• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা-প্রশাসক নোমান রশীদের কবিতা-ভাবনা


ড. ফজলুল হক সৈকত সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৬, ০৬:৪৫ পিএম
শিক্ষা-প্রশাসক নোমান রশীদের কবিতা-ভাবনা

রাত্রি তুমি জেগে থেকে চন্দ্রপ্রহরে
কলঙ্কের কালিমা রাঙিয়ে সর্বাঙ্গে আমার
জ্বালালে উত্তাপ সারারাত।
চাঁদের কলঙ্ক ছাপ সেই থেকে
থেকে গেলো একান্তে আমার।
-নোমান রশীদ

নোমান রশীদ পেশায় অধ্যাপক। ভাবে ও ভাবনায় কবি এবং গবেষক। কবিতার পথে তাঁর যাত্রা সেই কৈশোর থেকে। যতদূর জানা যায়, ১৯৬৪ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় লিখেছেন প্রথম কবিতা। প্রফেসর নোমানের বেড়ে ওঠার কালটা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে সত্তর দশকের মধ্যপাদ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে যে সব ঘটনা ঘটেছে, তা কোনো কোনো দেশে গোটা এক শতাব্দীতেও ঘটে না। ১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, এই সবকিছু ঘটেছে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রগতিতে; একটি জাতিকে প্রবলভাবে সচকিত, উদ্দীপিত সাহসদীপ্ত করে। 

সমাজচিন্তা এবং যুগচেতনা কবি ও সমালোচক নোমান রশীদকে প্রভাবিত করেছে, এটাই স্বাভাবিক। প্রথম যৌবনে, ১৯৭২ সালে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন তিনি। কবিতার সাথে তাঁর ভাব ও সংসার প্রায় ৫০ বছরের। কখনো প্রকাশ্যে কখনোবা অবচেতনে। অনেকদিন লেখার বিরতি থাকলেও কবিতা তাঁকে ছাড়েনি। চিন্তায় এবং কর্ম-পরিকল্পনায় তিনি কবিতাকে ধারণ করেছেন সবসময়। ক্লাসে পড়াতে গিয়ে এবং বিভিন্ন সময়ে আড্ডায় ও আলোচনায় তিনি কবিতা বিষয়ে নিজস্ব ও বিশ্লেষণী অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কবিতা সম্বন্ধে সমকালীন চিন্তা, ভাবনার ভিন্নতা, চিন্তার সংকট এবং অবশেষে প্রার্থিত মীমাংসা নিয়ে তিনি সাজিয়েছেন কথামালা। বর্তমান গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর সেইসব চিন্তার অভিনিবেশ। 

প্রফেসর নোমানের বিশ্লেষণের ভঙ্গি স্বতন্ত্র; ভাষাশৈলী প্রাতিস্বিক। তাঁর অভিলক্ষ্য অত্যন্ত স্পষ্ট এবং গভীর। কবিতাচিন্তার ও কবিতা আস্বাদনের লাবণ্যছাপ আছে গ্রন্থটিতে। একজন কবির ব্যক্তিগত কবিতাপাঠের আনন্দবর্ণনার সমান্তরালে যেন সংকলিত হয়ে রইল সমকালীন কবিতারও বিভাময় আলেখ্য। বর্তমান প্রজন্মের পাঠক-গবেষক যখন প্রায় মননশীলতাকে দূরে সরিয়ে রেখে পথ পারি দিচ্ছেন, এমন সময়ে নোমান রশীদের কবিতা-বিশ্লেষণসমৃদ্ধ এই গ্রন্থটি আমাদের জন্য নতুনতর প্রেরণার বিষয়। গ্রন্থটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গবেষক এবং আগ্রহী পাঠকের বিশেষভাবে কাজে লাগবে বলে আমি মনে করি।

নোমান রশীদের জন্ম ১৯৫৩ সালের ১১ জুন মুকুন্দদাস, জীবনানন্দ এবং শেরে বাংলার স্মৃতিধন্য বরিশালে। বাবা বিজ্ঞান-বিষয়ের দেশবরেণ্য শিক্ষক প্রফেসর মো. মোসলেম মিঞা, মা লতিফা খানুম। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে নদী, বৃক্ষরাজির মনোরম প্রতিবেশে বেড়েওঠা নোমান কবিতাচর্চায় হাত দেন কৈশোরকালে। বি এম কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময়ে, ১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই বের হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং ১৯৭৬ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবনে তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন।  

