• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিরোনামহীনের ভ্রমনবৃত্তান্ত এবং কিছু আবেগঘন অভিজ্ঞতা


মিতুল আহমেদ নভেম্বর ২৫, ২০১৬, ০৬:৫৯ পিএম
শিরোনামহীনের ভ্রমনবৃত্তান্ত এবং কিছু আবেগঘন অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যান্ডদলগুলোর একটি। গানের লিরিক, মিউজিক আর গায়কীর জন্য বাংলাদেশেতো বটেই সমস্ত বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় তারা। শুধু তাই না, সাইকেডেলিক মিউজিকের জন্য ভিনদেশি শ্রোতাদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা আছে তাদের। জনপ্রিয় এই গানের দলটি সম্প্রতি একটি কনসার্টে অংশ নিতে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়া। দেশে ফিরেছেন ১৮ নভেম্বর। সেখান থেকে ফিরে মিষ্টি মধুর অভিজ্ঞতার গল্প শোনালেন শিরোনামহীন-এর প্রতিষ্ঠাতা ও বেইজ গিটারিস্ট জিয়াউর রহমান(জিয়া)...

দীর্ঘদিন পর দেশের বাইরে কনসার্টে অংশ নিল শিরোনামহীন। সেখানের অভিজ্ঞতা আর দেশে ফেরার কথা জানতে চাইলে জিয়া বলেন, মিশ্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছি আমরা সবাই। বিশাল আয়োজন ছিল ইউনিভার্সিটি অব মালায়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এক হাজার একরের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেখানে বাংলাদেশের প্রচুর ছাত্র। শুধু এই ইউনিভার্সিটির নয়, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের অসংখ্য ছাত্র আছে।এই কনসার্টকে কেন্দ্র করে সবাই তারা এক হয়েছিল।

প্রফেশনাল ইভেন্ট-এর মানুষদের সাথে মিশে সবাই মিলে ‘বাংলাদেশি স্টুডেন্ট অব মালয়েশিয়া’ নামের সংঘটনটি এই কনসার্টের আয়োজনে ছিল। তারাই মূলত আমাদের সাথে যোগযোগ করেছে। শিরোনামহীনকে নিতে তারা গত তিন বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু চাইলেইতো আর যাওয়া যায় না, আর তারাও নিতে পারে না। কারণ ওইখানে একটা কনসার্ট আয়োজন মানে প্রচুর টাকা পয়সার বিষয়। আয়োজনের খরচ, আমাদের রিমুনারেশন, যাতায়াত খরচ সব মিলিয়ে প্রচুর অর্থের দরকার।

আর তাদের ওইখানে শিরোনামহীনকে নিতে কে এতো বাজেটের স্পন্সর করবে? যদি বাংলাদেশ প্রবাসি কোনো বিজনেসম্যান না দাঁড়ায় তাহলেতো সম্ভব না বিশাল কোনো কনসার্ট আয়োজনের। তার উপর শুধুমাত্র একটা কনসার্টের জন্য! বিদেশে সাধারণত দেখা যায় একাধিক বা অন্তত চার পাঁচটা কনসার্টে একটা দলকে অংশ নিতে। ফলে এতে প্রতিটা ইভেন্ট আয়োজকদের খরচটা কমে যায়। আমাদের নিতে যে ব্যয়টা হতো তা ভাগাভাগি হতো। আর আমাদেরওতো কিছু করার নেই।ফলে ১০ তারিখ রাতে গিয়ে বারো তারিখ একমাত্র কনসার্টে অংশ নিয়েছি।     

মালয়েশিয়ান শ্রোতা দর্শকের সামনে প্রথমবার। শিরোনামহীনের সাথে তাদের ক্যামিস্ট্রি কেমন ছিল জানতে চাইলে জিয়া আরো বলেন, মালয়েশিয়া আমাদের প্রচুর স্টুডেন্ট। না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। মালয়েশিয়ার এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পাবেন না যেখানে বাংলাদেশের প্রচুর স্টুডেন্ট নেই! এবং তারা প্রত্যেকেই অসম্ভব মেধাবী। তাদের বেশির ভাগই কম্পিউটার আর আইটি রিলেটেড পড়াশুনা করছে সেখানে।শুধু তাই না, তাদের অনেকেই সেখান থেকে গিয়ে বিভিন্ন দেশে জব করছে। এমনকি আমাদের যারা নিয়ে গেছে তাদের একজন(নামটা ভুলে গেছি) মাইক্রোসফটে পর্যন্ত কাজ করেছে।  

