জানান, ‘সারা জীবনতো ইট দিয়া বাড়ি গড়ে দিছি মাইনষোক (মানুষকে), এবার প্লাসটিকের বোতল দিয়া বাড়ি করছোং বাহে’।

পরিবেশ রক্ষার ওপর দায়বদ্ধতা থেকে রাশেদুল অভিনব বাড়ির কাজে হাত দেয়। আর এ কাজে সার্বক্ষনিক সাহস জোগায় স্ত্রী আসমা খাতুন।  পরিবেশ বান্ধব, তাপশোষক, অগ্নিনিরোধক ও ভুমিকম্প সহায়ক এ বাড়ি ইটের তৈরি বাড়ি অপেক্ষা ৪০ শতাংশ টাকা কম খরচ বলে জানায় উদ্ভাবক রাশেদুল। আগামী এক মাসের মধ্যে অবশিষ্ট কাজ শেষ করে তারা বোতল হাউজে বসবাস শুরু করবে বলে জানায় এই দম্পত্তি।

রাশেদুল দম্পতি জানায়, তাদের এ বাড়ি করতে ৭৫ থেকে ৮০ হাজার প্লাসটিকের বোতল (৪০মন বোতল) প্রয়োজন হয়েছে। বোতল কিনেছেন ৬০ মন। প্রতি কেজি বোতল প্রকার ভেদে কিনতে হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। টিনের চালা বাদে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে বাড়ির পুরো কাজ শেষ হবে বলে আশা করছে এ দম্পত্তি। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারী বাড়ির কাজ শুরু করেন। এ পর্যন্ত ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।

কালীগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা, প্রবীন সাংবাদিক শেখ আব্দুল আলিম জানান, দেশে ইটের বাড়ি হয় সেটি জানি কিন্তু পরিত্যক্ত বোতল দিয়ে যে বাড়ি করা যায় তা রাশেদুলের এই বাড়িটি না দেখলে বিশ্বাস হতো না। তার এই বাড়িটি দেখে এলাকার অনেকেই উদ্ধুব্ধ হচ্ছেন আবার অনেকে তাদের কাছ থেকে বাড়ির নকশা করে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ি করবেন।

প্লাসটিকের বোতল দিয়ে তৈরী বাড়ি পরিবেশ বান্ধব হলেও এটি ব্যবহারের আগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন হওয়া উচিত বলে মনে করেন কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ নেওয়াজ খান।

তিনি আশাবাদ জানিয়ে বলেন, দরিদ্র মানুষদের কাছে এ ধরনের বাড়ি মডেল হিসেবে কাজ করবে। বোতলের বাড়িটি নির্মানে যদি আড়াই লাখ টাকা ব্যয় হয় তবে ইটের তৈরী এ রকম বাড়ি করলে ৪ লাখের মত ব্যয় হবে বলে জানালেন এই প্রকৌশলী। রাশেদুল দম্পতির বোতল হাউজের সাথে প্রকৌশলগত দিক সমন্বয় করলে এটি আরও নিরাপদ ও টেকসই হবে বলে তিনি জানান।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!