• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
তীব্র দাবদাহে বির্পযস্ত জনজীবন

সবচেয়ে গরম দিন পার করল ঢাকাবাসী


নিজস্ব প্রতিবেদক মে ২৪, ২০১৭, ১২:০০ পিএম
সবচেয়ে গরম দিন পার করল ঢাকাবাসী

ঢাকা : গরমে বির্পযস্ত জনজীবন। শুধু দিনের বেলাতেই নয়, রাতেও গরমে মানুষ ঘুমাতে পারছে না। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে শিশু ও বয়স্ক মানুষদের। রাজধানীসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার কারণে এই অস্বস্তিকর গরম অনুভূত হচ্ছে। চলতি মাসজুড়ে এ তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি বৃষ্টি হলেও তাপদাহ কমবে না বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। 

তীব্র গরমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানি সংকট। গত তিন দিনের ব্যবধানে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে তাপমাত্রা বেড়েছে গড়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময়ে রাজধানী ঢাকাতেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যার ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার চলতি মৌসুমের সবচেয়ে গরম দিন পার করেছে ঢাকাবাসী।

মঙ্গলবার আবহাওয়াবিদ শাহিনুল ইসলাম জানান, এদিন ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গত মার্চ-এপ্রিল-মে তিন মাসের যে কোনো দিনের চেয়ে বেশি। যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

গত বছর ২০ মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বছর ২০ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ হিসাবে গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এই সময়ে তাপমাত্রা বেড়েছে।

এদিকে, তীব্র তাপদাহে দেশজুড়ে পানিবাহিত বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রকোপ শুরু হয়েছে। রাজধানীর আইসিডিডিআর’বি, শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডায়রিয়া, কলেরা, হেপাটাইটিস, আমাশয়, টাইফয়েডসহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর ভিড় বাড়ছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই শিশু। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বেশি বেশি পানি, স্যালাইন ও লেবুর শরবত খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, ঢাকাসহ দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই করছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের এ গরমে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সোমবার ঢাকায় ৩৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত রোববার খুলনা ও যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহী, পাবনা, ঢাকা, চাঁদপুর, খুলনা ও নোয়াখালীর ওপর দিয়ে বয়ে চলা এ তাপপ্রবাহ আরও কয়েক দিন থাকতে পারে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র গরমের কারণে গত কয়েকদিনে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের হার বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া যায় রাজধানীর মহাখালী আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) হাসপাতালে। এখানে প্রতিদিন গড়ে ডায়রিয়া আক্রান্ত ৫০০ রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আইসিডিডিআর'বিতে গত এক সপ্তাহে রোগী ভর্তির তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। গত সোমবার সর্বোচ্চ ৬১৩ জন রোগী এ হাসপাতালে ভর্তি হয়। গতকাল মঙ্গলবার বেলা দেড়টা পর্যন্ত ২৯৯ জন সেখানে ভর্তি হয়েছে।

আইসিডিডিআর'বির সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন ২৫০-৩০০ রোগী ভর্তি হলে তা স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। কিন্তু রোগীর সংখ্যা ৩৫০ পার হলে আমরা সতর্ক অবস্থানে চলে যাই। গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে পাঁচশ রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছে।  সর্বনিু ছিল ৪৮৫ জন।

আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের ডায়রিয়াল ডিজিজ ইউনিট প্রধান ডা. আজহারুল ইসলাম খান বলেন, দেশে বর্তমানে ডায়রিয়ার পিক মওসুম (বছরে দুই বার মার্চ-এপ্রিল ও আগস্ট-সেপ্টেম্বরকে ডায়রিয়ার পিক সিজন ধরা হয়) চলছে। তিনি জানান, গত সপ্তাহ থেকে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়েছে। অন্যান্যবারের মতো এবরো যাত্রাবাড়ী, তেজগাঁও ও বাড্ডা এলাকা থেকে বেশি রোগী আসছে। বিশেষ কোনো কারণে ওই সব এলাকা থেকে বেশি সংখ্যক রোগী আসছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই সব এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। বিপুলসংখ্যক নিু আয়ের লোক এসব এলাকায় বসবাস করে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালেও বাড়ছে গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। তীব্র গরমে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগে শিশু এবং বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ঢামেক চিকিৎসকরা।

সরেজমিনে ঢামেক জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, রোগী আর স্বজনদের উপচে পড়া ভিড়। টিকিট কাউন্টারের ইনচার্জ তরিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, গত চার-পাঁচ মাসে প্রতিদিন গড়ে ১১০০-১২০০ রোগী আসত। কিন্তু চলমান তীব্র দাবদাহে কয়েকদিন ধরে এ সংখ্যা গড়ে ১৫০০-তে গিয়ে ঠেকেছে। তরিকুল ইসলাম জানান, রোববার টিকিট কেটে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৪৯০ জন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই গরমজনিত রোগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশু। এখন প্রায় প্রতিদিনই ২০০-২৫০ শিশুর চিকিৎসা দিতে অভিভাবকরা আসছেন, যা আগে ছিল সর্বোচ্চ ১২০-১৫০।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ইনচার্জ ডা. আয়েশা বেগম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে সাতশ রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে দেশের ২০টি জেলায় ডায়রিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব চলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

চিকিৎসকরা বলছেন, তীব্র গরমের ফলে শরীর থেকে অতিরিক্ত ঘাম বের হয়। ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় লবণও বের হয়ে যায়। ফলে শরীরের রক্তচাপ কমে যায়, দুর্বল লাগে, মাথা ঝিমঝিম করে। যারা বাইরে কাজ করেন, প্রয়োজন মতো পানি পান করার সুযোগ পান না, তারাই মারাত্মক পানি স্বল্পতার শিকার হন। ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ এবং মূলত বিশুদ্ধ পানির সংকটের কারণেই মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।

এছাড়া অতিরিক্ত গরমের কারণে খাবারে দ্রুত পচন ধরছে। সেই খাবার খেয়েও অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। গরমে অতিষ্ঠ মানুষ রাস্তাঘাট ও ফুটপাতে অস্বাস্থ্যকর শরবত পান করেও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

নিরাপদে থাকার পরামর্শ দিতে গিয়ে ঢামেক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুদীপ রঞ্জন দেব বলেন, বেশি করে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। খোলা বা বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। রাস্তা বা ফুটপাতের সরবত এবং এ ধরনের পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সবার ঘরে খাবার স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানি রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, শিশুদের ঘাম যাতে কম হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। পাতলা জামা-কাপড় পরাতে হবে। ঘাম হলে বার বার সুতির কাপড় বা গামছা দিয়ে মুছে ফেলতে হবে। খাবারের মেন্যুতে টাটকা শাকসবজি ও ফল রাখতে হবে। ফ্রিজে সংরক্ষিত ফলমূল বর্জনের পরামর্শ দেন তিনি। কারণ এতে খাবারের পুষ্টিগুণ থাকে না।

তীব্র গরমে করণীয় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, গরমে বাতাসে আর্দ্রতা বেশি। এ কারণে মশার উপদ্রপ বেড়েছে। মশার কারণে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ডায়রিয়া, আমাশয়ের মতো রোগ হচ্ছে।

এছাড়া হঠাৎ করে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে কল-কারখানায় যারা কাজ করেন, রোদে রাস্তাঘাটে বের হন তারা হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। এ জন্য সচেতন থাকতে হবে। গরম থেকে বাঁচতে ডাবের পানি, বাসায় তৈরি শরবত ও ওরস্যালাইন খাবার পরামর্শ দেন বিশিষ্ট এই চিকিৎসক।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!