• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাংগঠনিক যোগসূত্র ছাড়াও আত্মীয়তায় আবদ্ধ জঙ্গিরা


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৬, ০১:৩৬ এএম
সাংগঠনিক যোগসূত্র ছাড়াও আত্মীয়তায় আবদ্ধ জঙ্গিরা

গুলশান ও শোলাকিয়াসহ গত এক বছরে সংগঠিত পাঁচটি জঙ্গি হামলায় জড়িতরা পরস্পর পরিচিত ও বন্ধু। শুধু সাংগঠনিক যোগসূত্র নয়, আত্মীয়তার বন্ধনও রয়েছে তাদের মধ্যে। এসব হামলার একটির সঙ্গে আরেকটির যোগসূত্রও পাওয়া গেছে।

পুলিশ বলছে, জোনায়েদ খান ও ইব্রাহিম খান নামের দুই সহদোর গুলশান হামলার পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত ছিল। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় সম্পৃক্ত জোনায়েদ খানের সর্বশেষ অবস্থান ছিল কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায়। পুলিশ এখন ওই দুই সহোদরকে খুঁজছে।

জঙ্গি হামলা ও জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের ঘটনায় করা মামলাগুলোর তদন্তসংশ্লিস্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কল্যাণপুরে অভিযানে আহতাবস্থায় গ্রেফতার করা রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং মাঠ পর্যায়ে তদন্তে এসব জঙ্গি হামলার মধ্যে তারা যোগসূত্র পাচ্ছেন। জঙ্গিরা একই স্থানে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, তাদের প্রশিক্ষকও অভিন্ন। কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানা পাওয়ার পর এসব বিষয় স্পস্ট হয়ে উঠছে। ওই আস্তানায় অভিযানের পর গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলা বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া গেছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কমিউনিটি অ্যান্ড সোস্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান মো. তাজুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিদের সঙ্গে মাদকাসক্তদের মিল রয়েছে। সমমনা বন্ধুদের প্রলোভনে যারা মাদকাসক্ত হয় একইভাবে তারা জঙ্গিবাদেও আক্রান্ত হয়। তা একই পরিবারেও হতে পারে। মনস্তাত্ত্বিক দীক্ষার আদর্শিক বন্ধন বেশি থাকলে, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ঘনিষ্ঠভাবে পরিবারে অন্যদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। এতে ভাই ভাইয়ের মধ্যে জঙ্গি আসক্তি হতে পারে।

এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, মাদকাসক্তরা পরিবার ও সমাজ থেকে যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়, একইভাবে জঙ্গিরাও বিচ্ছিন্ন হয়। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বা জীবনধারায় পরিবর্তন আসাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে জঙ্গিবাদে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে চিহ্নিত করা যাবে। সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বা পরিবারের সঙ্গে যোগযোগ কম থাকাদের সম্পর্কে খোঁজ রাখতে হবে।

গত ১ জুলাই রাতে জঙ্গিরা গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় আক্রমণ করে। ৭ জুলাই ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিায় ঈদগাহ ময়দানের কাছে জঙ্গি হামলা হয়। ২৫ জুলাই রাতে রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। এর আগে গত বছরের ২৪ নভেম্বর পুরান ঢাকার হোসনী দালানে তাজিয়া প্রস্তুতি মিছিলে জঙ্গি হামলা, ২২ অক্টোবর গাবতলী এবং ওই বছরের ৪ নভেম্বরে ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের ওপর জঙ্গি হামলা করা হয়।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সংবাদ প্রতিদিনকে বলেন, গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলাকারী জেএমবি সদস্যরা শোলাকিয়ায় হামলা চালিয়েছে। কল্যাণপুরের আস্তানার জঙ্গিরাও গুলশানের মতো বড় হামলার পরিকল্পনা করছিল। তিনি বলেন, সব জঙ্গি হামলা ও পরিকল্পনা একই সূত্রে গাথা।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর সেনা কমান্ডো অভিযানে নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলাম, শোলাকিয়ার ঈদগাঁও ময়দানের কাছে হামলার সময় নিহত জঙ্গি আবির হোসেন এবং কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গিদের তিনজন (সাজ্জাদ রউফ ওরফে মরক্কো, তাজুল হক রাশিক ও আকিফুজ্জামান) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, ক্যাম্পাসে থাকতেই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল। ঢাকায় হামলার আগে নিবরাস ইসলাম ও আবির হোসেন ঝিনাইদহে জঙ্গি আস্তানায় একসঙ্গে ছিলেন। ২ জুলাই সকালে গুলশানে সেনা কমান্ডো অভিযানে নিহত জঙ্গি নিবরাস কল্যাণপুরে নিহত শেহজান রউফ ওরফে অর্ক ও মীর সামেহ মোবাশ্বেরের বন্ধু ছিলেন। পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসাধীন জঙ্গি রাকিবুল হাসান জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, পুলিশের অভিযানে নিহত সব জঙ্গিকেই তিনি চেনেন। এর আগে তারা মিরপুরের কয়েকটি আস্তানায় রায়হান কবিরের (নিহত) অধীনে প্রশিক্ষণ নিলেও একপর্যায়ে তাদের একটি গ্রুপকে গাইবান্ধায় পাঠানো হয়েছিল।

