• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সততার প্রতিদান


সোহেল হাফিজ ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬, ০৭:৫০ পিএম
সততার প্রতিদান

বরগুনার বাজার সড়ক। একদিকে বন্দরক্লাব, আরেক দিকে রঙধনু ডায়াগনস্টিক সেন্টার। মাঝামাঝি একটি পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় আমার অফিস।

অফিস না বলে আস্তানা বলাই শ্রেয়। ছা পোষা এক মফস্বল সাংবাদিকের আস্তানা। জীবন যুদ্ধের জয়- পরাজয়ে, দর্যোগে- দুঃসময়ে একাধিকবার ছেড়েছি এ আস্তানা। কেনই যেন ঘুরে ফিরে আবারও বহাল হয়েছি এখানেই।

গলির মুখেই ধর্মতলা। ধর্মতলার প্রথম সারিতেই আলমের চায়ের দোকান। সারা মাস জুড়ে এখানেই আমার বাকি খাওয়া। চা-সিগ্রেট। মাঝে মাঝে ক্ষিধে পেলে সাজুর হোটেলের রুটি, ভাজি কিংবা হালুয়া। আর তাতেই দেড় থেকে দু’হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায় প্রতিমাসে।

চেনা খদ্দের। বাকি দিতে আপত্তি নেই আলমের। আপত্তি নেই সুলতান আর সাজু ভাইয়েরও। তবুও প্রায় সকালেই দূরে দাড়িয়ে ক্ষনিক অপেক্ষা করতে হয় আমাকে। বউনি না করলে বাকি চাওয়া অসমীচীন। দোকানদারের অকল্যাণ। তাই দূরে দাঁড়িয়ে থাকি। কখন বউনি হবে। তারপর বহু কাঙ্খিত এক কাপ চা। সকাল বেলার চা। অতঃপর মুখাগ্নী।

অভাব অনটন আর বকেয়ার জেরে আবারও সরু হয়ে আসছে শহরের সব ওলিগলি। বরাবরের মত দু’দিন আগে আরও একবার বাকির দোকানের সামনে এসেই তেলের অভাবে বন্ধ হয়ে গেল মোটর সাইকেলটি। মুচকি হেসে সেদিন বাকির দোকানের বৈতরণি পার হলেও এক লিটার পেট্রোলের জন্যে অপেক্ষা করতে হল আরও ঘন্টা খানেক।

এদিকে তৃতীয় আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া আমার দুই ছেলের সাইকেল কেনার দাবি দিন দিন আবারও জোরালো হয়ে উঠছে। ফুঁসে উঠছে আমার একমাত্র সহধর্মিনীর দীর্ঘ কুড়ি বছরের অবহেলিত সংসারের দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলনও। প্রতিনিয়তই কথা হচ্ছে- বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রাপ্য অধিকার নিয়েও। তার উপরে আবার আসন্ন- একমাত্র শালার শুভ বিবাহ। আসছে শালা বউও।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দু’টি গণমাধ্যমের মফস্বল প্রতিনিধি আমি। দিনভর ব্যস্ততা। গভীর অনুসন্ধান। দুর্নীতিবাজদের সাথে যুদ্ধ। নানা রকমের হ্যাঁপা। রাস্তঘাটে চলে আমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারের ষড়যন্ত্র। আমার দোষ-ত্রুটি নিয়ে চলে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা।

এতসব ঝক্কি-ঝামেলা নিয়েও আমি নিয়মিত সিনেমা দেখি। হলিউড, বলিউড এমনকি ঢালিউডের ছবিও। মাস দুয়েক আগে দেখলাম বলিউডের বিখ্যাত ছবি সুলতান। তার আগে দেখলাম মাহেঞ্জোদারো, থ্রি-ইডিয়ট, পিকে ইত্যাদি। সুলতান ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হলাম। নতুন করে উদ্যোমী হলাম জীবন যুদ্ধে। সুলতান তার ৪০ বছর বয়সে নতুন করে আবারও রেসলিং-এ ক্যারিয়ার শুরু করেছিলো। হাল আমলের বিশ্ব সেরা ব্রিলিয়ান্ট সব রেসলারদের সাথে লড়াই করে আবারও ছিনিয়ে এনেছিলো ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নের ট্রফি। নতুন করে ফিরে পেয়েছিলো প্রিয় স্ত্রীকে।