এখন তারা যতোই মেধাবী হোক, তাদেরতো এক ধরনের ক্রাইসিস আছে। যেহেতু দেশ ছেড়ে মা, বাবা, আত্মীয়, স্বজন কিংবা প্রিয় মানুষটির সঙ্গ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে লেখা পড়া করছে তারা। ফলে তাদের মধ্যেতো অনেকেই হোম সিক বা লোননি ফিল করে। মিস করে দেশকে, দেশের মানুষগুলোকে। হয়তো সেসময়ই তারা গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠে শিরোনামহীনের কোনো গান! আসলে গত পাঁচ ছ’বছর ধরে তারা সবাই মিলে একটা কমিউনিটি তৈরি করেছে। আর এমন লোনলি ফিল করা কমিউনিটির তরুণদের উদ্দেশেই মালয়েশিয়া গিয়ে শিরোনামহীন গাইলো। এটা অদ্ভুত এক অনুভূতি।বলে বোঝানো যাবে না।  

শিরোনামহীনের সাথে ক্যামেস্ট্রির কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয়, দেশের ভেতর যখন কোনো ইউনিভার্সিটি বা অপেন কনসার্টে আমরা গাই। তখন আমাদের সাথে সব শ্রেণির দর্শকরা যেভাবে তাল মেলান, আমাদের গান গেয়ে ফেলেন সেরকমই ব্যাপারটা। বিশাল অডিটোরিয়ামে দূর দেশে হাজারো তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের সাথে পরিচিত ভঙ্গিতে গভীর ভালোবাসায় শিরোনামহীনের গান গাইছে, এটা অন্যরকম ফিল এনে দেয়।   

শ্রোতা দর্শক কি শুধু বাঙালিই ছিল নাকি বিদেশিও ছিল জানতে চাইলে দেশের অন্যতম এই বেজ গিটারিস্ট জানান, শুধু বাঙালি নয়। কনসার্টে প্রচুর অবাঙালিও ছিল।মালয়েশিয়ানরা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের ছাত্র ছাত্রী আমাদের গানের সাথে তাল মিলিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ আমাদের সাথে সুর মিলানোর মেলানোর চেষ্টা করেছে।   

মালয়েশিয়া ট্যুরে কোনো মজার অভিজ্ঞতা বা স্মরণীয় কোনো অভিজ্ঞতা ঘটেছে কিনা জানতে চাইলে উৎসুক হয়ে উঠেন জিয়া। যেনো তিনি কিছুটা আবেগঘন হয়ে উঠেছেন। বললেন, ইংল্যান্ডের একটা ছেলে এসে আমাদের ‘হাসিমুখ’ গানটা গাচ্ছে। আমরাতো রীতিমত থ্। আমি বললাম এটা কিভাবে সম্ভব? তখন তার সাথে এবং তার বন্ধুদের সাথে কথা বলে জানা গেল, ছেলেটি কোনো কারনে বাংলাদেশকে দুর্দান্ত পছন্দ করে। শুধু তাই না, সে বাংলা ভাষা বলারও চেষ্টা করে। না পারলেও সে দুটো গান এরইমধ্যে গাইতে শিখে ফেলেছে। একটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’(আমাদের জাতীয় সংগীত) এবং অন্যটি ‘শিরোনামহীন’-এর হাসিমুখ।এমন তথ্য জানার পর আমরা সত্যিই বিস্মিত হয়ে পড়ি। এটা আমাদের জন্য কতোটা গর্বের আর স্মরণ রাখার মতো তার ব্যাখ্যায় আমি যাবো না।

আর মজার অভিজ্ঞতাও আছে। যেমন কনসার্ট শেষে আমরা ঘুরতে বের হইছি চারজন। তুহিন ভাই আর রাশেল যায় নাই আমাদের সাথে। মূলত সমস্যা হচ্ছে তুহিন ভাই স্টেজে লাফাইতে লাফাইতে পায়ে ব্যথা বানায়ে ফেলছে।তাকে আরেকজনের হাত ধরে ধরে বিদেশের অপরিচিত রাস্তায় চলাচল করতে হচ্ছে এই দৃশ্য বেশ হাস্যকর ছিল।

এছাড়া মালয়েশিয়ার রাস্তায় ঘুরতে গিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ হারিয়ে যাওয়ার কথাও সহাস্যে বলেন জিয়া। তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে করে জিয়া হাসতে হাসতে বলেন, আমি হারায়ে গেসিলাম। আমার সাথে ওয়াইফ এবং মেয়ে ছিল। আমরা যেখানে ঘুরতে বের হই সেখান থেকে আমাদের হোটেলের দূরত্ব ২৭ মিনিটের পায়ে হাঁটে পথ।কিন্তু আমার মোবাইল অফ হয়ে গ্রেককার নিয়ে পড়ি মহা বিপদে। তারপর একটা লাল টেক্সি ডাকি। সে আমাকে নানা দিক ঘুরিয়ে ভিন্ন একটা জায়গায় নামায়ে দিলো। আমি আশেপাশে জিজ্ঞেস করি ‘জালানপুড়ো সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ট’কতো দূর। কিন্তু ওরা কেউ আমার ভাষা বুঝে না। আমিও তাদের ভাষা বুঝি না। আমি যারে ‘জালানপুড়ো’ বলতেছি তারা সেটারে ‘পুডো রায়া’ বলতেছে। তারপর একজনকে রিকুয়েস্ট করে ফোনে চার্জ দিয়ে কোনো রকমে উদ্ধার পাই । আসলে বিদেশের মাটিতে ফোন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

