• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিশুদের ঘরে ফিরতে দিন সম্মান আর মর্যাদা নিয়ে


নিয়ন মতিয়ুল আগস্ট ৪, ২০১৮, ০৫:৩৮ পিএম
শিশুদের ঘরে ফিরতে দিন সম্মান আর মর্যাদা নিয়ে

ঢাকা : ওরা কোমলমতি, নিষ্পাপ, অবুঝ। ওরা রাজনীতি বোঝে না, এখনও পড়েনি রাজনৈতিক দর্শন। ওরা সুন্দর একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছে। আগামীর স্বপ্নের বাংলাদেশ নির্মাণ করবে ওরাই। ওদের চোখেই আমরা দেখি আগামীর বিশ্ব। ওরাই আমাদের অবলম্বন, আমাদের স্বপ্নের আশ্রয়, বুকের ধন। তবে আমাদের স্বপ্ন সম্ভাবনাময় এই প্রজন্মের জন্য আমরা আজও নিশ্চিত করতে পারিনি একটা সুন্দর, নিষ্কলুষ সমাজ। দিতে পারিনি প্রতিদিনের নিরাপত্তা। সমাজের অন্ধকার নিয়ে প্রতিদিনের স্পর্শকাতর হাজারো প্রশ্নের উত্তর ওরা মেলাতে পারে না। তাই আজ যেন আমাদের ওপর ওদের বিশ্বাস হারিয়ে গেছে।

বেপরোয়া বাসচালক ওদের দুই বন্ধুকে রাস্তায় পিষে মেরেছে। রাগ- ক্ষোভ থেকে ওরা আজ পথে নেমেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে দেয়া গণপরিবহনের নৈরাজ্যের নিরসন চায় ওরা। নিরাপদে যেতে চায় স্কুলে, ফিরতেও চায় নিরাপদে। তাই পথে নেমে চিৎকার করছে, স্লোগান দিচ্ছে, প্ল্যাকার্ডে প্ল্যাকার্ডে আমাদের বার্তা দিয়ে যাচ্ছে-

# বি দ্যা চেঞ্জমেকার টুডে অর বি দ্য ভিকটিম টুমরো। (পরিবর্তনের এখনই সময়/এখন নয় তো কখনোই না)।

# আর কত লাশের বিনিময়ে শান্তি আসবে?

# আমরা ৯ টাকায় এক জিবি চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই।

# মা, ওরা বাস আর দেয়ালটার মাঝখানে আমার জন্য জায়গা রাখল না, মা তুমি আর অপেক্ষা করে থেকো না, আমি আর ফিরবো না।

# ওরা ভয়ানক, বেপরোয়া যানচালক/ ওরা আমাদের পিষে মারবে, ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দেবে/ উঠতে গিয়ে আহত হলে নদীতে ছুঁড়ে ফেলবে- কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।

# আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, সড়ক দুর্ঘটনার নামে গণহত্যা বন্ধ কর।

# আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে?

# দায়িত্বশীল মন্ত্রী চাই, শাজাহান খানকে ক্ষমা চাইতে হবে।

আমাদের শক্তি-সামর্থ, অঙ্গীকারের ওপর ওদের ভরসা বুঝি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এসেছে। ওরা বুঝতে পারছে, দুর্নীতি আর নিয়মভাঙাই আমাদের নিয়মে পরিণত হয়েছে। আমরা দিন দিন পরিণত হচ্ছি অসহিষ্ণু জাতিতে। আমাদের আবেগ, অনুভুতির ওপর হামলে পড়ছে রাজনৈতিক থাবা। ‘ভ্রষ্ট’ রাজনীতিকরা আমাদের নির্মল আবেগকে ব্যবহার করছে অস্ত্র হিসেবে। অন্যায় আর অনিয়মের বিরুদ্ধে আমাদের নিরপেক্ষ অবস্থানকে প্রতিনিয়তই প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে পক্ষ-প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক শক্তি।

রাজনীতিকরণের ফলে আমরা থমকে যাচ্ছি বার বার। এ চক্র থেকে বের হতে পারছি না। আমরা অসহায়। আর আমাদের এ অসহায়ত্ব হয়তো আজ বুঝতে পারছে ওরা। তাইতো আমাদের আশ্বস্ত করে ওরা বলছে, ‘আমরা যদি না জাগি মা ক্যামনে সকাল হবে?’