সর্বশেষ আরও একটি সিনেমা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে বেশ। আমার অভাবী জীবনের হতাশাকেও কাটিয়ে দিয়েছে নিমিষেই। না, কোন কাল্পনিক সিনেমা নয়। কোন হলে গিয়েও দেখিনি আমি সে সিনেমা। বরগুনার মিষ্টি পট্টি, দোয়েল চত্বর, শহিদ মিনার আর মাঠে ময়দানে হয়েছিলো যার রিয়েল শুটিং। শুটিং চলছে এখনও। দেখছি আমি। দেখছে আম-জনতা। সিনেমার নাম ‘সততার প্রতিদান’। নায়ক- দেলোয়ার হোসেন।

সততা আর প্রতিবাদী অবস্থানের কারণে একসময় স্বেচ্ছা নির্বাসন মেনে নিতে হয়েছিলো তাঁকে। অভাব অনটন আর রোগ শোকে ভুগে দীর্ঘ দশটি বছর যার কেটে গেল গৃহবন্দী হয়ে। দিনের পর দিন তেলবাজ, রংবাজ আর প্রভাবশালী চামচাদের ভর্ৎসনা আর উপহাসও মেনে নিতে হল তাঁকে। তথাকথিত রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে দূরে ঠেলে, পড়ে রইলেন তিনি একাকী, একঘরে।

তবুও হার মানেননি দেলোয়ার। হার মানেননি কখনও অনৈতিকতার কাছে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন প্রতিবাদী অবস্থান আর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি অবিচল আস্থা, বিশ্বাস আর লেগে থাকার গুনে সম্প্রতি তাকে দলে ফিরিয়ে নিলেন, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় সমর্থন দিলেন, বরগুনা জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে।

এ  খবর ছড়িয়ে পড়লে স্বস্তির নিশ্বাস মেলে সর্বস্তরের বরগুনাবাসীর। রাস্তার মোড়ে, দোকানে, কারখানায় দেখা যায় মিষ্টি বিতরণের চিত্র। এরপর গত ২৮ ডিসেম্বরের জেলা পরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমগ্র বরগুনাবাসীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন দেলোয়ার। বরগুনার ইতিহাসে সততার এক অবিস্মরণীয় জয় দেখালেন, এক সময়ের মাঠ কাঁপানো গণ মানুষের নেতা  দেলোয়ার হোসেন।

‘সততার প্রতিদান’ সিনেমায় আমরা দেখলাম, যে সব তেলবাজ, রংবাজ আর দুর্নীতিবাজ চামচারা একসময় দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন তারাই এখন দেলোয়ার হোসেনের সিগারেট আর ছাইদানী এগিয়ে দিতে জোর তৎপর। জনপ্রিয় নেতা দেলোয়ার হোসেনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রতিযোগিতায়ও এখন গলদঘর্ম তারা।

হতাশায় ভুগছিলাম ভিষনভাবে। সবাই বলে সততার নাকি কোন দাম নেই। জননেতা দেলোয়ার হোসেনের অভিনীত ‘সততার প্রতিদান’ সিনেমাটি দেখার পর সকল হতাশা কেটে গেছে আমার। কী হবে না হবে জানি না। তবে সততার দাম আছে কি নেই, সে বিষয়ে আমার আর সন্দেহ নেই মোটেও।

জননেতা দেলোয়ার হোসেনের সিনেমা দেখে শিখেছি অনেক। শিখেছি, চাইলেই কাউকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যায়, কিন্তু ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলা যায় না। দুর্নীতিবাজ, দালাল আর চামচারা যতই দুরভিসন্ধী করুক না কেন তাদের পরাজয় অনিবার্য্য। শিখেছি, আজ যারা আমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে ব্যতিব্যাস্ত, যদি সৎ থাকি, যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, তবে কোন একদিন তারাই ছাইদানী এগিয়ে দেবে আমার।

শিখেছি, সত্যিকারের সততার জয় হতে কোন সাংবাদিক লাগে না। লাগে না কোন লবিস্টও। শিখেছি, ইউরোপ আমেরিকার বাড়ির চেয়ে, হাজার কোটি টাকার চেয়ে, অনেক বেশি মূল্যবান- আমজনতার সেই স্লোগান- ‘টাকা চাই না পয়সা চাই না দেলোয়ার ভাই।’ শিখেছি, কেন্দ্রীয় কমিটিতে নাম থাকলেই জননেতা হওয়া যায় না। জননেতা হতে লাগে- জনতার সমর্থণ। লাগে সততার শক্তি। জয় হোক জনতার। জয় হোক সততার।।

লেখক- সোহেল হাফিজ (লেখক, সাংবাদিক এবং ভবঘুরে)

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!