• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষক প্রশিক্ষণের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ!


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ১২, ২০১৭, ০৯:২৭ পিএম
শিক্ষক প্রশিক্ষণের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ!

প্রতীক ছবি

ঢাকা: মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের সৃজনশীল শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে চরম অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম চলছে। এ প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থ দিয়ে সারাদেশের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির পাঠদান ও প্রশ্নপত্র তৈরিতে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা।

কিন্তু তা না হয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সে অর্থ ব্যয় হচ্ছে অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আসবাবপত্র ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কেনা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতে। অথচ সেই প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক দফা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন এসব কর্মকর্তা।

এমন অনিয়মে ক্ষুব্ধ শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সম্প্রতি কমিটি এক বৈঠকে হতাশাও প্রকাশ করেছে। ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ (সেসিপ) শীর্ষক এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ মাউশি।

মাউশির সূত্রমতে, মাত্র তিন দিনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে এখন এক থেকে দেড় মাসের করার পরিকল্পনা করছেন মাউশি’র কয়েকজন কর্মকর্তা। কার্যক্রমের মেয়াদ বাড়াতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে এ নিয়ে তাদের গোপন আলাপও চলছে। এমনকি চলতি অর্থবছরের শেষের দিকে এসে এ খাতের অর্থ শেষ করতে এখন উঠেপড়ে লেগেছেন প্রশিক্ষণের নামে ঘন ঘন কর্মশালা, বিদেশ ভ্রমণ ও সভা করার শেষমুহূর্তের পরিকল্পনা।

কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেন, প্রশিক্ষণের বদলে সেসিপ’র বাজেটের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় হয়েছে জেলা পর্যায়ে আয়োজিত প্রকল্পের নানা কাজে অংশ নেয়া মাউশি’র কর্মকর্তাদের যাতায়াত খরচে। এতে শিক্ষকরা উপকৃত হননি।

এমনকি মাঠ পর্যায়ের শিক্ষকদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ বিভিন্ন জেলায় হলেও ঢাকায় ‘মাস্টার ট্রেইনারদের’ ১২ দিনের যে প্রশিক্ষণ হচ্ছে; সেখানেও সারা দেশের মাঠ পর্যায়ের যেসব শিক্ষক সরাসরি পাঠদানের সঙ্গে যুক্ত, তারা এ কার্যক্রমের সুফল পাচ্ছেন না। এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর।

সেসিপ সম্পর্কে জানতে মাউশি’র কার্যালয়ে গেলে জানা যায়, কার্যক্রমটির যুগ্ম পরিচালক আবু সাঈদ শেখ (অতিরিক্ত সচিব) কার্যালয়ে নেই। তিনি ‘প্রশিক্ষণের’ জন্য ২০ দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন গত ৩ মার্চ; ঢাকায় ফিরবেন আগামী ২২ মার্চ। বিদেশে থাকায় প্রকল্পের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

অনুরূপভাবে এ প্রকল্পের পরিচালক এস এম ওয়াহিদুজ্জামানকেও সেদিন কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। প্রশিক্ষণের কাজে তিনি শরীয়তপুর ছিলেন। সেখান থেকে পরদিন তার বরিশাল যাওয়ার কথা। ঢাকায় ফিরলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে বলেন, ‘প্রশিক্ষণের মেয়াদ এক মাস বা দেড় মাসে উন্নীতকরণের বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন আছে, চূড়ান্ত হয়নি।’

সূত্র জানায়, চলতি মাসে সেসিপ’র আওতায় কক্সবাজার, বরিশাল ও শরীয়তপুরসহ কয়েকটি জেলায় আবাসিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এসব কর্মশালায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বদলে সরকারি কর্মকর্তা, কলেজের শিক্ষক ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাই বেশি উপস্থিত ছিলেন বলে কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করেন।

কার্যক্রমের বিষয়ে দেশের বেশিরভাগ শিক্ষক এখন পর্যন্ত কিছু জানতে পারেননি। তাদেরকে জানাতে মাউশি কোনো চিঠিও পাঠায়নি। তারা আদৌ কোনো প্রশিক্ষণ পাবেন কি না, তাও জানেন না। সরকারি মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির নেতা মোফাজ্জল হোসেনের অভিযোগ, সৃজনশীল প্রশিক্ষণের নামে অর্থ লুটপাট হচ্ছে।

প্রশিক্ষণে জড়িত কর্মকর্তারা সবাই কলেজের লোক, মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। প্রশিক্ষকদের ধারণা কম থাকায় একজন শিক্ষক তিন দিনের প্রশিক্ষণে কিছুই শিখতে পারছে না। যোগাযোগ করলে সেসিপ’র পরিচালক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

মাউশি’র হিসাবমতে, কার্যক্রম শুরুর সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সারাদেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চার লাখ ৬৮ হাজার ৯৪৩ শিক্ষকের মধ্যে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে পাঠদানের বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মাত্র ৬০ হাজার ৭৭০ শিক্ষক। বাকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চলতি বছরের মধ্যে সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান কর্মকর্তারা।

কারণ ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে বাস্তবায়ন শুরু হওয়া এ কার্যক্রমের মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। তবে প্রকল্প পরিচালক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান মনে করেন, চলতি বছরের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হবে। গত তিন বছরে এতো কম সংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, লোকবল সংকটের কারণে আরো বেশি শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা যথার্থ পাঠদান করতে পারছেন না বলে মত দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের মতে, এ কারণে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে বাজারের গাইড বইয়ের প্রতি ঝুঁকছে। বিষয়টি শিক্ষার মানের জন্য আত্মঘাতী বলেও মনে করছেন তারা। এ ব্যাপারে সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, শিক্ষকরাই সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারছেন না। ফলে তারা গাইড বই অনুসরণ করছেন।

অভিযোগ উঠেছে, মাউশি’তে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের কয়েক কর্মকর্তা বিভিন্ন শ্রেণির নোট, গাইড ও সহায়ক বই লিখছেন। শিক্ষার্থীদেরকে গাইড বই-নির্ভর করে রাখতে তারা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের বাস্তবায়ন চান না।

‘রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে এখনো শিক্ষার্থীরা অভ্যস্থ হতে পারছে না। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। ঘাটতি পূরণে অভিভাবকরা সন্তানের কথা বিবেচনা করে গৃহশিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এ ছাড়া সরকারি এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় অর্ধেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, এখনো দেশের ১৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘বাজারি’ বা ‘রেডিমেইড’ প্রশ্নে পরীক্ষা নিচ্ছে। ২৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করেন অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায়।

উল্লেখ্য, ২০০৮ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে সংগৃহীত প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়া নিষিদ্ধ করে মন্ত্রণালয় আদেশ দেয় ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!