• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সন্ত্রাসবাদ জঘন্য মহামারী


ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন   জুলাই ২৫, ২০১৬, ০১:২৪ পিএম
সন্ত্রাসবাদ জঘন্য মহামারী

কূটনৈতিকপাড়া নামে খ্যাত ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গিদের হাতে ২০ জন দেশি-বিদেশি প্রাণ হারানোর ঘটনায় দেশবাসী স্তম্ভিত, বেদনাহত ও আতঙ্কগ্রস্ত। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো, নিহত জঙ্গিদের মৃতদেহ তাদের পরিবার নিতে আগ্রহী হয়নি। এমনকি শোলাকিয়ায় নিহত আবিরের জানাযায় কেউ শরিক পর্যন্ত হয়নি। জনৈক তত্ত্বাবধায়ক ইমামতি করে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেন। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, এদেশের মানুষ এসব জঙ্গি কর্মকা- পছন্দ করে না।

কারণ সন্ত্রাসের কোনো ধর্মীয় ভিত্তি নেই, ইসলাম ধর্মে এটি ঘৃণ্যতম কাজ। ভীতি তথা ফেতনা সৃষ্টি হত্যার চেয়েও মারাত্মক। ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ম, বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সব মানুষের প্রাণ, সম্পদ, মর্যাদা অত্যন্ত পবিত্র। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল।’

তবে লক্ষ রাখতে হবে, সাম্রাজ্যবাদীদের খেলা বহুমুখী। পৃথিবীর কোনো দেশে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই মুসলমানদের ওপর তার দায়ভার চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা আমরা কয়েক দশক ধরে লক্ষ  করছি। অথচ এফবিআই এবং ইউরোপের গবেষণাধর্মী রিপোর্ট থেকে সম্প্রতি ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে। ‘লোনওয়াচডটকম’ নামের ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকা-ের দশমিক ৪ শতাংশ ঘটেছে মুসলিমদের দ্বারা। বাকি ৯৯.৬ ভাগ সংঘটিত করেছে অমুসলিম বা অন্য ধর্মের অনুসারীরা।

সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়ে কখনও কখনও দুই-একটি মুসলিম নামধারী গ্রুপ নিজেদের ইসলামের অনুসারী বলে দাবি করে। কিন্তু আসলেই কি তারা মুসলিম? নাকি মুসলমানের ছদ্মবেশে অন্য কেউ? তারা তো এমনও হতে পারে যে, কোনো পক্ষের হয়ে কাজ করার জন্য তাদের তৈরি করা হয়েছে। বিশেষত ইসলাম এবং মুসলমানদের ওপর সন্ত্রাসের দায়ভার চাপিয়ে প্রকৃত সন্ত্রাসীরা নিজেদের দায়মুক্ত করার চেষ্টা করছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটি কৌশলে চালিয়ে তার লক্ষ্য হাসিল করতে চাচ্ছে?

হজরত ওমর (রা.) এর পর ১৪০০ বছর ধরে মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ, মতবিরোধ, বিসংবাদ, সহিংসতা, সংঘাতে বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত। রক্তপাতে বহু অমূল্য জীবনের অবসান হয়েছে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, নানা দল-উপদল একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে নিজের জীবনীশক্তিকে এভাবে নিঃশেষ করে দিয়েছে যে, দুশমনের সঙ্গে মোকাবিলা করার সামর্থ্য আর অবশিষ্ট নেই। মানবতার বাণী, ঐক্যের ডাক, পরমত সহিষ্ণুতা উপহাসে পরিণত হয়। এর নেপথ্যে কুশীলবের ভূমিকায় ছিল ইহুদি আবদুল্লাহ ইবনে সাবা, মোনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অনুসারীরা। 

বর্তমানে তারা আরও বেশি সক্রিয়। এখন মুসলমানরা অনেক বেশি দলাদলিতে বিভক্ত। নিজেদের দল-উপদল নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত। পবিত্র কোরআনের ভাষায় ‘কুল্লু হিযবিন বিমা লাদাইহিম ফারিহুন।’ কার লেখায় কার বর্ণনায় কার কিতাবে কী ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে তার অনুসন্ধানী গবেষণায় আমরা অহরাত্রি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। উরারফব ধহফ জঁষব পলিসি এখনও কার্যকর রয়েছে একথা আমাদের মনে নেই। শত্রু চিনতে ভুল হচ্ছে। ভাই হয়ে গেল দুশমন, দূরের অপরিচিত লোক হয়ে গেল বন্ধু।

হতাশ হলে চলবে না : পৃথিবীতে একেক সময় একেক বিপদ, ফেতনা, বিপর্যয় মানবজাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে।  ইহুদি আবদুল্লাহ ইবনে  সাবাহ, মোনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই, গুপ্তঘাতকদের নেতা হাসান আল সাবাহ, খারেজি নেতা আবদুল্লাহ ইবনে আল কাওয়া, পারস্যের নাদিরশাহ, মঙ্গোলিয়ার হালাকু খান-চেঙ্গিস খান, মধ্যএশিয়ার তৈমুর লঙ, বাংলার মীরজাফর,  মহীশূরের মীর সাদিক, স্পেনের ওমর ইবনে হাফসুন, জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসুলিনি, বলকানের কসাই স্লোভদান মেলোসেভিচের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে এক সময় পৃথিবী ছিল সন্ত্রস্ত, বিপর্যস্ত, বাকরুদ্ধ। 

মধ্যপ্রাচ্য থেকে দিল্লি, বাংলা থেকে যুগোস্লাভিয়া পর্যন্ত রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিয়েছে তারা। এখনও মাঝে মধ্যে তাদের উত্তরসূরিরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমাদের হতাশ হলে চলবে না। সাহস সঞ্চয় করতে হবে। আমাদের সব কাজ হবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য। ঘন কালো মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে- একথা আমাদের মনে রাখতে হবে। বৈরী পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য তৈরি থাকতে হবে।

আমাদের করণীয় : ১. কেবল সরকার বা রাষ্ট্র একার পক্ষে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। দেশের সর্বস্তরের মানুষকে এ ব্যাপারে সংগঠিত করতে হবে। সামাজিক শক্তিগুলোকে একতাবদ্ধ করতে হবে। জনসম্পৃক্ততা যে কোনো উদ্যোগের সবচেয়ে বড় শক্তি।

২. সমাজে ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার নামে যাতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হত্যাকা-, বোমাবাজি বা আতঙ্ক ছড়াতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আমাদের সন্তানসন্ততি কোনো উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে কিনা সদা সতর্ক থাকতে হবে এবং জড়িত হয়ে পড়লে বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে।

৩. প্রতিনিধিত্বশীল বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক সংলাপের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভারতসহ বহু দেশে এ সংস্কৃতি চালু আছে।
৫. সন্ত্রাস ও জিহাদ যে এক নয় এ কথা আলেম, ইমাম ও খতিবরা ওয়াজ ও মসজিদের বয়ানে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেন। 

জিহাদের পবিত্র চেতনাকে সন্ত্রাসের উন্মাদনার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হবে মারাত্মক ভ্রান্তি। ইসলামে উগ্রপন্থা নেই, মধ্যমপন্থা অনুমোদিত। জিহাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি বিধান। জিহাদের সুনির্দিষ্ট শর্তাবলি আছে। জিহাদের নামে আল্লাহ তায়ালা নারাজ, অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত হন এমন কোনো কর্মকা- শরিয়ত অনুমোদন করে না।

লেখক : অধ্যাপক, ওমরগণি এম.ই.এস কলেজ, চট্টগ্রাম 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এএম

Wordbridge School
Link copied!