• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিটিং সার্ভিস বন্ধে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ১৭, ২০১৭, ১০:১৯ পিএম
সিটিং সার্ভিস বন্ধে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’

ফাইল ফটো

ঢাকা: রাজধানী ও এর আশপাশে গণপরিবহনের সিটিং, গেটলক ও স্পেশাল বাস সার্ভিস বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এ সিদ্ধান্তের পাশাপাশি গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ ও বাম্পার অপসারণ এবং সরকার নির্ধারিত ভাড়া তালিকা না ঝুলানোসহ অন্যান্য অনিয়ম বন্ধে চলছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান।

জরিমানা করা হচ্ছে অভিযুক্তদের। অভিযানে সহায়তা করছে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি। এমনকি পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা না আসা পর্যন্ত অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এর আগে গত ৪ এপ্রিল ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে দেশে প্রথমবারের মতো সিটিং সার্ভিস প্রথা বাতিল করার ঘোষণা দেয়। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে ঢাকা ও এর আশপাশে সিটিং, গেটলক, স্পেশাল বা ডাইরেক্ট সার্ভিসের নামে কোনো বাস ও মিনিবাস চলতে পারবে না। নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকে যাত্রী তুলতে ও নামাতে হবে। ভাড়া আদায় করতে হবে সরকার নির্ধারিত হারে। অর্থাৎ মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ৫ টাকা ও বাস ভাড়া ৭ টাকা।

এ ব্যাপারে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, দীর্ঘদিনের অনিয়ম তো এক দিনে বন্ধ হবে না। তবে আমরা প্রতিদিনই অভিযানে থাকব। এভাবে চললে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সড়কপথে বাস্তবচিত্র ছিল অনেকটা আগের মতোই। অভিযান এলাকা ছাড়া অন্যান্য সড়কে ঠিকই সিটিং সার্ভিস চলেছে এবং আগের ভাড়াই আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আর যে পাঁচ রুটে অভিযান চলেছে, সেখানে গণপরিবহনের সংখ্যা ছিল কম। দিনভর সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাসের হেলপারদের কথা-কাটাকাটি, এমনকি হাতাহাতির ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে।

অবশ্য সিটিং সার্ভিস বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তকে অপরিকল্পিত বলে মত দিয়েছেন দেশের নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সরকার কোনোপ্রকার বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই তড়িঘড়ি এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেমেছে। এর জন্য পৃথক কোনো কাঠামো তৈরি করেনি। যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘবে অতিরিক্ত যানবাহনের ব্যবস্থাও রাখেনি। এমনকি দীর্ঘ নজরদারির জন্য যে টেকসই ব্যবস্থা দরকার, তারও কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে এই উদ্যোগ কতুটুকু বাস্তবায়ন হবে-তা নিয়েও প্রশ্ন ও সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে তাদের মধ্যে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মোয়াজ্জেম হোসেন সিটিং সার্ভিস বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তকে ‘ইঁদুর-বেড়াল’ খেলা বলে মত দেন।

তিনি বলেন, দেশের পরিবহন খাতে প্ল্যানিং থেকে পরিচালনা-সব ক্ষেত্রে অনিয়ম। সেখানে সিটিং সার্ভিস বন্ধের উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে-তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তা ছাড়া হঠাৎ করেই এমন সিদ্ধান্ত কতটুকু যুক্তিযুক্ত-সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সিটিং সার্ভিস বন্ধের যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, সেটি অপরিকল্পিত, বৈজ্ঞানিক নয়। টেকসই অপারেশন হবে না। বরং কিছুদিন আরো বিশৃঙ্খলা চলবে। জনগণের দুর্ভোগ বাড়বে। তারপর এক সময় মানুষ বিরক্ত হয়ে সেই আগের সিটিং সার্ভিসেই ফিরে যাবে।

সিটিং সার্ভিসসহ পরিবহন খাতে অনিয়ম দূর করতে এই সড়ক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ লন্ডন, সিঙ্গাপুর, এমনকি পার্শ্ববর্তী কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থা অনুসরণ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যেহেতু এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা; তাই এর জন্য স্থায়ী ও টেকসই ব্যবস্থা দরকার। নেটওয়ার্ক বাড়াতে হবে। দক্ষ অতিরিক্ত লোকবল আনতে হবে। বিআরটিএ বা পুলিশ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। টেকসই পদ্ধতি দরকার।

একই বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটের অপর নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, উদ্যোগ ভালো, তবে বাস্তবসম্মত নয়। কারণ সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যেকোনো কাজ ধীরস্থিরভাবে করতে হয়। তড়িঘড়ি করে করলে সফলতা আসে না।

আমার কাছে মনে হয়েছে, সরকার সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তড়িঘড়ি করে, কোনো প্রকার গবেষণা না করেই। এর জন্য প্ল্যানিং দরকার। মূল সমস্যা কী, সিটিং সার্ভিস বন্ধ করতে গেলে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে এবং সে সমস্যার সমাধানে কী ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে-সেসব সিটিং সার্ভিস বন্ধের আগেই নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। ফলে দুর্ভোগ বেড়েছে।

‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দুই-এক দিন অভিযান চালিয়ে সিটিং সার্ভিসের নামে ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ করা যাবে না। এর জন্য স্থায়ী বাস্তবায়ন কাঠামো চাই। স্থায়ী নজরদারি লাগবে। কারণ পরিবহন খাতে এসব বিশৃঙ্খলা অনেক পুরনো। এক দিনে বা রাতারাতি সমাধান হবে না। সিটিং সার্ভিস বন্ধে যেসব অভিযান চলছে, সেগুলো যেন লোকদেখানো না হয়।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সিটিং সার্ভিস বন্ধ নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জনগণকে দুর্ভোগের মুখে পড়তে না হয়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!