তদন্তসংশ্লিস্ট কাউন্টার টেররিজমের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নব্য জেএমবির কয়েকটি সেল রয়েছে। এর মধ্যে গুলশান হামলায় একটি সেল ও শোলাকিয়ায় অন্য সেল হামলার দায়িত্বে ছিল। কল্যাণপুরের নতুন সেলকে হামলার জন্য প্রস্তুত করে তোলা হচ্ছিল। কল্যাণপুরে পুলিশের বিশেষায়িত দল সোয়াতের অভিযানে তাদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষক রায়হান কবির ও মগজ ধোলাইয়ের দায়িত্বে থাকা আব্দুল্লাহসহ ৯ জঙ্গি নিহত হন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির নেতা রায়হান কবির ওরফে তারেক, গুলশান ও শোলাকিায় হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গিদের প্রশিক্ষক ছিলেন। গুলশানে হামলাকারীদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। আশুলিয়ায় পুলিশ হত্যা মামলার আসামি হিসেবে তাকে খোঁজা হচ্ছিল।

তদন্তসংশ্লিস্ট কর্মকর্তারা বলেন, সাম্প্রতিক হামলাগুলোর পরিকল্পনা অভিন্ন জায়গা থেকে হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা বলছেন, নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান ও জুনায়েদ খান নামের পলাতক তিন জঙ্গি গুলশান, কল্যাণপুর ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি গ্রুপের অন্যতম সমন্বয়ক ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন। তাদের ধারণা এই জঙ্গিগোষ্ঠীর অর্থও আসে একই স্থান থেকে।

আরো হামলায় সংশ্লিষ্টতা : পুলিশ জানায়, ২৫ জুলাই রাতে পুলিশের অভিযানে কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে পালানোর সময় আহত জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যানের বাড়ি বগুড়ায়। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোহাইমিনুল শিহাবকে সম্প্রতি বগুড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফ মন্ডল সংবাদ প্রতিদিনকে বলেন, মোহাইমিনুল শিহাবকে গ্রেফতারের পর জঙ্গি রাকিবুল হাসান ও মাসুদ রানার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার তথ্য পায় পুলিশ। গত বছরের অক্টোবরে এই তিন জঙ্গি এক সঙ্গে ঢাকায় ঢোকে।

ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন সংবাদ প্রতিদিনকে বলেন, জঙ্গি প্রশিক্ষক রায়ান কবির আশুলিয়ায় তল্লাশি চলাকালে হামলা চালিয়ে পুলিশ সদস্য মুকুলকে হত্যা করে। আবার গুলশানে হামলাকারী খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল পুরান ঢাকার হোসনী তাজিয়া প্রস্তুতি মিছিলে হামলায় জড়িত ছিলেন।

একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বরে জঙ্গি খায়রুল, রায়হান কবির আশুলিয়া ও গাবতলীর তল্লাশি চৌকি ও হোসনী দালানের হামলার পর উত্তরবঙ্গে জঙ্গি আস্তানায় চলে যান। সেখান থেকে তারা টাঙ্গাইলে অবস্থান করতে থাকেন। পরে তারা ঢাকায় এসে জঙ্গি আস্তানায় ওঠেন।

গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে মিরপুর রূপনগর আবাসিক এলাকায় পুলিশের অভিযানে নব্য জেএমবি সদস্য জাহিদুল  ইসলাম নিহত হন। এ ঘটনায় রূপনগর থানার ওসি সৈয়দ সহিদ আলম ও পরিদর্শক (তদন্ত) শাহীন ফকির ও এসআই মমিনুর রহমানসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন। নিহত জঙ্গির বাড়ি কুমিল্লা সদরের পাঁথুবি চাঁন্দপুর মৌজায়। তার বাবা নুরুল ইসলাম সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন,  নিহত জঙ্গির প্রকৃত নাম আড়াল করে জাহাঙ্গীর ছদ্মনামে সে মানুষের কাছে পরিচিত হতো। নতুন ধারা জেএমবির প্রশিক্ষক হিসেবে সে কাজ করত। তিনি আরো বলেন, জাহাঙ্গীর পরিচয়ে সে জেএমবি সদস্যদের বাসা ভাড়া করে দিত। মিরপুর রূপনগর এলাকায় ৩৩ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর বাসাটি জাহাঙ্গীরের নামে ভাড়া নেন।

এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় যে জঙ্গি আস্তানায় গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম নিহত হন, ওই বাসাটি ছাড়াও কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানাটিও জাহাঙ্গীরের নামে ভাড়া নিয়েছিলেন এই জাহিদুল।    

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!