• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পীদের শিল্পী ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ৯, ২০১৬, ০৮:৪৫ পিএম
শিল্পীদের শিল্পী ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’

ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে একটু একটু করে জ্বলে ওঠা রেনেসাঁর আলোকে যিনি সর্বশক্তি দিয়ে তুলে ধরেছেন তার শিল্প প্রচেষ্টা| তিনি হলেন শিল্পীদের শিল্পী ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’।

বহুবিচিত্র প্রতিভার অধিকারী, শ্রেষ্ঠ শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জন্ম মধ্যযুগের ইউরোপের সুইডেনে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, স্থপতি, যন্ত্রকৌশলী ও আবিষ্কারক, লেখক-দার্শনিক, ভূগোল ও ভূতত্ত্ববিশারদ, শারীরতাত্ত্বিক, গণিতজ্ঞ, উদ্ভিদবিদ, সঙ্গীতবিদ, সাজসজ্জা বিশারদ- কোন্ বিষয়ে পন্ডিত ছিলেন না লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি! 

সৃষ্টিশীল মানসিকতা আর কোন কিছু তৈরি করার আগে অনেক অনেক সময় নেওয়ার জন্য তাঁর ছবির সংখ্যা মাত্র ১৫টির মতো। ১৫টি চিত্রের কয়েকটি আবার অসম্পূর্ণ। (সেন্ট জেরোম ইন ওয়াইল্ডারনেস, অ্যাডোরেশন অব দ্য ম্যাজাই, দ্য ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট অ্যানা অ্যান্ড সেন্ট জন ব্যাপ্টিস্ট, ১৪৯৯-১৫০০) । কোনটি আবার হারিয়ে গেছে সময়ের অতলে। (ব্যাটল অফ অ্যাঙ্ঘিয়েরি, পিটার পল রুবেল, ১৫০৫, মেডুসা, শিল্পী কারাভাজ্জিও, ১৫৯৭)। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য প্রস্তুতিমূলক ড্রইংও।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র আঁকা প্রথম ছবি হিসেবে আমরা পাই একটি ল্যান্ডস্ক্যাপ বা ভূ-দৃশ্যকল্প। মাতৃভূমির এই অদ্ভুত ভূমি গঠন তার জীবনে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে। তবে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পৃথিবীর সেরা চিত্রকর্ম হচ্ছে ‘মোনালিসা’। তিনি ‘মোনালিসা’য় একই সঙ্গে প্রকৃতি ও নারীর চিরন্তন রহস্য ও আবেদনময় এ চিত্র তাকে অমরতা দিয়েছে পৃথিবীর বুকে। তাই পাঁচশ’ বছর পর আজও এ চিত্রকর্ম নিয়ে উৎসাহ-আবেগের শেষ নেই। 

এছাড়া তার নোটবুক চিত্রশিল্প জগতে এক বিস্ময়ের নাম। ১ হাজার ৫৬৫ পৃষ্ঠার বইটিতে রয়েছে অজস্র ড্রইং। আয়নাতে ধরলে লেখা যেমন উল্টো হয়ে যায়, ঠিক সেরকম করে বাঁ-হাতে ডানদিক থেকে বাঁ-দিকে লিখতেন হরফগুলো। যখন যা-ই ভেবেছেন, তা লিখে রেখেছেন। লেখাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সাধ্যমতো এঁকেছেন।