স্বদেশ, স্বাধীনতা আর প্রেম তাঁর লেখালেখির বিষয়-আশয়। নর-নারীর প্রেম আর দেশলগ্নতা নোমানের কবিতায় অত্যন্তউজ্জ্বল। কবিতা আর কবিতা-বিষয়ক নিবন্ধ তাঁর পরিভ্রমণের প্রধান ক্ষেত্র। ১৯৮০ সালে ২৯ অক্টোবর সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। ২০০৬ সালে তিনি প্রফেসর পদে যোগদান করেন। ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্তসরকারি কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্তমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সকল কার্যক্রমের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি।

শিক্ষানীতি বাস্তবায়নকল্পে গঠিত প্রকল্প ‘ডেভেলপ অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্র্যাটেজি অব দ্য ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ফর সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রজেক্ট’-এর পিডি’র দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ থেকে ২০১৩ শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক মাধ্যমিক স্তরের সকল স্কুল-মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার সফল অভিযানের অন্যতম ব্যক্তি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, মুক্তিযুদ্ধের দলিল ১৫ খণ্ড দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতরণ এবং দেশব্যাপি সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার স্থাপনের উদ্যোগ ও বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। 

প্রফেসর নোমান শিক্ষা ভবনকে অবকাঠামোগত দিক থেকে নতুন চেহারায় উন্নীত করেছেন; তিনি প্রথমবারের মতো শহীদ মিনার, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার, গ্রন্থাগার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ ম্যুরাল, ট্রেনিং স্টুডিও, গেইট ও মাউশির লোগো, মসজিদ প্রভৃতি স্থাপন, মাউশির ইতিহাস : অতীত ও বর্তমান গ্রন্থ প্রকাশ এবং জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন পোস্টার প্রকাশ ও প্রচার করেন। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার হিসেবে কর্মরত আছেন। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং অগ্রগতিতেও তিনি গতিশীল প্রশাসনের সাথে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। 

নোমান রশীদের প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ’: রাতদুপুরে আমার স্বদেশ, স্তনাগ্রচূড়ায় ধবল দ্যুতি, ঢেকে দেবো কোমলতা দেহলতা, আঙুলে আমার গোলাপ ফোটে এবং লিরিক-অ্যালবাম রাত্রি তুমি জেগে থাকো চন্দ্রপ্রহরে। স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস গবেষণা কাউন্সিল  প্রফেসর নোমানকে ২০১০ সালে ‘জাতীয় কবি নজরুল অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। এছাড়া তিনি বাংলাদেশের শিক্ষা-ব্যবস্থাপনায় বিশেষ অবদানের জন্য আমেরিকা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (অইঈঈও) (ইউএসএ) থেকে ২০১৪ সালে ‘ঊীপবষষবহপব অধিৎফ’ লাভ করেছেন। অধ্যাপক নোমান রশীদ আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলংকা ভ্রমণ করেছেন।

মুক্তির চেতনা লালন করেন কবি। গড়ে তোলেন ঐতিহ্য-ইতিহাসের নির্মল সিঁড়ি। ষাটের দশক। বাঙালি তরুণ-সমাজে স্বাধিকারের স্বপ্ন। চারদিকে হতাশা ও আশাবাদের দোলাচলতা। স্বাধীন বাংলাদেশের বাসনা দানা বেঁধে উঠছে। ৬৪ থেকে ৭১। গণজাগরণ-গণঅভ্যুত্থানের প্রবল কাল। সমকালীন রাজনীতি আর বিশ্বমানবতা কবিকে ভাবিয়েছে প্রতিনিয়ত। তদানীন্তন পাকিস্তানের ফাতেমা জিন্নাহ্ নির্বাচন থেকে শুরু করে ’৬৯-৭১-৭৫ সালে চলমান রাজনীতিতে সরল পদচারণা ছিল কিশোর নোমানের। 

তিনি সাজিয়েছেন মাটি, মানুষ, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কথামালা। নোমান মূলত সামাজিক দায়বোধের কবি। সাম্য, শান্তি, সাধনা আর নিরন্তর প্রেম-ভালোবাসায় অবগাহন করে চলেছেন তিনি। কখনো বন্ধুত্ব, কখনোবো আত্মীয়তা আবার কখনো প্রেয়সীর মুখ মনে রেখে তিনি লিখেছেন শব্দ; গড়েছেন ছন্দের ঘর-বাড়ি ও বারান্দা। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে লেখা কবিতাগুলো স্থান পেয়েছে ‘রাতদুপুরে আমার স্বদেশ’ গ্রন্থে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর ১৯৭২ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। 

