• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
শোকাবহ ১৫ আগস্ট আজ

শোক নয়, শপথের দিন


নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ১৫, ২০১৭, ১২:০৮ এএম
শোক নয়, শপথের দিন

ঢাকা : ‘রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বাড়িটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমতো রক্তগঙ্গা বয়ে যায় বাড়িটিতে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু।

তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই তাঁর ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, টেলিফোন অপারেটর, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে রক্তাক্ত ৩২ নম্বর ধানমন্ডি রক্তগঙ্গা হয়ে প্লাবিত করে ৫৬ হাজার বর্গমাইল। সেই শোকে চার দশক ধরে কাঁদছে বাঙালি। কবি রবীন্দ্র গোপের ‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো’ কবিতার মতোই ৪১ বছর ধরে পিতৃশোকে কাঁদছে জাতি। হৃদয়ে বাজছে, ‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো/ যদি বাঙালি হও নিঃশব্দে কাছে এসো, আরো কাছে/.. এখানেই শুয়ে আছেন অনন্ত আলোয় নক্ষত্রলোকে/ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান/ মৌমাছির গুঞ্জনের পাখির কাকলিতে করুণ সুর বাজে/ গভীর অরণ্যে পুষ্পের সুগন্ধে/..অনেক রক্তের মূল্যে পাওয়া এ স্বাধীনতা/ এখানে ঘুমিয়ে আছে, এইখানে দাঁড়াও শ্রদ্ধায়।’

আজ যে কাঁদারই দিন। আজ যে সেই ভয়াল-বীভৎস ১৫ আগস্ট। পঁচাত্তরের এই দিনে আগস্ট আর বর্ষণ্নাত শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে। সেদিন বাতাস কেঁদেছিল। শ্রাবণের বৃষ্টি নয়, আকাশের চোখে ছিল জল। গাছের পাতারা শোকে সেদিন ঝরেছে অবিরল। মহাদেব সাহা তার ‘সেই দিনটি কেমন ছিলো’ কবিতায় লিখেছেন- ‘সেদিন কেমন ছিলো- ১৫ই আগস্টের সেই ভোর/ সেই রাত্রির বুকচেরা আমাদের প্রথম সকাল/ সেদিন কিছুই ঠিক এমন ছিলো না/ সেই প্রত্যুষের সূর্যোদয় গিয়েছিলো/ সহস্র যুগের কালো অন্ধকারে ঢেকে/ কোটি কোটি চন্দ্রভুক অমাবস্যা তাকে গ্রাস করেছিলো/ রাত্রির চেয়েও অন্ধকার ছিলো সেই অভিশপ্ত দিন।’ আর সেদিন হতবিহ্বল জাতির চারদিকে ছিল ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন। মুছে দিতে চেয়েছিল রক্তের চিহ্নসহ জনকের লাশ। ভয়ার্ত বাংলায় ছিল ঘরে ঘরে চাপা দীর্ঘশ্বাস আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন।

আজ সেই দিন, বাংলার ইতিহাসে অবিরল অশ্র“ঝরা দিন। এই জাতি এই দেশের স্বপ্নমূলে নির্মম কুঠার হেনে বাংলা ও বাঙালির চিরবিরোধীরা পিতাকে ছেদন করে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট এই দিনটিতে। সময় প্রবহমান; এই দেশ এই জাতি সেই থেকে বিপুল এক অশ্রুবারিতে ভাসমান।

বাঙালি পিতৃহারা হয় এই দিনটিতে; তিনিই সেই পিতা, যিনি বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্নবীজটিকে লালন করে রোপণ করেন সবুজ এ মাটিতে, ফলবান করে তোলেন একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চে তার দৃপ্ত সেই ঘোষণা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। যাও, যুদ্ধে যাও, মাতৃভ‚মিকে মুক্ত করো। ১৯৭৫ সালের শোকাবহ এই কালো দিবসে সূর্য ওঠার আগে খুব ভোরে ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র
নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।

পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান। পিতার সে রক্ত আজো শুকোয়নি এ বাংলাদেশে।

পিতৃহত্যার সেই শোক জেগে আছে রক্তরাঙা ওই পতাকায়, সেই শোক অনির্বাণ এখনো বাংলায়। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল ভিজে আছে পুণ্য সেই রক্তে। বাঙালির ইতিহাস প্লাবিত হয়ে আছে সে রক্তে। নদীর স্রোতের মতো চির বহমান কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন। আজো বাংলার পূর্ব দিগন্তে প্রতি ভোরে যে সূর্য ওঠে, জাতির পিতার লাল রক্ত মেখেই সে উদিত। প্রতিটি ভোরের ওই সূর্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পিতা বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বজ্রকণ্ঠ উচ্চারণ, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল­াহ।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!