• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিমেন্ট শিল্পের মুনাফায় ধস


বিশেষ প্রতিনিধি জুন ২৫, ২০১৮, ১০:১৪ এএম
সিমেন্ট শিল্পের মুনাফায় ধস

ঢাকা : চলতি বছর সারা বিশ্বে সিমেন্টের দর বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে প্রায় ৮ শতাংশ। তারপরও দেশের সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর মুনাফায় ধস নেমেছে। মূলত প্রধান কাঁচামাল ক্লিঙ্কার, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনে এক্সেল লোড নীতিমালা কার্যকর হওয়ায় পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।

সিমেন্ট খাত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ক্লিঙ্কারের দাম গত এক বছরে প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বেড়েছে সমুদ্র পরিবহন খরচ। গতবছর গ্যাসের মূল্য বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। ফলে দেশে উৎপাদন পর্যায়েই প্রতিবস্তা সিমেন্টের পেছনে ব্যয় বেড়েছে ৪০ টাকার বেশি। এর সঙ্গে চলাচলে এক্সেল লোড নীতিমালা কার্যকর হওয়ায় দেশের ভেতরে পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। এসবের যোগফলে কমে গেছে সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা। যদিও চলতি বছর নির্মাণ খাতের এ পণ্যটির বিক্রি বেড়েছে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে সিমেন্ট শিল্পকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়েছে। অসময়ের অতিবৃষ্টি ও দীর্ঘস্থায়ী বর্ষার কারণে গতবছর নির্মাণ খাতে মন্থরগতি নেমে আসে। ফলে সিমেন্ট বিক্রিতে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি হয়নি অনেক কোম্পানির। আর উৎপাদন খরচ বাড়ায় বেশিরভাগ কোম্পানির পরিচালন মুনাফা কমে যায়। লোকসানেও পড়ে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান। চলতি বছরও আর্থিক মন্দায় রয়েছে এ খাতটি।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছে কনফিডেন্স সিমেন্ট কোম্পানি। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটির পরিচালন মুনাফা তলানিতে নেমেছে। সহযোগী কোম্পানির আয় না এলে চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে এটি লোকসানে চলে যেত। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ হিসাব বছরের তুলনায় চলতি হিসাব বছরের নয় মাসে কনফিডেন্স সিমেন্টের বিক্রি বেড়েছে ৫ শতাংশ। বিপরীতে একই সময়ে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১০ শতাংশ। এ সময়ে কোম্পানিটির পরিচালন মুনাফা হয় ৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সুদ বাবদ ব্যয় দাঁড়ায় ৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ফলে তৃতীয় প্রান্তিক শেষে এর পরিচালন লোকসান দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। অথচ আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির পরিচালন মুনাফা ছিল ২০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। অবশ্য অপরিচালন আয় এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান কনফিডেন্স ইলেকট্রিক লিমিটেড ও কনফিডেন্স পাওয়ার লিমিটেড থেকে প্রাপ্ত আয়ের কারণে কোম্পানিটি নয় মাসে ২৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা নিট মুনাফা করে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ শতাংশ কম।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড। অন্য কোম্পানিগুলোর তুলনায় অন্তত ১০ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হয় হোলসিম ব্র্যান্ডের সিমেন্ট। হোলসিম অধিগ্রহণের পর বিনিয়োগকারীরা লাফার্জহোলসিমের শেয়ার নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছিলেন। তবে চলতি প্রথম প্রান্তিকে এর মুনাফার চিত্রে হতাশ তারা। প্রতিষ্ঠানটির সিমেন্ট বিক্রি বেড়েছে ৯০ শতাংশ। ক্লিঙ্কারের নিজস্ব খনি থাকার পরও এর উৎপাদন ব্যয় ১০ শতাংশ বেড়েছে। যদিও অন্য কোম্পানিগুলোর তুলনায় লাফার্জহোলসিমের উৎপাদন খরচ কিছুটা কম। তালিকাভুক্ত অন্য সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ব্যয় যেখানে বিক্রির ৮৭ শতাংশ, সেখানে লাফার্জহোলসিমের ৭৯ শতাংশ। অবশ্য বিক্রিতে উল­ম্ফন ঘটলেও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সে অনুযায়ী বাড়েনি মুনাফা।

হোলসিম অধিগ্রহণের আগে ২০১৬ সালে এককভাবে লাফার্জ সুরমা সিমেন্টের নিট মুনাফা ছিল ২২২ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে তা নেমে আসে ৮০ কোটিতে। আর চলতি প্রথম প্রান্তিকে ৯০ শতাংশ বিক্রি বাড়লেও নিট মুনাফা মাত্র ২২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। অথচ আগের বছরে একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৩০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

দুই বছরের ব্যবধানে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি হাইডেলবার্গ সিমেন্ট কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৪ শতাংশের বেশি। চলতি বছর প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি বেড়েছে ১১ শতাংশ। অথচ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কমেছে নিট মুনাফা। চলতি প্রথম প্রান্তিকে মুনাফা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম।

চট্টগ্রামকেন্দ্রিক টিকে গ্রুপ, সিকম গ্রুপ ও জিপিএইচ গ্রুপের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার সিমেন্ট। এ কোম্পানিটির বিক্রিতে উলে­খযোগ্য প্রবৃদ্ধি না হলেও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি। একই সময়ে বেড়েছে সুদ বাবদ খরচ। এতে নয় মাসে এর নিট মুনাফা হয়েছে ২৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৩ শতাংশ কম।

চলতি হিসাব বছরে এমআই সিমেন্টের বিক্রি বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। অথচ কোম্পানিটির নিট মুনাফা আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। চলতি হিসাব বছরের নয় মাসে এমআই সিমেন্টের নিট মুনাফা হয়েছে ১৭ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৭ শতাংশ কম। স্থায়ী আমানত থেকে প্রাপ্ত সুদ ও অন্যান্য আয় না থাকলে এ আয় নেমে যেত তলানিতে।

জানতে চাইলে এমআই সিমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ খান বলেন, সিমেন্ট শিল্প ২০১৭ সালে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছে। অসময়ের অতিবৃষ্টি ও দীর্ঘস্থায়ী বর্ষার কারণে গতবছর সিমেন্ট বিক্রিতে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি কিছু কোম্পানির। বিপরীতে এ সময়টাতে কাঁচামাল ও জ্বালানি ব্যয় বাড়ায় মুনাফা কমে গেছে। চলতি বছর বড় বড় প্রকল্পের কাজ চলায় সিমেন্টের চাহিদা বেড়েছে, সঙ্গে দামও। তবে উৎপাদন ব্যয় যে হারে বেড়েছে, তাতে এ বছরও মুনাফার চিত্রে খুব বেশি হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

তালিকাভুক্ত সিমেন্ট খাতের সবচেয়ে ছোট কোম্পানি আরামিট। বিক্রি বাড়লেও উৎপাদন ও সুদ বাবদ ব্যয়বৃদ্ধির কারণে ২০১৬ সাল থেকেই লোকসানে রয়েছে এটি। অবশ্য এর বিপরীত চিত্রও আছে। বেশিরভাগ কোম্পানি সঙ্কটে পড়লেও মেঘনা সিমেন্টের মুনাফা বাড়তে দেখা গেছে। আগের বছরের তুলনায় চলতি হিসাব বছরের নয় মাসে এর বিক্রি বেড়েছে ২০ শতাংশ। সব কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও মেঘনা সিমেন্টের উল্টো কমেছে। এতে চলতি হিসাব বছরের নয় মাসে কোম্পানিটির নিট মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২৩ শতাংশ বেড়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!