সে যুগের বিখ্যাত শিল্পী ভেরোচ্চিওর দীক্ষা নেন তিনি। লিওনার্দোর আঁকার হাত দেখে ভেরোচ্চিত্ত এতটাই বিস্মিত হয়েছিলেন যে, পণ করলেন এ জীবনে ছবি আঁকার জন্য তিনি আর তুলিই ধরবেন না। লিওনার্দোর ওপর ফরমায়েশি ছবির দায়িত্ব দিয়ে অন্য কাজ করতেন তিনি। ভেরোচ্চিওর স্টুডিওতে তার অসমাপ্ত কয়েকটি ছবিতে হাত চালিয়েছেন লিওনার্দো। গুরুর টোবিয়াস অ্যান্ড দ্য অ্যাঞ্জেল ছবিতে, বিশেষ করে স্বর্গীয় দূতের হাতে-ধরা মাছটি তাঁরই কীর্তি। পটভূমির অনেকটাই তার আঁকা। ছবি আঁকার ব্যাপারে পিরামিড বা ত্রিভুজ-আকারকেই (ম্যাডোনা অ্যান্ড দ্য চাইল্ড উইথ সেন্ট অ্যানা, ভার্জিন অব দ্য রকস-এর দুটি সংস্করণ ও বিভিন্ন প্রতিকৃতি) প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি করে। গ্রীক দেবতা বাক্কাস ও সন্ত জন ব্যাপ্টিস্টের পবিত্র প্রতিকৃতি এঁকেছেন কামনাময় করে।

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র শিল্পী জীবনের আয়ের উৎস ছিল বিত্তবানদের স্ত্রীর প্রতিকৃতি অঙ্কন। (এখানে সাল ধরে ধরে ছবির নাম উল্লেখ করা হবে। লা জিওকান্ডো বা মোনালিসা, জেনেভ্রা দ্য বেঞ্চি, লেডি উইথ এন এরমাইন, একজন সঙ্গীতজ্ঞের মুখাকৃতি, লা বেলে ফেরোনায়ার, মোনা লিসা, (বিতর্কিত)- প্রোফাইল অব এ ইয়ং ফিঁয়াসে) তিনি সিলিংয়ের ছবি এঁকেছেন। (সফরজাদের প্রশাসনিক কক্ষে ফ্রেস্কো, ১৪৯৮-৯৯)। শিশু যিশুখ্রিস্ট ও কুমারী মাতাকে নিয়ে এঁকেছেন বেশকিছু ছবি। (বেনুইস ম্যাডোনা, ম্যাডোনা অব দ্য কারনেশন, ম্যাডোনা লিটা, (বিতর্কিত)- ম্যাডোনা অব দ্য ইয়ার্ন উন্ডার, দ্য ড্রেইফাস ম্যাডোনা)।

সান্তা মারিয়া দেলা গির্জার দেয়ালে আঁকা তার বিখ্যাত শিল্পকর্মটির নাম ‘দ্য লাস্ট সাপার’। মুখভঙ্গির আবেগময় প্রতিচ্ছবি আর জ্যামিতিক সুষমায় উজ্জ্বল নমুনা ‘দ্য লাস্ট সাপার’ বা যিশুর শেষ-ভোজ ছবিটি। যিশুখ্রিস্ট প্রধান চরিত্র। তাই ছবির কেন্দ্রবিন্দুতেও তিনি। তার দু’পাশের ১২ জন অনুরাগী-শিষ্যও সমান দু’ভাগে ভাগ করা। প্রত্যেক পাশে ভক্তের সংখ্যা ৬।

তিনি একজন শারীরবিজ্ঞানী। মানুষ ও জন্তুর শরীর নিখুঁতভাবে আঁকার জন্য শল্যচিকিৎসকের কাছে গেছেন। ফাঁসিতে টাঙানো আসামির বিকৃত মুখ পর্যবেক্ষণ করেছেন; এমনকি মানুষের শবদেহ পর্যন্ত কেটেকুটে দেখেছেন ভেতরকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো। তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানীও। পুরুষ ও স্ত্রী-উদ্ভিদের ব্যবধান তিনিই প্রথম নির্ণয় করেন।