প্রথম প্রকাশের সময় গ্রন্থটির নাম ছিল ‘কতো ইতিহাস’। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ের দেশচেতনা এবং সমাজ ও প্রেমভাবনা এই কবিতাগুলোর বিষয়-আশয়। নাগরিক হৈ হুল্লোড় পাশ কাটিয়ে গহীন অরণ্যে ঘাসের ওপর যে প্রজাপতি বসে থাকে তার রঙিন পাখনায় শব্দ গেঁথে যিনি পৃথিবীকে শোনান হৃদয়াতলের গোপন কথা, তিনি কবি। কবি নোমান রশীদ এমন এক বিরলপ্রজ কবি। কোনো দ্বিধা-সংকোচ-দূরত্ব বা প্রচার-প্রশংসাহীনতা তাঁকে অন্তত বিপন্ন করে তোলেনি। মানসিক শক্তি, শিক্ষার বহর বা সৃজনভাবনার ঐতিহ্যিক ঔদার্য ও মাহাত্ম্যই বোধকরি এই কবিকে ভূমিকেন্দ্রিক চিন্তা-রোপন-উৎপাদন ও প্রকাশের সাহস যুগিয়েছে। 

শিল্প-সাহিত্যে রাজনীতি প্রবেশ করে জাতীয়তার হাত ধরে। পরে তা প্রসারিত হয় আন্তর্জাতিক পরিসরের প্রশস্ত প্রান্তরে। কালে কালে দেশে দেশে এমনটিই ঘটে আসছে। কিন্তু এই অভিযাত্রার অর্জন কতটুকু যদি এই চিন্তার খাতা টেবিলে নিয়ে বসি, তাহলে দেখবো খাতায় তেমন কিছুই লেখা হয়ে ওঠেনি। হয়তো বা শিল্পী-সাহিত্যিকের বেখেয়ালে, নয়তো সমাজ-রাষ্ট্র-কাঠামোর অবজ্ঞায়। সাহিত্যের সাফল্য আছে, শিল্পেরও। তবে তার ফলাফলটা প্রকাশ পায় ধীরে। রাজনীতি আর সমাজ চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তালে তাল মিলিয়ে।

সৃজন ভাবুকরা ওই দৌড়ে মাঝে মধ্যে মার খায় বটে! তবে অর্জনটা শেষপর্যন্তবোধহয় সামান্য থাকে না। মানবতার বিপর্যয়ের কালে কথা বলতে থাকে কবির কলম। লোভ-লালসা-ইমারত-দাপটে কাতর আর নির্বিকার-অবৈষয়িক-নেপথ্যচারীর সংসার-সহযাত্রা ও দাম্পত্য এই হলো আমাদের সর্বনেশে চলমান জীবনধারা। কবির কলম চলে ওই জীবনধারার সাথে তাল মিলিয়ে। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় কবি লিখেছেন- ‘১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে লেখা কবিতাগুলো স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর ১৯৭২ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। 

প্রথম প্রকাশের সময় গ্রন্থটির নাম ছিল ‘কতো ইতিহাস’। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ের দেশচেতনা এবং সমাজ ও প্রেমভাবনা এই কবিতাগুলোর বিষয়-আশয়। মিছিলে-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলাম তখন আমি। আবার এক তরুণীর প্রেমেও পড়েছিলাম সেই প্রথম যৌবনে। প্রেম আর সংগ্রাম আমার চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। নারীর প্রতি বুকে প্রেম নিয়ে আর মনে স্বদেশের বিপুল স্বপ্ন নিয়ে আমার তখনকার কবিতাযাত্রার সেই আবেগ-উত্তেজনা আজও মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। 

মুক্তিযুদ্ধে আমার দুই বন্ধু আলমগীর ও নজরুল শহীদ হলো। তখন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু ও সোনার বাংলা তখন আমাদের চেতনায়। প্রেম ও সংগ্রাম যৌবনের এই চিরন্তন দুই অনুষঙ্গ আমার কবিতাপ্রহরে ছিল সার্বক্ষণিক সঙ্গী। দীর্ঘদিন পর ওই সময়ের কবিতাগুলো পুনর্প্রকাশ করছি এই ভেবে যে, বর্তমানে আমাদের তরুণপ্রজন্মের কাছে হয়তো এগুলো কোনো প্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। আর হয়তো এইসবের ঐতিহাসিক মূল্যও রয়েছে। আমার প্রথম কথামালা, আমার অ আ ক খ, আমার চেতনায় বয়ে চলা নদীর কুলুধ্বনি, আমার অস্থি-মজ্জা, সবকিছু নিয়ে আমি হাজির হয়েছি কবিতাপাঠকের কাছে। আজ মনে পড়ছে, যেন কুয়াশার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে সে সব স্মৃতি, আমার মেজোভাই মামুন-উর-রশীদ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন আমার বন্ধু, কবি ও প্রখ্যাত সাংবাদিক, বর্তমানে কানাডা প্রবাসী ইকবাল হাসান। আর ব্লক করেছিলেন আমার প্রিয় মিলনদা। গ্রন্থটি প্রকাশে সার্বিক সহযোগিতা করেছিল বরিশাল যুবসংঘ। শুভেচ্ছা বিনিময় ছিল ১ টাকা। বরিশাল সদর রোডের নুরুল হক মোল্লার হক প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সফিউদ্দিন আহমেদ লিখে দিয়েছিলেন ভূমিকা। দীর্ঘদিন পর বইটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। কবিতার ভাষাভঙ্গি প্রথম প্রকাশের অনুরূপ রাখা হলো। কেবল বানান-সমতা আর প্রমিত বানানের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে।’ 

