• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
আজ ভয়াল মাগুরছড়া দিবস

সবাই ধারণা করেছিল কেয়ামত হচ্ছে!


সেলিম আহমেদ, জেলা প্রতিনিধি জুন ১৪, ২০১৭, ০২:৪৩ পিএম
সবাই ধারণা করেছিল কেয়ামত হচ্ছে!

মৌলভীবাজার: রাত ১২/১টার পর প্রচণ্ড জোরে বিস্ফোরণের শব্দে পাড়ার সবার ঘুম ভেঙে যায়। কী হয়েছে কেউ কিছু বুঝতে পারছিলাম না। পুরো আকাশের রঙ ভয়াবহ লাল হয়েছিল। এলাকার বেশিরভাগ মানুষ কেয়ামত হচ্ছে ধারণা করে। কান্নাকাটি শুরু করে দেন। পাড়ার মসজিদে মাইকিং করে বলা হচ্ছিল আপনারা সবাই দোয়া করুন। বিশাল বিপদ আমাদের সামনে ঘনিয়ে আসছে।

এভাবেই মাগুরছড়ায় গ্যাস ক্ষেত্র বিস্ফোরণের সময়ের কথা বর্ণনা করছিলেন নাফিজ মুনতাসির। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি একজন। বিস্ফোরণের সময় গ্যাস ক্ষেত্র এলাকার কাছেই ছিলেন।

নাফিজ বলেন, সারারাত আর কেউ ঘুমাইনি। ভোর হতেই ঘটনার কারণ বুঝতে পারল সবাই। দ্রুত এলাকা ছাড়তে শুরু করলো মানুষজন।

সেটা ছিল ১৯৯৭ সালের ১৪ জুনের মধ্য রাত। সে কথা মনে হলে আজও এলাকার মানুষ আতঁকে উঠেন। আজ সেই ১৪ জুন। ভয়াল মাগুরছড়া দিবসটির আজ ২০ বছর পূর্তি। 

১৯৯৭ সালের এদিন মধ্যরাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ মাগুরছড়া গ্যাস কূপে বিস্ফোরণের মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গাছপালা জীবজন্তুসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। বিস্ফোরণে চা বাগান, বনাঞ্চল, বিদ্যুৎলাইন, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকূপ, মৌলভীবাজার স্ট্রাক্চার, গ্যাস রিজার্ভ, পরিবেশ, প্রতিবেশ, ভূমিস্থ পানি সম্পদ, রাস্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আগুনের তেজস্ক্রিয়তায় গলে যায় রেলপথ, জ্বলে ছারখার হয়ে যায় কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ। মারা যায় হাজার হাজার বন্যপ্রাণী ও পাখী। পুড়ে যায় ভূ-গর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাস।

সরকারের তদন্তে প্রমাণিত হয় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের অদক্ষতার কারণে এ দুঘর্টনা ঘটে। যার ক্ষতি নির্ধারণ করা হয় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ২০ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজও বিস্ফোরণকারী মার্কিন কোম্পানির কাছ থেকে আদায় করা হয়নি যথাযথ ক্ষতিপূরণ। 

অক্সিডেন্টালের কাছ থেকে গ্যাস ক্ষেত্র ইউনিকলের হাত বদল হয়ে চলে যায় মার্কিন কোম্পানি সেভরনের কাছে। এখন সেই সেভরন বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে গ্যাস ক্ষেত্র চীনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ আজও আদায় হয়নি।

মাগুরছড়া পুঞ্জির মন্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) জিডিশন প্রধান সুচিয়াঙ বলেন, ‘সেই দিনের কথা মনে হলে এখনও আমরা আঁতকে উঠি। সারা জীবনই হয়তো সেই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে। ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু টাকা পেয়েছিলাম, কিন্তু বড় ক্ষতি পুষিয়ে দেয়নি কেউ।’ ফুলবাড়ি চা বাগানের শ্রমিক অনিক ভূঁইয়া বলেন, ‘তখন আমি আরো ছোট ছিলাম। এলাকায় নানা জাতের পশু-পাখির দেখা পেতাম, কিন্তু আগুন লাগার পর এখন অনেক প্রাণীর দেখাই পাওয়া যায়না।’

মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের অদক্ষতায় লাগা আগুন গ্যাসকূপের ৮৫০ ফুট গভীরতায় পৌঁছালে বিস্ফোরণে পুড়ে যায় ভূ-গর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাস। যার তৎকালীন মূল্য প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। গ্যাস ছাড়া পরিবেশ ও অন্যান্য ক্ষতির পরিমাণ সেই সময় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। অক্সিডেন্টাল যৎসামান্য ক্ষতিপুরণ দিয়ে ইউনিকল নামে একটি কোম্পানির কাছে গ্যাস ক্ষেত্র বিক্রি করে বাংলাদেশ থেকে চলে যায়।

পরবর্তীতে ইউনিকল মার্কিন কোম্পানি সেভরনের কাছে গ্যাসকূপ বিক্রি করে এদেশ ত্যাগ করে। এখন সেভরন ও তাদের সম্পদ বিক্রি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোন উদ্যোগ নেই সরকারের। তবে পরিবেশবাদী, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আজও আন্দোলন করছেন। 

লাউয়াছড়া জীববৈচিত্র রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক জলি পাল বলেন, ‘সেই বিষ্ফোরণে লাউয়াছড়ার প্রায় ২৫ হাজার গাছ পুড়েছিলো আর জীববৈচিত্রের ক্ষতির কোন সঠিক হিসেব কেউ করেনি। সেই ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ এখনো লাউয়াছড়া বয়ে বেড়াচ্ছে। সেভরন এই দেশ থেকে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগেই যা করার করতে হবে, নয়তো কোন দিন আমরা এই ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবোনা।’

মৌলভীবাজার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) মিহির কুমার দো বলেন, ‘তৎকালীন সময়ে লাউয়া ছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রায় ৭শ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল গাছ পালা ধ্বংস হয়। জীববৈচিত্র মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে একটি কমিটির মাধ্যমে ক্ষয়-ক্ষতিক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হলেও এখন পর্যন্ত কোন ক্ষতিপূরণ বন বিভাগ পায়নি।’

সোনালীনিউজ/প্রতিনিধি/ঢাকা/আতা

Wordbridge School
Link copied!