• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী বঙ্গবন্ধু ও জনগণের মতের পরিপন্থী


আদালত প্রতিবেদক মে ২৪, ২০১৭, ০৪:৪৬ পিএম
ষোড়শ সংশোধনী বঙ্গবন্ধু ও জনগণের মতের পরিপন্থী

ঢাকা: উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে সংবিধানের আনিত ষোড়শ সংশোধনীকে বঙ্গবন্ধুর নীতির পরিপন্থী ও জনগণের মতের পরিপন্থী উল্লেখ করে যুক্তি উপাস্থপন করেছেন রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে সংবিধানের আনিত ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানিতে আজ বুধবার (২৪ মে) ষষ্ঠ দিনের মতো যুক্তি উপস্থাপন চলছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে এ শুনানি হচ্ছে।

রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ তার যুক্তিতে বলেন, কতিপয় সংসদ সদস্য সংসদে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদে নিয়ে আসবো। শুধুমাত্র এই গ্রাউন্ডের ওপর ভিত্তি করেই এই ষোড়শ সংশোধনী করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা আদালতে বলেছি, এ সংশোধনী জনগণের মতামতে করা হয়নি। এখানে আর্টিকেল ৭ অনুসারে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। এমন কি আপিল বিভাগের রায়ের পরিপন্থী করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্ট থেকে যা নিয়ে এসেছেন তারও পরিপন্থী হয়েছে।

সকাল ৯ টা ১০ মিনিট থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ১০টা ২০ মিনিট পর্যন্ত যুক্তি উপাস্থাপন করেন। এরপর রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ তার যুক্তি উপাস্থাপন শুরু করেন।

রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আমরা যুক্তিতে প্রথমেই ষড়োশ সংশোধনীর প্রেক্ষপট তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আদালতের কাছে, হঠাৎ করেই ষোড়শ সংশোধনী কেন আসলো।

আরেকটি গ্রাউন্ড আমরা বলেছি, লার্নেড অ্যাটর্নি জেনারেল আপিল বিভাগে বক্তব্য রেখেছিলেন যে, ১৫ তম সংশোধনীটা কাটিং এন্ড পেস্ট হয়েছে, কোনো আলোচনা হয়নি। এটার কাউন্টার হিসেবে আমরা কতগুলা প্রসিডিং দেখিয়েছি।

তিনি উল্লেখ করেন, ১৫ তম সংশোধনী যখন পাস হয়। তখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে পার্লামেন্টের আইন পাশের মাধ্যমে প্রটেক্ট করা হয়েছিল। সে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এটা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। সেই হিসেবে ওনার নির্দেশেই ওই দিন সংশোধনী হয়েছিল।

আরও একটি কথা আমরা বলেছি, যেটা লার্নেড অ্যাটর্নি জেনারেল সব সময় বলার চেষ্টা করেন, ৭২ এর সংবিধানে ফিরে গেছেন। এ বিষয়ে আমরা বলেছি, ৭২ এর সংবিধানের মূল স্প্রিট এবং যার নেৃতত্বে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার নেতৃত্বে সংবিধান প্রণয়ন হয়েছিল। সেই সংবিধান প্রণেতা, আমাদের জাতির পিতা আামদের জাতীয় নেতা। ওনার নেতৃত্বেই জাতীয় সংসদ থেকে এ ক্ষমতাটা নিয়ে আসার একটা আইন পাস হয়েছিল চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। এটি আমরা আদালতকে দেখিয়েছি বঙ্গবন্ধু নিজেই বিচারকদের অপসারণের ব্যাপারে সংসদ থেকে ক্ষমতা নিয়ে গিয়েছিলেন।