এই কবিতা-গ্রন্থের ‘কত ইতিহাস’ কবিতার অংশ-বিশেষ 
ষোলখানা পাঁজরের ভাজে-ভাজে
কত ইতিহাস লুকিয়ে
কতকটা ব্যথিতের কিছুটা
জীবন সংগ্রামের।
নীলকর, ইংরেজ শাসন, আইয়ুব-ইয়াহিয়া
ভরকে গেছে নব বধূর লজ্জার মতো
তাজমহলের চূড়ার ন্যায় বলিষ্ঠ শপথে।...
একে একে কৃষক-আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন,
গণ-অভ্যুত্থান
মুক্তির আন্দোলন বয়ে গেলো
জনমানবহীন পীচঢালা পথে
কতশত মাইল বেগে
তবুও এক একটি পাঁজর
হিমালয় পর্বতের ন্যায় দৃঢ় প্রত্যয় হয়ে 
রয়ে গেলো।

নোমান রশীদ কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন ১৯৭২ সালে। মফস্বল শহর বরিশালে তাঁর কবিতাচর্চার সূচনাকাল। তারপর পার করেছেন জীবনের নানান ধাপ। ঘুরেছেন প্রায় সারাদেশ এবং  পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত। কাব্য-ভাবনায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন প্রেরণা ও অভিজ্ঞতা। দীর্ঘ বিরতির পর কাব্যগ্রন্থ নিয়ে তিনি এবার হাজির হলেন পাঠকের কাছে। তাঁর লেখার সংখ্যা সামান্য হলেও কবিতার বাঙময় জীবনদর্শন অসামান্য। দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট ও নিঃসংশয়, পর্যবেক্ষণ তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ণ, প্রকাশ অনবদ্য ও মেদহীন। তাঁর কবিতার অন্তর্গত যাবতীয় বোধ দেশকালের সীমানাকে ডিঙিয়ে সকলের হয়ে উঠেছে।  

জীবনকে দেখবার নিজস্ব এক ভঙ্গি পাওয়া যায় নোমানের কবিতায়। নারীর প্রতি তীব্র অনুভব, প্রকৃতির সাথে নারীর রূপের ও রহস্যের সম্পর্কের সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। দেহজ প্রেমকে তিনি পরিহার করেননি; বরং শৈল্পিকভাবে পরিবেশন করেছেন। পাঠক অনায়াসে কবির অনুভব আর অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিতে পারেন নিজের নিজের জিজ্ঞাসাকে। স্তনাগ্রচূড়ায় ধবল দ্যুতি তাঁর একটি আলোকস্পর্শী কাব্য। এই গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘যৌবন ও নারী’। পাঠকের জন্য পুরো কবিতাটি এখানে তুলে দিচ্ছি। 

যৌবন ও নারী রমণ ও নদী
আর লাজ-শরমের সব মোহনীয়
ত্যাজী ও ক্ষ্যাপা আমি সে সময়
হয়ে যাই রমণে বিশ্বাসী।

ভীষণ আকারে গেঁয়ো কাণ্ডজ্ঞানহীন
মাতাল সভ্যতায় আমি হিংস্র নর
নাভীর কৌটো বেয়ে বেয়ে আরো খানিকটা 
চুয়ে নিচের জমিনে
কামনার মধুরস জমা করি টপাটপ।

আমার পাপসিক্ত এ হাত পিতা-মাতা 
প্রেমাকুল যুগলকে দেখে দেখে
হয়ে উঠি আদিম পিতামহ এবং
প্রথমত আগুন-পানির খেলায় মেতে উঠি
অন্য কিছু নয়।

