• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
মিলছে না সরকারি বরাদ্দ

সঙ্কটে টেলিটক


বিজ্ঞান-প্রযুক্তি রিপোর্ট জানুয়ারি ২১, ২০১৮, ১২:৪৩ পিএম
সঙ্কটে টেলিটক

ঢাকা : সঙ্কটে রয়েছে টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড (টিবিএল)। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই মোবাইল অপারেটর কোম্পানি। দেশের বৃহত্তম বেসরকারি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোনের চেয়ে সাড়ে চার হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার কম বিনিয়োগ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে তারা।

নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন মেলার পরও তাদের তহবিল ছাড়ছে না অর্থ বিভাগ। তবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা বাড়াতে আরো বিনিয়োগ করতে হবে বলে মনে করছেন সরকারের শেষ সময় নিয়োগ পাওয়া ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সংসদীয় কমিটিকে বলেছে, মোবাইল টেলিযোগাযোগ ব্যবসায় সফলতার অন্যতম শর্ত হলো সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক। বিনিয়োগের অভাবে টেলিটক সেটি করতে পারেনি। টেলিযোগাযোগ একটি বিনিয়োগ ঘন (ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ) খাত। দীর্ঘ মেয়াদে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের মাধ্যমেই এ খাতের কোম্পানিগুলো লাভের মুখ দেখে।

এ বিষয়ে শুক্রবার (২০ জানুয়ারি) দুপুরে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘বিনিয়োগ নিঃসন্দেহে একটা বড় ফ্যাক্টর। গ্রামীণফোন বড় হয়েছে, কারণ তারা বিনিয়োগ বেশি করেছে। ব্যবসার নিয়মও তাই। টেলিটক একটা কোম্পানি। সুতরাং তাকে ব্যবসা বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বেসরকারি অপারেটর গ্রামীণফোনের বিনিয়োগের আকার ৪ হাজার ৯৬০, রবির ৩ হাজার ৬৫০ ও বাংলালিংকের ২ হাজার ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এদের বিপরীতে টেলিটকের বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ৪৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

মন্ত্রী বলেন, ‘টেলিটক সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ তথ্য আমি এখনো পাইনি। সুতরাং বিনিয়োগ কী আছে বা কী দরকার, সে ব্যাপারে মন্তব্য করার মতো অবস্থা এ মুহূর্তে আমার নেই।’

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ আরো বলেছে, যেখানে টেলিটক অন্য অপারেটরদের সমপর্যায়ের বিনিয়োগও করেছে, সেখানে অন্যদের চেয়ে সফল হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে টেলিটক ও বেসরকারি অপারেটররা প্রায় সমপরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে একইসঙ্গে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ শুরু করে। সেখানে তারা যেকোনো অপারেটরের চেয়ে ভালো সেবা দিয়ে দক্ষতার প্রমাণ করেছে। অল্প বিনিয়োগে যে ধরনের মোবাইল ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস দেওয়া সম্ভব, তাও টেলিটকই প্রমাণ করেছে।

উন্নত সেবা দিতে টু-জি বেইজ ট্রান্সসিভার স্টেশনের (বিটিএস) পাশাপাশি অপারেটরগুলো থ্রি-জি বিটিএস বা নোট-বি ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করছে। সংসদীয় কমিটিকে দেওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে গ্রামীণফোনের সর্বাধিক ১২ হাজার ৫২৩ টু-জি টাওয়ার ও ১১ হাজার ৮৪১ থ্রি-জি নোট-বি রয়েছে। রবির রয়েছে ১১ হাজার ৯৭০ টু-জি টাওয়ার ও ৮ হাজার ৮১৪ থ্রি জি নোট-বি এবং বাংলালিংকের ৯ হাজার ২০৬ টাওয়ার ও ৮ হাজার ২৬৫ নোট-বি। অথচ টেলিটকের রয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৭৫০ টাওয়ার ও ১ হাজার ৫৬২ নোট-বি।

বিজয় কি-বোর্ডের জনক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জব্বার বলেন, ‘আপনি সেবা দিতে চাইবেন; কিন্তু সেবার বিপরীতে বিনিয়োগ করবেন না, তাহলে কী করে হবে? আপনি যখন নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে চান, ডেফিনিটলি তখন তার জন্য বিনিয়োগ করতে হবে।’
 