এতোদিন ভাবতাম ওরা রাজনীতির মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝে না। সারাদিন ইন্টারনেট আর ফেসবুকের ফ্যান্টাসিতে পড়ে আছে। ‘আই হেইট পলিটিক্স’- এমই দৃষ্টিভঙ্গি ওদের। কিন্তু সে ধারণা ভুল।

পুলিশের লাঠিচার্জে রক্তাক্ত হয়েও ওদের একজনকে চিৎকার করে বলতে শোনা গেছে, ‘আমাদের কোনো দোষ নেই। বরকত, রফিক, জব্বার, সালাম- আমাদের শিখিয়েছে রাজপথে নামতে। দোষ তাদের। বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রতিবাদ করতে বলেছেন, উনিই তো বলেছেন ছাত্রদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। আমরা রাস্তা ছাড়বো না। যতই পেটান।’

ওদের এই উপলব্ধি আমাদের আবেগি করে তোলে। চোখে জল এনে দেয়। আমরা ভুল বুঝেছি। এ জনপদের মানুষ আবহমান কাল ধরেই প্রতিবাদী। যুগ যুগ ধরে এরা বিপ্লবী। সংগ্রামের শক্তি এদের রক্তে রক্তে। বায়ান্ন থেকে একাত্তর- এরপর দেশের প্রতিটা সংকটে এমন চেতনার উন্মেষ আমরা দেখেছি। ওরা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে ধারণ করে, ওরা স্বাধীনতার মানে বোঝে। ওরা আত্মসম্মান বোঝে, বোঝে অসাম্প্রদায়িকতার মানে। ওরা ক্ষুদ্র নয়, ওর বাচ্চা নয়, ওরা আগামীর বাংলাদেশ, আমাদের অহংকার।

আমাদের জিডিপি বাড়ছে, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে গেছি। পারমাণবিক বিশ্বের সদস্য হয়েছি। সীমান্ত, সমুদ্র জয় করার পর মহাকাশও জয় করেছি। কিন্তু আজও কেন সড়কের নৈরাজ্য রোধ করতে পারিনি। কেন প্রতিদিনই প্রাণ হারাতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। এমন প্রশ্ন ওদের মনের মধ্যে প্রতিদিন ঘুরপাক খাচ্ছে। নিরূপায় হয়ে তাই ওরা পথে নেমে এসেছে। এদের মধ্যে কেউ স্কাউট, কেউ গার্লস গাইডও। যারা দেশের যেকোনো দুর্যোগে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। দেশ আর দেশের রাজনীতি নিয়ে ওরা কত চমৎকার বিতর্ক করে, স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচনে কত সুশৃঙ্খল। ওদের একদল বিক্ষুব্ধ বন্ধু অনিয়ন্ত্রিত আবেগ থেকে সড়কে গাড়ি ভাঙচুর করে গেছে। আরেকদল বন্ধু আন্দোলন শেষে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপজ্জনক কাঁচগুলো নিজ হাতে সরিয়ে মানুষের চলাচলের জন্য উপযুক্ত করে দিয়েছে। ওরা এদেশকে ভালোবাসে মমতা দিয়ে, উষ্ণতা দিয়ে। ওরা সারাদিন ফেসবুক, টুইটার আর ইন্টারনেটই শুধু করে না। ওরা প্রযুক্তি, খেলাধুলা, মেধায় সবকিছুতেই বিশ্বজয়ী। আমরা যা পরিনি ওরা তা করে দেখাবে। ওরাই আমাদের আগামীর বাংলাদেশ, সোনার ছেলে।

তবে ভয় এবং শঙ্কা একটাই, ইতোমধ্যে পক্ষ-বিপক্ষের রাজনৈতিক শক্তি হয়তো ওদের এ আবেগের সঙ্গে রাজনীতিকে মেলানোর চেষ্টা করছে। বিরোধীপক্ষ হয়তো এর মধ্যে সন্ধান করার চেষ্টা করছে সরকারবিরোধী আন্দোলন। আর সরকারও হয়তো এর মধ্যে বিরোধীদের ইন্ধনের মাত্রা খুঁজছে। পরাজিতশক্তি হয়তো ওদের নিষ্পাপ আবেগের মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দেবে। যারা কিনা আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়। আর তাদের প্রতিহত করতে কোনো শক্তির বলী হতে পারে আমাদের এই কোমলমতি শিশুরা। তাদের অরাজনৈতিক সুন্দর স্বপ্নকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে। তখন পরিস্থিতিটা হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহ। ভেঙে পড়তে পারে সামাজিক শৃঙ্খলা। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয়ে আমাদের ঘরের শিশুরা সম্মান আর মর্যাদা নিয়ে ঘরে ফিরে আসুক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!