আঙুলে আমার গোলাপ ফোটে কাব্যে আছে প্রকৃতি-প্রেম আর শিল্পের যাদু। নাগরিক হৈ হুল্লোড় পাশ কাটিয়ে গহীন অরণ্যে ঘাসের ওপর যে প্রজাপতি বসে থাকে তার রঙিন পাখনায় শব্দ গেঁথে যিনি পৃথিবীকে শোনান হৃদয়াতলের গোপন কথা, তিনি কবি। কবি নোমান রশীদ এমন এক বিরলপ্রজ কবি। কোনো দ্বিধা-সংকোচ-দূরত্ব বা প্রচার-প্রশংসাহীনতা তাঁকে অন্তত বিপন্ন করে তোলেনি। মানসিক শক্তি, শিক্ষার বহর বা সৃজনভাবনার ঐতিহ্যিক ঔদার্য ও মাহাত্ম্যই বোধকরি এই কবিকে ভূমিকেন্দ্রিক চিন্তা-রোপন-উৎপাদন ও প্রকাশের সাহস যুগিয়েছে। শিল্প-সাহিত্যে রাজনীতি প্রবেশ করে জাতীয়তার হাত ধরে। পরে তা প্রসারিত হয় আন্তর্জাতিক পরিসরের প্রশস্ত প্রান্তরে। 

কালে কালে দেশে দেশে এমনটিই ঘটে আসছে। কিন্তু এই অভিযাত্রার অর্জন কতটুকু যদি এই চিন্তার খাতা টেবিলে নিয়ে বসি, তাহলে দেখবো খাতায় তেমন কিছুই লেখা হয়ে ওঠেনি। হয়তো বা শিল্পী-সাহিত্যিকের বেখেয়ালে, নয়তো সমাজ-রাষ্ট্র-কাঠামোর অবজ্ঞায়। সাহিত্যের সাফল্য আছে, শিল্পেরও। তবে তার ফলাফলটা প্রকাশ পায় ধীরে। রাজনীতি আর সমাজ চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তালে তাল মিলিয়ে। সৃজন ভাবুকরা ওই দৌড়ে মাঝে মধ্যে মার খায় বটে! তবে অর্জনটা শেষপর্যন্ত বোধহয় সামান্য থাকে না। মানবতার বিপর্যয়ের কালে কথা বলতে থাকে কবির কলম। লোভ-লালসা-ইমারত-দাপটে কাতর আর নির্বিকার-অবৈষয়িক-নেপথ্যচারীর সংসার-সহযাত্রা ও দাম্পত্য এই হলো আমাদের সর্বনেশে চলমান জীবনধারা। কবির কলম চলে ওই জীবনধারার সাথে তাল মিলিয়ে। 

‘প্রেম’ কবিতায় নোমান লিখেছেন
বোধ হয় তখন আমার বয়স ছিলো ন’বছর
আমার মনে আছে।
কোনো এক সন্ধ্যায় টেবিলের বাতি নিভে যেতে
মনে পড়ে, অবাধ্য হাত গিয়েছিলো কোথায়?
সেই থেকে হাত আমার দারুণ বেসামাল।

মনে পড়ে টেবিলের বাতি নিভে যেতে
ভীরু হাত কী নিপুণ ছুঁয়ে ছিলো মাধবীর
ঢেঁড়স আঙুল 
মনে পড়ে শৈশবে কোনো এক সন্ধ্যায়
ঝড়ের দামাল ছেলে কানের কোঠরে মধু
ঢেলে বলেছিলো
মাধবী, এই তো সময় ভালোবাসার?
হাতের ভেতরে হাত ঘসে প্রতিজ্ঞা করার?

ঢেকে দেবো দেহলতা কোমলতা গ্রন্থের পাতায় পাতায় কবি সাজিয়েছেন রঙিন স্বপ্নমালা। কবিরা কবিতা লেখার আগেই মস্তিষ্কের নির্ঘন্টে প্রতিটি শব্দের ভাঁজ খুলে পরখ করে নেন সেই শব্দের সৌন্দর্য ও তাৎপর্য। মস্তিষ্কের সেই বিজনেই সেরে নেন ঘষামাজা, সম্পন্ন করেন একটি সম্পূর্ণ কবিতার অমোঘ খসড়া। অতঃপর যে কবিতা লিখিত হয়, সেটিই কবির নির্বাচিত কবিতা। কবি নোমান রশীদ প্রায় চারদশক ধরে পরিভ্রমণ করছেন কবিতার ভুবনে। বারবার নিজেকে নবায়ন করে নিয়েছেন। 