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২৬ ডিসেম্বরের ২১তম বৈঠকে টেলিটক-সংক্রান্ত নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়। ২১ ডিসেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের উপসচিব ও কাউন্সিল অফিসার ফজলুল করিম এগুলোর অনুমোদন দেন।

অনুসন্ধানে অন্য এক সংসদীয় নথি থেকে জানা গেছে, গত জুলাইয়ে এই সংসদীয় কমিটির ১৯তম বৈঠকেও টেলিটক নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। ওই দিন তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ (বর্তমানে তথ্য) প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, টেলিটক তার নিজস্ব অর্থায়নে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য সরকারি অর্থায়নের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেলেও টাকা ছাড় হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে তিনি সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে তাগিদ দেওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি আরো বলেন, ২০১৮ সালের জুনে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের দুটি প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও টেলিটকের সেবার আওতা ২৫-৩০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হবে। কমিটির সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন বলেন, টেলিটকের মার্কেট শেয়ার শতকরা মাত্র তিন ভাগ। এর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেলেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কেন টাকা ছাড় হবে না তা বোধগম্য নয়।

একই বৈঠকে কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ বলেন, অন্য মোবাইল অপারেটরদের প্রদেয় সেবা জনবান্ধব করার জন্য ভারসাম্য রক্ষায় সরকার টেলিটক প্রতিষ্ঠা করে। এটিকে অন্য অপারেটরদের সঙ্গে সমানতালে সেবা দিতে সক্ষম করে তুলতে হবে। নয়তো বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে জনবান্ধব করার বিষয়টি পরিকল্পনাই থেকে যাবে।

ডিসেম্বরের বৈঠকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ দাবি করেছে, তাদের প্রস্তাবিত পাঁচটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে টেলিটক একটি প্রতিযোগিতামূলক লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এ প্রকল্পগুলোর আওতায় টেলিটক গ্রামপর্যায়ে থ্রি-জি (তৃতীয় প্রজন্মের) এবং উপজেলা পর্যায়ে ফোর-জি (চতুর্থ প্রজন্মের) নেটওয়ার্কিং সেবা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে চায়। একই সঙ্গে নেটওয়ার্ক পৌঁছাতে চায় হাওর-বাঁওড়, কোস্টাল বেল্ট ও অন্যান্য দুর্গম এলাকায়।

এ লক্ষ্যে ৫ প্রকল্পে ৪ বছরে ১ হাজার ১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৯ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা) বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে টেলিটকের নিজস্ব অর্থায়নে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ চলছে। আগামী জুনে এটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

থ্রি-জি প্রযুক্তি প্রবর্তন ও টুপয়েন্টফাইভ-জি নেওয়ার্ক সম্প্রসারণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। বর্তমানে অর্থ বিভাগে অর্থছাড়ের জন্য অপেক্ষমাণ। ৬৭৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পের ৯০ শতাংশ সরকারি এবং বাকিটা টেলিটকের নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে থ্রি-জি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে ৩ হাজার ২৮৩ কোটি টাকার প্রকল্পের ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সরকার বা উন্নয়ন সহযোগীরা এর অর্থ জোগাবে-এমনটাই আশা করা হচ্ছে। ‘সোলার বেইজড বেইজ স্টেশন ইন হার্ড টু রিচ এরিয়াস ফর স্ট্রেনদেনিং টেলিটক নেটওয়ার্ক কভারেজ’ প্রকল্পে ২৪০ কোটি টাকার ঋণ থাকবে, যা ভারত জোগাবে।

এ ছাড়া টেলিটক বিনিয়োগ করবে আরো ৩০ কোটি টাকা। মোট ২৭০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের প্রাথমিক উন্নয়ন প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশন থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) গেছে। এ ছাড়া ফোর-জি প্রযুক্তিচালুকরণ এবং থ্রি-জি ওয়াই-ফাই হটস্পট নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি এখনো পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে।

মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘টেলিটক ইনফ্যাক্ট, বহু সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। বিনিয়োগকে সঙ্কটের একটি কারণ বলা হচ্ছে। তবে আমি এটাকে একমাত্র কারণ মনে করি না। আমি তো কেবল দায়িত্ব নিয়েছি। আগে দেখি, শুনি-বুঝি, তারপরে বিস্তারিত বলব।’

সোনালীনিউজ/এমটিআিই

Wordbridge School
Link copied!