আমরা মনে করি, তারই অনুসারী হিসেবে সেটা সমর্থন করা দরকার। যদি কেউ এটার বিরোধীতা করে তাহলে আমি মনে করি সেটা সঠিক হবে না। তিনি বলেন, আরও একটা জিনিস আমরা দেখিয়েছি সেটা আদালতের রায়। আদালত যখন ১৫তম সংশোধনীর বিষয়ে আপিল বিভাগ রায় দিল তখন লার্নেড অ্যাটর্নি জেনারেল সাবমিশন রেখেছিল। তিনি বলেছিলেন এ রায়ের মাধ্যমে কোন বৈধতা দেয়া হয়নি। কিন্তু আমরা আদালতকে সেটা দেখিয়েছি। ওই রায়ের ভিতরেই আদালত বলেছিলেন যে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে পদ্ধতিটা অন্যান্য পদ্ধতিটার থেকে ভাল। এ কথা বলে রায়ের শেষে গিয়ে এটিকে কনডন (প্রটেক্ট) করেছেন। সর্বশেষ যে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে এই কনডন করার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। শুধুমাত্র আদালতের রায় অনুসারে সংসদ যাতে আইন পাশ করতে পারে। আপিল বিভাগের রায়ের মধ্যেই এটা আলোকপাত করা হয়েছিল। যে কয়টা পদ্ধতি ছিল এটাই বেষ্ট পদ্ধতি।

মনজিল মোরসেদ বলেন, ১৫ তম সংশোধনীতে এটা সেটেল হয়ে গেল। সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ আইনটা করা হলো। হঠাৎ করে কিছুদিন পরেই জনগণের পক্ষ থেকে কোন সভা-সেমিনারে কেউ কখনো কোনো দাবি তুলেনি যে এই আইনটা পরিবর্তন করা দরকার। কিন্তু কয়েকটা প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল যার মাধ্যমে আমরা দেখিয়েছি, বিশেষ করে দুর্নীতি দমন আইনের কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা হলো। যাতে প্রশাসনে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন এফেক্টিভ কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করতে না পারে।

আবার আদালত দ্বারা রায় বাস্তবায়ন হওয়ার ক্ষেত্রে আদালত অবমাননার আইনটাও যাতে কার্যকরী না হয় সে বিষয়ে সংশোধনী আনলো। এ দুটি অ্যামেন্টমেন্টকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। এর সাথে সাথে আদালত তাকে বাতিল ঘোষণা করেছে।

কিছুদিন পরেই নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা ঘটে। সেখানেও আইন‍শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিল। হাইকোর্টের নির্দেশেই এটি অগ্রসর হয়েছে। এই সমস্ত সামগ্রিক বিষয়গুলো উপস্থাপন করে। পার্লামেন্টে আরেকটি জনস্বার্থ মামলা ছিল। সেখানে স্পীকারের রুলিং নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, সেখানে কতিপয় সংসদ সদস্য সংসদের দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমরা এই ক্ষমতটা সংসদে নিয়ে আসবো। শুধুমাত্র এর উপরই এই ষোড়শ তম সংশোধনী করা হয়েছে।

এজন্য আমরা আদালতে বলেছি, এ সংশোধনী জনগণের মতামতে করা হয়নি। এখানে আর্টিকেল ৭ অনুসারে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়নি। এমন কি আপিল বিভাগের রায়ের পরিপন্থী করা হয়েছে। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যে পার্লামেন্ট থেকে নিয়ে এসেছেন তার পরিপন্থী করা হয়েছে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য এটা প্রটেক্ট করার কথা আগে বলেছিলেন, তারও পরিপন্থী করা হয়েছে।

এর আগে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। এর আগে গত ৮ মে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শুরু হয়।

এরপর ৯ মে শুনানি শেষে ২১ মে পর্যন্ত মুলতবি করেছিলেন আপিল বিভাগ। পরে ২১ মে রবিবার থেকে ধারাবাহিক ভাবে শুনানি চলছে। এ সময় ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে নিয়োগ দেয়া অ্যামিক্যাস কিউরিরা উপস্থিত ছিলেন।

গত ১২ মার্চ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে ১২ অ্যামিক্যাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ দেন  আপিল বিভাগ।

১২ বিশিষ্ট আইনজীবী হলেন- বিচারপতি টি এইচ খান,  ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এম আই ফরুকী, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী এ এফ হাসান আরিফ ও  আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া।

গত বছরের ১১ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে  প্রকাশ করা হয়। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ।

গত বছরের ৫ মে  বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় ঘোষণা করেন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যেটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।

সংবিধানে এই সংশোধনী হওয়ায় মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করবে; এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। ওই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল জারি করেন। আগামীকাল পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন আদালত।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেএ

Wordbridge School
Link copied!