সাহসের সাথে কিছু কবিতা ফেলেও দিয়েছেন। সময়ের ভাঙচুরকে শিরোধার্য করে তিনি মেনে নিতে কুণ্ঠিত হননি যে তাঁর আরাধ্য মানুষ, সমাজ ও ভালোবাসা। জীবনের ও সমাজের নানামাত্রিক স্তরকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যক্ষ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা তাঁর কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ‘সে এক বিবর্ণ রাত’ কবিতায় কোনো এক অভিমানীর জন্য লিখি সাজিয়েছেন নিবিড় কথামালা-

যাবি যদি যা বিদায়ের ব্যথা সইবো আমি
সারা মাস নির্ঝঞ্ঝাট হৃদয়ের গ্রন্থিতে বেঁধে
অপরাধী তুই
অপরাধ যাই হোক ভাগাভাগি দুজনার

বস্তুত ভালোবাসা মায়াবাসে নেই বলে
হৃদয়ের সবগুলো শৃঙ্খল ভেঙে ফেল
বিফল যন্ত্রণা না পুষে ফাটিয়ে দে ব্লাস্ট করে
শান্তি নামবে অক্ষত রইবে বিবেক
যন্ত্রণারা ছুঁড়বে না হাত-পা

বেশ চুপি চুপি শোন সন্নিকট দেহ ঘেঁষে শোন
প্রায়শ জাগে স্বাদ ভালোবাসা গুঁজে দিতে
নিপুণ তুলিতে এঁকে দিতে বধূ লাজ অভিমানী তোকে
তুইতো অভিমানী বড়ো সহসাই বলে যাস
অপাত্রে স্নেহ
ভালোকথা শোনা যায় সে এক সৌখিন রাত
জলজ্ব্যান্ত তোর ইচ্ছারা জয়ী হতে
ঝলমলে শাড়ি, মেহেদি, তিসি তেলসৌরভে
দারুণ উল্লাসে ছিলি
    
অথচ সেদিন সারাটা রাত অভুক্ত আর অনিদ্রায় আমি
দাউ দাউ জ্বলছিলো আমার নি¯প্রভ নেউল

সে এক বিবর্ণ রাত
পুঞ্জ পুঞ্জ ব্যথা ক্লান্তি ধোঁয়া
দুঃসহ কালরাত।

রাত্রি তুমি জেগে থাকো চন্দ্রপ্রহরে কবি নোমান রশীদের লিরিক সমগ্র। কবির কাজ প্রসারিত কল্পনা, ছন্দ আর অলংকার নিয়ে। বাস্তবতাও আসে ভাবনায় বারান্দা ধরে ধরে। গীতিকবিতা বাঙালির প্রাণের ধারা থেকে প্রকাশিত এক বিরল ঝর্ণাধারা। জাপানি কবিতা ‘হাইকু’ কিংবা কোরিয়ার ‘সিজো’র মতো প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতি, রাগ-অনুরাগ নিয়ে কবি নোমান রশীদ বাগানের মতো সাজিয়ে তুলেছেন তাঁর লিরিক। ভাবনাগুলো কবির। আর আনন্দটুকু যেন পাঠকের। 

কখনো স্বদেশে, কখনো বিদেশে সুদূর আমেরিকায় বসে লিখেছেন এইসব লিরিক। অফিসের ব্যস্ততার ফাঁকে ছোট্ট ঘরে চায়ের চুমুকে চুমুকে কিংবা গাড়িতে বসে জ্যাম ও নির্মলতা পেরোতে পেরোতে তাঁর কলম কল্পনা থেকে, কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে এইসব লিরিক। মাথায় সভা-কমিটি, ফাইল অথবা জীবনের বিচিত্র জটিলতার ভেতর থেকে তিনি যা উপহার দিলেন পাঠককে তা সত্যিই আনন্দদায়ক ও জিজ্ঞাসাঘন। মূলত জীবনেরই কথামালা তুলে ধরেছেন এই লিরিক নির্মাতা। একটি লিরিক তুলে দিচ্ছি

বাহ! কাশফুলের প্রতি কেশরে কেশরে
জেগে থাকো তুমি ভালোবাসা বিনির্মাণে
জনান্তিক। 

কবিতা রচনার পাশাপাশি নোমান রশীদ লিখেছেন কবিতা-বিষয়ক প্রবন্ধও। তাঁর কবিতা কোন্দল ও মীমাংসা এই সময়ের সাহিত্য-সমালোচনা-সাহিত্যে এক নতুন সংযোজন। নোমান রশীদ পেশায় অধ্যাপক। ভাবে ও ভাবনায় কবি এবং গবেষক। কবিতার পথে তাঁর যাত্রা সেই কৈশোর থেকে। যতদূর জানা যায়, ১৯৬৪ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় লিখেছেন প্রথম কবিতা। প্রফেসর নোমানের বেড়ে ওঠার কালটা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে সত্তর দশকের মধ্যপাদ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে যে সব ঘটনা ঘটেছে, তা কোনো কোনো দেশে গোটা এক শতাব্দীতেও ঘটে না। 

