• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুকে শালদুধ খাওয়াবেন যে কারণে


ডা. শাহীনুল হক রায়হান জুলাই ৩০, ২০১৬, ০৬:৩০ পিএম
শিশুকে শালদুধ খাওয়াবেন যে কারণে

পাবলিক হেলথ্ গবেষক শিশুকে কি শালদুধ খাওয়ানো উচিত শালদুধের হলুদাভ রং এবং ঘনত্ব দেখে অনেকেই মনে করেন, এই দুধ হয়তো শিশু হজম করতে পারবে না। শিশু খুব ভালোভাবেই শালদুধ হজম করতে পারে এবং এ দুধে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ ও ডি এবং পরাগ প্রতিরোধের অনেক উপকরণ (এন্টিবডি) থাকে।
শালদুধ খাওয়ানোর জন্য মায়ের জরায়ুর সংকোচন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় এবং মা দ্রুত স্বাভাবিক স্বাস্থ্যে ফিরে আসেন। পৃথিবীর সব স্তন্যপায়ী প্রাণীই কিন্তু বাচ্চাকে শালদুধ খাওয়ায়- ফেলে দেয় না; মানুষের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার নয়।

কতক্ষণ পর পর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। শিশু খাবারের জন্য কান্না করলেই তাকে বুকের দুধ খেতে দেয়া উচিত- তা যত ঘনঘনই হোক না কেন। তবে শিশু জন্মের প্রথম কয়েক সপ্তাহ তাকে মোটামুটিভাবে এক ঘণ্টা পরপর বুকের দুধ খেতে দেয়া উচিত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর পাকস্থলী বড় হতে থাকে ও মায়ের বুকের দুধের পরিমাণও বাড়তে থাকে এবং শিশুকে একবার বুকের দুধ ভরপেট খাওয়ানোর পর আবার খাওয়ানোর বিরতির পরিমাণও বাড়তে থাকে- তবে এ বিরতি ২ ঘণ্টার বেশি হয় না। শিশু যদি অসুস্থ থাকে, তাহলে তার খাবারের চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই কমে যেতে পারে।

শিশু যথেষ্ট পরিমাণে বুকের দুধ পাচ্ছে কি না কীভাবে বুঝবেন সুস্থ-স্বাভাবিক শিশু সাধারণত যতক্ষণ ক্ষুধা থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত বুকের দুধ চুষতে থাকে। পেট ভরে গেলে দুধ চোষা বন্ধ করে দেয়। পেট ভরে গেলে শিশু ঘুমিয়ে পড়ে। শিশুর বয়স একটু বাড়লে পেট ভরার পরও দুধ ছাড়তে চায় না- দুধ মুখে নিয়েই ঘুমায় এবং দুধ সরাতে গেলেই আবার চুষতে থাকে; এটা শিশুর স্বাভাবিক ক্ষুধা নয়- এটা শিশুর একটা অভ্যাস যা প্রশ্রয় না দেয়াই ভালো। এতে শিশুর স্বাভাবিক ঘুম এবং হজমে সমস্যা হয়। মা ও শিশু সুস্থ-স্বাভাবিক থাকলে সাধারণত ১০-১৫ মিনিট (উভয় স্তনে) দুধ খাওয়ানোর পরই শিশুর পেট ভরে যায়।

বয়স অনুপাতে শিশুর ওজন ঠিক মতো বাড়ছে কি না- তাও লক্ষ্য করুন। শিশুকে বুকের দুধ কীভাবে খাওয়ানো উচিত শিশুকে মায়ের আসন পাতা কোলে শুইয়ে নিয়ে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। তার বুক এবং মাথা কোমর এবং পা থেকে কিছুটা উপরের দিকে তুলে তাকে দুধ খাওয়ানো উচিত; এতে শিশু স্বাভাবিকভাবে দুধ চুষতে এবং গিলতে পারে। বুকের দুধ পান করার সময় দুধের বোঁটা এবং বোঁটার চারপাশের কালো অংশের পুরোটাই যেন শিশুর মুখের ভেতরে যায়; এতে শিশু সহজে দুধ চুষতে এবং গিলতে পারে এবং তার পেটে বাতাস কম ঢোকে। জোর করে শিশুর মুখের ভেতর স্তনের বোঁটাসহ কালো অংশ ঢুকিয়ে দেয়া ঠিক হবে না।

বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় শিশুর পেটে কম-বেশি বাতাস ঢুকতে পারে এবং এ বাতাস বের না হলে শিশু অস্বস্তিতে ভোগে (যাকে অনেকেই পেট ফাঁপা বলেন) এবং এতে সে বমি করে দিতে পারে। তাই, দুধ খাওয়ানোর পর তাকে খাড়া করে মায়ের বুকের সঙ্গে লাগিয়ে তার পিঠে হাতের তালু দিয়ে হালকা করে থাপ্পড় (ট্যাপিং) দিতে দিতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে তার পেটের বাতাস পাকস্থলীর ওপরের দিকে উঠে আসে এবং শিশু ঢেকুর দিয়ে তা বের করে দেয়। এতে শিশু আরাম বোধ করে।