মালয়েশিয়ার অসাধারণ অভিজ্ঞতা শোনার পর বর্তমান শিরোনামহীন-এর কাজ ও ব্যস্ততা সম্পর্কে জানতে চাইলে জিয়া জানান, এখন কিছু করতেছি না। কনসার্ট করছি আর ঘুমাচ্ছি। কালকেও(২৪ নভেম্বর) আমাদের কনসার্ট ছিল বুয়েটে। আগামীকাল(২৬ নভেম্বর) ঢাকা ইউনিভার্সিটি। বিকাল তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে থাকবো। ৩০ তারিখে আছে বেইল রোড, এটি প্রাণের কনসার্ট। ১ তারিখে চ্যানেল আইয়ের ‘ব্যান্ড মেলা’তে থাকবো। এছাড়া ৩, ৭ এবং ৯ তারিখেও কনসার্ট আছে আমাদের।

শিরোনামহীনতো নতুন গান করছেই না। তাহলে শ্রোতারা কি আর শুনবে না শিরোনামহীনের নতুন সৃষ্টি এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়া বলেন, নতুন গান কিভাবে শুনবে? সেই প্লাটফর্মই তো নাই। যেগুলো আছে বিভিন্ন ফোন কোম্পানি এরাতো কাউকে কিছুই দেয় না।  আর শিল্পীরাতো প্লাটফর্ম বানাবেও না। তাহলে আমি যে একটা নতুন গান তৈরি করবো, সেটা কিভাবে সম্ভব? আমারতো পারিশ্রমিকটা পেতে হবে। গান নামাইতেতো পয়সা খরচ হয়, নাকি?

নতুন গান শোনতে না পারার জন্য শ্রোতারাও কম দায়ি নয় জানিয়ে এই মিউজিশিয়ান বলেন, একটা লোকও নাই যে সে ফ্রিতে গান শুনতে চায় না আমাদের দেশে। আসলে মানুষ আন-অ্যাওয়ার। শিক্ষিত না।  একটা সময় ছিল দোকান থেকে ফিতার ক্যাসেট কিনে সেটা টেপ রেকর্ডে নিয়ে বাজাতো। এরপর আসলো পাইরেসির সময়, সেসময়ও দোকানে গিয়ে মোবাইল ফোনে অসংখ্য গান ভরে নিয়ে আসতো। দোকানদার তার ইচ্ছা মতো গান ভরে দিত। মানে দোকানদার একজন শ্রোতার যোগান দাতা! গান নিয়ে মানুষর কোনো সচেতনতাই নাই।   

মূলত ফ্রি’র রেজাল্ট হচ্ছে  এটাই যে, আর কোনো নতুন গান তৈরি হবে না। দিন দিন পুরনো গানগুলোইা চলবে। এই বিশ্বে কিছুই ফ্রি নাই, শুধু গান ছাড়া। ফলে আমাদের সৃষ্টি হচ্ছে না আর কিছুই। এইটা কিন্তু শুধু বাংলাদেশের সমস্যা না। গ্লোভাল সমস্যা। পার্থক্য শুধু ওরা শিক্ষিত, আর আমরা তা না। উন্নত দেশগুলোতেও পাইরেসি ছয়লাভ করে গেছে। কিন্তু কখনোই তার আঁচ একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে পাইতে দেয়া হয় না। সৃষ্টিশীল মানুষের কদর অন্যরা বুঝেন, কিন্তু আমরা বুঝি না। আর এইজন্যইতো লাকী আখন্দের মতো একজন শিল্পীর জন্য আমাদেরকে গান গেয়ে রীতিমত ভিক্ষা করে টাকা তুলতে হয়। এটা সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য লজ্জা।

তাও লাকী ভাই ভোকাল ছিলেন বলে এটা সম্ভব হয়েছে। এদেশে ভোকালদের মানুষ চেনে। কিন্তু ধরেন লাকী ভাইয়ের সাথে আর আর যে মিউজিশিয়ানরা আছে তাদের এমন হলে কি কেউ টাকা দিতো? বা তার সাহায্যে এরকম সাড়া দিতো। এইদিক থেকেতো জিয়াউর রহমান জিয়াও একটা তুচ্ছ ঘটনা। আমার কিছু হলে কেউ কি এগিয়ে আসবে? শ্রোতারা আমাকে কি দিয়েছে? ফলে এইজন্য তাদের প্রতি আমার কোনো দায় নেই।

একজন মিউজিশিয়ানের এমনতর পাল্টা প্রশ্নে নীরবতা পালন ছাড়া আর কোনো কথাই বলা যায় না আসলে। থাকেও না। তো হে শ্রোতা! চলুন আমরা নীরবতা পালন করি। নতুন কিছু সৃষ্টির স্বাদ নেয়ার আমাদের প্রয়োজন নেই...

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিএল  

Wordbridge School
Link copied!