১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই সবকিছু ঘটেছে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রগতিতে; একটি জাতিকে প্রবলভাবে সচকিত, উদ্দীপিত সাহসদীপ্ত করে। সমাজচিন্তা এবং যুগচেতনা কবি ও সমালোচক নোমান রশীদকে প্রভাবিত করেছে এটাই স্বাভাবিক। কবিতার সাথে তাঁর ভাব ও সংসার প্রায় ৫০ বছরের। কখনো প্রকাশ্যে কখনোবা অবচেতনে। অনেকদিন লেখার বিরতি থাকলেও কবিতা তাঁকে ছাড়েনি। চিন্তায় এবং কর্ম-পরিকল্পনায় তিনি কবিতাকে ধারণ করেছেন সবসময়। ক্লাসে পড়াতে গিয়ে এবং বিভিন্ন সময়ে আড্ডায় ও আলোচনায় তিনি কবিতা বিষয়ে নিজস্ব ও বিশ্লেষণী অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কবিতা সম্বন্ধে সমকালীন চিন্তা ভাবনার ভিন্নতা, চিন্তার সংকট এবং অবশেষে প্রার্থিত মীমাংসা নিয়ে তিনি সাজিয়েছেন কথামালা।

‘কবিতা কোন্দল ও মীমাংসা’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর সেইসব চিন্তার অভিনিবেশ। প্রফেসর নোমানের বিশ্লেষণের ভঙ্গি স্বতন্ত্র; ভাষাশৈলী প্রাতিস্বিক। তাঁর অভিলক্ষ্য অত্যন্তস্পষ্ট এবং গভীর। কবিতাচিন্তার ও কবিতা আস্বাদনের লাবণ্যছাপ আছে গ্রন্থটিতে। একজন কবির ব্যক্তিগত কবিতাপাঠের আনন্দবর্ণনার সমান্তরালে যেন সংকলিত হয়ে রইল সমকালীন কবিতারও বিভাময় আলেখ্য। 

প্রসঙ্গত, ‘কবিতা কোন্দল ও মীমাংসা’ গ্রন্থে লেখকের ভূমিকা থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করছি : ‘আমার বাবার মৃত্যুর পর তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে পুরনো চিঠিপত্র, কাগজের স্তুপ থেকে অবশেষে আবিষ্কার হলো আমার কবিতা-ভাবনা-বিষয়ক এইসব নিবন্ধ। আমি অবাক হয়েছি, আমার পিতা অতি যত্নে সন্তানের মতোই আগলে রেখেছেন আমার লেখাগুলো। এমনকি আমার লেখা এবং আমাকে লেখা প্রেমপত্রও পাওয়া গেছে তাঁর সংগ্রহশালায়। 

আজকে কেবল ভাবি, কত আধুনিক পিতা ছিলেন তিনি! আবক্ষা কালানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে রেখেছেন আমার এইসব নিবন্ধ। তিনি পরম স্নেহে কাগজের ভিড়ে তুলে না রাখলে কোনোদিনই আমি পেতাম না প্রায় ৫ দশককাল ধরে গেঁথেওঠা আমার কবিতা-ভাবনার ‘পাণ্ডুলিপি’। আমার পিতা সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর মোসলেম মিঞার এই সাহিত্যপ্রীতি ও জ্ঞানমগ্নতা আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করেছে।... আমার মা স্বপ্ন দেখতেন, বাবার মতো বড় হয়ে ছেলে তাঁর মস্ত বড় লেখক হবে।... কিন্তু, কখন, কবে আমি লেখালেখি থেকে দূরে সরে গেলাম, টের পাইনি। অধ্যাপনা জগতের বৃহৎ-কর্মভুবন আর বিপুল ব্যস্ততায় নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। 