শিশুর জন্মের পর থেকে তাকে শুধু মায়ের বুকের দুধই খেতে দেয়া উচিত, অন্য কোনো খাবার নয়- এমনকি পানি, মধু বা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধও নয়। মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে অন্য খাবার কখন দেয়া উচিত অধিকাংশ বিশেষজ্ঞরাই শিশুর বয়স ৬ মাস হওয়া পর্যন্ত তাকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেন।

তবে এ নিয়ে কিছু ভিন্ন মতও আছে। অনেক বিশেষজ্ঞই ৬ মাসের পরিবর্তে শিশুকে ৪ মাস বয়স পার হওয়ার পর থেকেই নিরাপদ বিকল্প খাবারে অভ্যস্ত করানোর কথা বলেন। যারা ৬ মাসের পক্ষে বলেন, তাদের যুক্তি হল- একজন শিশু কমপক্ষে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে মায়ের বুকের দুধ পাওয়ার কথা-এর বাইরে শিশুর বিকল্প খাবারের কোনো দরকার নেই। যারা ৪ মাসের কথা বলেন, তাদের যুক্তি হল- সব মায়ের বুকেই শিশুর প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট পরিমাণে বুকের দুধ ৬ মাস পর্যন্ত সব সময় তৈরি হবে- এমন গ্যারান্টি দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে শিশুর পরিপূর্ণ পুষ্টির অভাব হওয়ার আশংকাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কাজেই শিশুর বয়স ৪ মাস হওয়ার পর থেকে তাকে পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ খাবারে অভ্যস্ত করালে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

যদি কোনো কারণে শিশু পরিপূর্ণ পুষ্টি হচ্ছে না বলে মনে হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তার বয়স ৬ মাস হওয়ার আগেও তাকে বাড়তি খাবার দেয়া যেতে পারে। কখনোই নিজের অনুমান, ইচ্ছা বা ‘অভিজ্ঞতা’র ওপর নির্ভর করে শিশুকে ৬ মাস বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে বাড়তি কোনো খাবার দেয়া উচিত হবে না।

শিশু যদি শুধু বুকের দুধের ওপর নির্ভরশীল থাকে, তাহলে তার বয়স ৬ মাস হওয়ার আগে তাকে বাড়তি কিছুই খাওয়ানো উচিত হবে না, এমনকি পানিও না। গরমে যদি শিশু বেশি ঘামে তাহলে তাকে ঘনঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। কারণ বুকের দুধের ভেতর যে পানি থাকে তা দিয়েই শিশুর পানিশূন্যতা পূরণ হয়। তবে শিশু যদি বাড়তি খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শিশুকে পরিচ্ছন্নভাবে এবং পরিমাণ মতো বাড়তি পানি খাওয়ানো যেতে পারেন।

মায়ের বুকে যদি যথেষ্ট পরিমাণে দুধ না আসে, তাহলে কী করতে হবে মা যদি পানি বা পানি জাতীয় খাবার কম খান, মায়ের মানসিক অবস্থা যদি শান্ত না থাকে, মা যদি শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকেন, মা যদি বিশেষ কোনো ওষুধ খান- তাহলে বুকের দুধ কমে যেতে পারে। বুকে দুধ কম আসলে মা যে কাজগুলো করতে পারেন তা হল- বেশি পরিমাণে পানি, শরবত এবং রসালো ফল থেকে হবে, শাকসবজিও বেশি খেতে হবে এবং যতটুকু সম্ভব মানসিক টেনশন মুক্ত হয়ে নির্জন পরিবেশে একনিষ্ঠভাবে শিশুকে বুকের দুধ।শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মা অন্যমনস্ক থাকলে দুধ খেতে শিশুর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না- সেটি তার নজরে আসে না।

শিশু যতদিন বুকের দুধ পান করে ততদিন পর্যন্ত মা যদি নিজে প্রতিদিন আধা লিটারের মতো দুধ পান করেন, তাহলে মায়ের বুকে শিশুর জন্য বেশি পরিমাণে এবং অধিক পুষ্টিকর দুধ তৈরিতে সহায়তা হয়। তাছাড়া ছোট মাছ, কচুশাক, কাঁচাকলা, কলার মোচা ও থোড়- ইত্যাদিতে বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং আয়রন থাকে বলে এগুলো খেলে স্তন্যদানকারী মায়ের নিজের স্বাস্থ্য যেমন ভালো থাকে তেমনি শিশুও যথেষ্ট পরিমাণে বুকের দুধ পেতে পারে। মা বিভিন্ন রকম দেশী ফল যেমন, বরই, আমলকী, আমড়া, বৈঁচি, পেয়ারা, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা ইত্যাদি ফল প্রতিদিন পরিমান মতো যদি খান তাহলে মা এবং বুকের দুধ পানকারী শিশু।

মনে রাখা দরকার, শিশুর জন্মের পর থেকেই মাকে বেশি করে সব ধরনের মাছ-মাংস, দুধ, শাকসবজি এবং ফল খাওয়ালে মায়ের স্বাস্থ্য যেমন ভালো থাকে, তেমনি শিশুর জন্য বেশি পরিমাণে বুকের দুধও উৎপন্ন হয়।

শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে কি মায়ের ‘ফিগার’ নষ্ট হয়ে যায় এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা হয়েছে বলে জানা যায়নি। শরীর বিজ্ঞানের মধ্যে এমন কোনো তথ্য নেই যা থেকে উপসংহার টানা যেতে পারে যে, শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের ‘ফিগার’ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!