প্রযুক্তিবিদ ভিঞ্চি নিজে থেকে অঙ্কন করেন ফিল্ড ব্রিজ, ডুবোজাহাজ, পানি সরবারাহের যন্ত্রপাতি, প্যারামূট, গ্লইডার, হেলিকপ্টার, কামান, বিভিন্ন রকম বিরাটাকার যুদ্ধযান ও যুদ্ধাস্ত্র। এ ছাড়াও সহজে বহন ও স্থাপনযোগ্য সেতু, ডুবোজাহাজ, ক্যালকুলেটর, এমনকি রোবট গড়বারও পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু সেকালের শাসকগোষ্ঠী তার প্রতিভাকে মূল্যায়ন করতে পারেনি বলে এগুলোর প্রায় কিছুই বাস্তবের মুখ দেখেনি। কারণ তিনি তার সময়ের থেকেও পাঁচশ’ বছর এগিয়ে ছিলেন। তিনি স্থপতিবিদও। চতুর্ভুজ ও অষ্টকোণবিশিষ্ট ভিত্তি থেকে গম্বুজ তৈরির সমস্যা নিয়ে তিনি অসংখ্য ড্রইং অঙ্কন করেন। এ ছাড়া তার অঙ্কিত ইমোলা-নগরীর মানচিত্রও শিল্পরসিকদের কাছে বিস্ময়ের এক নাম।

গুরু ভোরোচ্চিত্ত আর ডেনটেল্লোর দুটি ঘোড়াকে আঁটিয়ে দেওয়া যাবে, এমন বিরাট এক ব্রঞ্জের ঘোড়া গড়ার কাজ ধরেন এক সময়ে। ১২ বছর লাগিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মাটি দিয়ে তৈরি করলেন সেটি। মিলানে যুদ্ধের ডামাঢোল বেজে উঠলে অশ্বমূর্তির জন্য রবাদ্দকৃত ব্রঞ্জ চলে যায় শাসকের যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কাজে। কিন্তু এ ভাস্কর্য আর আলোর মুখ দেখেনি। (অশ্বমূর্তির অনুমানকৃত প্রতিকৃতিগুলোর ছবি)। ঘোড়ার অ্যানাটমি-বিষয়ক একটা বই লেখার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। নবীনদের জন্য লিখেছেন চিত্রকলার ওপর বই। পশুপাখির চরিত্র দিয়ে লিখেছেন রূপক-নীতিগল্প।

গণিত নিয়েও তার আগ্রহের শেষ নেই। সে যুগের বিখ্যাত গণিতবিদ লুকা পাচ্চিওলির বইতেও অঙ্কন করেছেন। এটি ছাপাখানায় মুদ্রিত তার প্রথম ছবি। (দি ডিভাইনা প্রপোরশনেট, ১৪৯৭)। এত প্রতিকৃতি যিনি এঁকেছেন, তার নিজেরটি কিন্তু আমাদের কাছে খুব একটা রেখে যাননি। সবচেয়ে পরিচিত আত্মপ্রতিকৃতিটি তার শেষ জীবনের আঁকা। চিত্রশিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আত্মপ্রতিকৃতিতে তার প্রাজ্ঞ মুখাবয়ব আর অভিজ্ঞ শিল্পীসত্তার ছাপ মেলে। তার আরও দুটি প্রতিকৃতির দেখা মেলে। তবে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আত্মপ্রতিকৃতি আঁকায় নিজে নিরুৎসাহী হলেও সহকর্মী কিংবা অনুরাগীরা থেমে নেই। তারই সময়কার কয়েকজন শিল্পী তা এঁকেছেন মমতা দিয়ে। (ফ্রান্সিসকো বত্তিচেন্নি ও আনামা তুস্কান শিল্পী)। এ ছাড়াও তার বালক-বয়সের মুখাকৃতি অঙ্কন করেছেন গুরু ভেরোচ্চিও নিজেই। তার গড়া ডেভিড ভাস্কর্যে মডেল হিসেবে রেখেছিলেন নিষ্পাপ চেহারার ভিঞ্চিকে। এক সুইডিশ চিত্রকরের আঁকা প্রতিকৃতি ছাড়াও মিলান ও ফ্লোরেন্সে রয়েছে তার দুটি ভাস্কর্য। (এনগ্রেসের আঁকা লিওনার্দোর মৃত্যুদৃশ্য, ১৮১৮)।


 

Wordbridge School
Link copied!