কিন্তু চিন্তা আর বৈদগ্ধ্যের অন্তরালে আমার কবি-মন কেঁদে মরছিল প্রতিনিয়ত। সেই তাগিদ আর যন্ত্রণা থেকে আমি মুক্তি পাইনি একদিনের জন্যও। যার কঠিন-কোমল ফলশ্র“তি আজকের এই প্রকাশনা।’ গ্রন্থটিতে নির্মলেন্দু গুণের সুপরিচিত একটি কাব্যের আলোচনা-প্রসঙ্গে নোমান লিখেছেন, ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ স্বাধীনতাপূর্বকালে রচিত ও প্রকাশিত। এ যাবত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে এটি তার প্রথম প্রকাশনা। যা স্বাধীনতা পূর্ব ও উত্তরকালের পাঠকের কাছে জনপ্রিয় ও সমাদৃত। অদ্যাবধি বাংলাদেশ ও ভারতে এর সর্ব মোট চারটি সংস্করণ বেড়িয়েছে। 

জসীমউদ্দীনের পর এতো বেশি সংস্করণ আর কোনো কবির একটি কাব্যগ্রন্থের হয়েছে কি না আমার জানা নেই। একাত্তুর-পরবর্তী স্বাধীনতা আমাদের মন ও মননে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আমরা পরিবর্তিত হয়েছি। নির্মলেন্দু গুণ যে কবি ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ লেখার সময় এক অভাবনীয় পরিবেশের শিকার, ‘সংসার নেই’ ছন্নছাড়া ‘সবখানে মোর ঘর’ বলে দিনরাত যেখানে সেখানে অনায়াসে অতিবাহিত করতে পারেন; তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ‘বেপরোয়া’ ছিলেন। এ ছাড়াও পূর্ব-পাকিস্তানে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে একজন পরাধীন বাঙালি পরাধীনতার দুঃখ গ্লানি বুকে করে যে কাটাচ্ছিলেন আমাদেরই মতোন দিন (বর্তমানে অবশ্য তার অনেক পরিবর্তন এসেছে এমনকি দৈনন্দিন জীবন যাপন ও আচরণেও)। স্বাধীনতাত্তোরকালে ১৯৮১তে ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ আলোচনার কি প্রয়োজন পাঠকের মনে জাগতে পারে? জাগাটাই স্বাভাবিক। 

‘সূচীপত্র’ প্রকাশনীর আয়োজনে ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ রোজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়েছে কবি-গবেষক নোমান রশীদের ৬টি প্রন্থের প্রকাশনা উৎসব ‘অঞ্জলি লহ মোর...’। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় মন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন দেশবরেণ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ। 

ড. হারুন অর রশিদ বলেন ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের ইতিহাসের সাথে কবি ও গবেষক নোমান রশীদের সম্পর্ক খুব নিবিড়। তিনি রাজনীতি সচেতন লেখক। স্বাদেশিকতার চেতনায় নোমান রশীদের কবিতা ও সাহিত্য-সমালোচনা সময়ের পরিক্রমায় ইতিহাস হয়ে থাকবে।’ 

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘শিক্ষা-ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষা-প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকেও কবি নোমান রশীদ যে সৃজনশীলতা এবং গবেষক নোমান রশীদ যে মননশীলতার প্রমাণ রেখেছেন, তা আমাদের শিক্ষক-সমাজের জন্য প্রেরণার বিষয়।’ 

অনুষ্ঠানে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে নোমান রশীদ বলেন, ‘কবিতার গীতলতা এবং কাঠামো-ভাবনা আমাকে নিরন্তর তাগাদা দেয়। নিজের কল্পনা ও চিন্তাগুলো প্রকাশ করেছি ওই তাগিদ আর দায়বোধ থেকে। আমার বাবার অসীম প্রেরণা আর সহযোগিতায় লেখক হতে পেরেছি। আত্মীয়-পরিজন আর শুভাকাক্সক্ষীদের কথাও স্মরণ করছি এই প্রসঙ্গে।’ 
দার্শনিক কবি নোমান রশীদের সাধ হয়তো অশেষ। কিন্তু সাধ্য তাঁর সীমিত। তবে, সাধ অনুযায়ী সাধনায় কোনো কার্পণ্য বা আলস্য তাঁকে কখনো স্পর্শ করেনি। 

শিক্ষা-প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে বিগত প্রায় ৮ বছর ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও তিনি কবিতার শোভা ও সৌন্দর্যকে ছাড়েননি এক মুহূর্তের জন্যও। আসা-যাওয়ার পথে সময়-সুযোগ পেলেই ‘টঙে-চা-খাওয়া’ এই সদা-হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি আপাদমস্তক কবি। তাঁর ভেতরে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির কোলে লালিত শিশুর সরলতা। বুদ্ধি এবং বাহুবল নয়, উদ্যম ও মনোবল নোমান রশীদের সব কাজ ও চিন্তার প্রধান আশ্রয়। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!