• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
গুণারত্নের গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন

সিরিয়া-ইরাকের বাইরে আইএস নেই!


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ১৫, ২০১৭, ১০:১৭ পিএম
সিরিয়া-ইরাকের বাইরে আইএস নেই!

ঢাকা: বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) তৎপরতা আছে কি না-এ নিয়ে আবারও বিতর্ক শুরু হয়েছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন দেশের পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনের প্রথম দিন গত রোববার সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেররিজম রিসার্চের পরিচালক রোহান গুণারত্নের ‘গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা করেছিল আইএস, জেএমবি নয়’-এমন মন্তব্যের জের ধরে আবারও আলোচনায় এসেছে আইএস প্রসঙ্গ।

গুণারত্নের এমন মন্তব্য শুধুই কি কথার কথা, নাকি এর আদৌ কোনো সত্যতা রয়েছে, তা যেমন আলোচিত হচ্ছে নানা মহলে; তেমনি এ ধরনের মন্তব্য বহু দিন ধরে বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র প্রমাণে চলে আসা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ কি না-প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। উঁকি দিচ্ছে এমন সন্দেহ-সংঘটিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনা শুধুই কি অভ্যন্তরীণ জঙ্গিগোষ্ঠীর কাজ, নাকি এর সঙ্গে আইএস বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর গোপন যোগসূত্র রয়েছে?

এ নিয়ে গত কয়েকদিনে সরব দেশ। দেশে আইএস থাকা নিয়ে গুণারত্নের মন্তব্য সরাসরি নাকচ করেছে সরকার। আইএস না থাকার পক্ষে শক্ত তথ্য-প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছে। পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনের শেষ দিন মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে ইসলামিক স্টেট বা আন্তর্জাতিক অন্য কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পর্ক নেই।

এর আগে গত সোমবার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হকও গুণারত্নের বক্তব্য ‘সমর্থনযোগ্য নয়’ দাবি করে বলেন, আইএসের সঙ্গে এ দেশের জঙ্গিদের কোনো যোগাযোগ নাই। ‘হোম গ্রোন’ বা দেশীয় জঙ্গিদের আইএস অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া বা অন্য কোনো কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে যোগাযোগ থাকতে পারে।

এমনকি রোহান গুণারত্নের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন দেশের জঙ্গি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা। তারা তথ্য-প্রমাণাদির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, গুণারত্নের জঙ্গিবৃত্তিকে মদদ দেন। এসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেন। বিশেষ করে তিনি এ মুহূর্তে ভারতের হয়ে কাজ করছেন বলেও দাবি করেন। তারা পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনে উপস্থাপিত গুণারত্নের জঙ্গিবিষয়ক গবেষণা ও তথ্য-প্রমাণাদির সত্যতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার দাবি জানান।

এর আগে ২০১৫ সালে প্রথম দেশে আইএসের তৎপরতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। সে বছরের ১৮ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীর খানবাড়ী চৌরাস্তা এলাকার একটি বাড়ি থেকে চার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, বাংলাদেশ থেকে আইএস সদস্য সংগ্রহের জন্য গোপন বৈঠক করার অভিযোগে এদের গ্রেফতার করা হয়।

পরে তদন্ত শেষে গ্রেফতার হওয়া একজন বাংলাদেশে আইএসের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছিলেন বলেও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়। এর পরপরই গত বছর ১৬ এপ্রিলে ‘কৌশলগত অবস্থানের’ কারণে বাংলাদেশে শক্ত ঘাঁটি গড়তে চায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট আইএসের মুখপাত্র অনলাইন সাময়িকী দাবিক-এর ১৪তম সংস্করণে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকার দেশের গণমাধ্যমে এলে আইএসের বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। এর পর সে বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে গত বছরের ২২ মার্চ পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে ১৫টি হামলার দায় স্বীকার করে আইএস।

এর মধ্যে দুই বিদেশি নাগরিক, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও পুলিশ হত্যা, আহমদিয়া মসজিদ ও শিয়া মসজিদে হামলাসহ শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর একাধিক হামলা হয়। বিশেষ করে গত বছরের ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান, শোলাকিয়াসহ কয়েকটি হামলার ঘটনার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশ এ ঘটনা আইএসের বলে বিবৃতিও দেয়। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে আবারও বলা হয়, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই।

অবশ্য শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে আইএসের তৎপরতার দাবি নাকচ করে আসছেন। ২০১৫ সালে আইএস প্রসঙ্গ নানাভাবে আলোচনায় এলে তখন এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে জঙ্গি সংগঠন আইএসের তৎপরতার কথিত অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করতে দেশি ও বিদেশি সংঘবদ্ধ চক্রের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চলছে।

বাংলাদেশের ওপর যেন এ কারণে হামলে পড়তে পারে, সে জন্য এ ধরনের চেষ্টা হচ্ছে। বিভিন্ন মহল এ দেশেও সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও লিবিয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে আইএসের উপস্থিতির কথা স্বীকার করাতে আমাদের ওপর চাপ দিচ্ছে। তারা ওইসব দেশের মতো আমাদের দেশকেও বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে চায় এবং এটাই হচ্ছে তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ।

দেশে আইএস আছে এবং হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অসত্য বলেছেন-জঙ্গি বিশেষজ্ঞ গুণারত্নের এমন বক্তব্য কতটুকু সত্য, জানতে গতকাল দেশের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে প্রতিদিনের সংবাদের কথা হয়। তারা বলেন, বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব রয়েছে-এ বিষয়টি প্রমাণে আন্তর্জাতিক একটি পক্ষ এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে আইএসের অস্তিত্ব প্রমাণে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে।

কিন্তু কেন-জানতে চাইলে এসব বিশেষজ্ঞ বলেন, সমুদ্রসীমাসহ প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রভাবশালী সবকটি দেশ এখানে তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চায়। ফলে আইএস ইস্যুকে কেন্দ্র করে আশপাশের দেশ ও পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা চিন্তা করে।

একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতে, এই গোষ্ঠী দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগাতে চায়। সামনে যেহেতু নির্বাচন এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মতানৈক্য চলছে; ষড়যন্ত্রকারী চক্র সেই সুযোগ নিতে চাইছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসবে এখন এ বিষয়টি আরো সামনে আসবে। জাতীয় স্বার্থে আঘাত এলেই বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা চলবে। তাই সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, গুণারত্নের প্রকৃত অর্থে গবেষক নন, প্রাতিষ্ঠানিক (একাডেমিক) গবেষক। শ্রীলঙ্কার হলেও তিনি মূলত ভারতকেন্দ্রিক গবেষক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। তবে তিনি ভারতমুখী। এই গবেষণার মধ্য দিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা প্রমাণের চেষ্টা করেছে নিজেদের স্বার্থে। তারা চায় এখানে তাদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে।

বাংলাদেশে আইএস নেই-দাবি করে এই বিশ্লেষক বলেন, আইএস মূলত ইরাক ও সিরিয়াকেন্দ্রিক সংস্থা। তাদের লক্ষ্য শিয়া সম্প্রদায়। তারা সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে যায় না। কিন্তু গুণারত্নের সেদিকে না গিয়ে আইএসকে ইসলামের আচার-আচরণের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। এখানে যেহেতু কিছু ঘটনা ঘটেছে এবং সেগুলোর সঙ্গে ইসলাম জঙ্গিবাদের আচরণের মিল পেয়েছেন। তাই সেটাকে ব্যবহার করে আইএস প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।

অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান আরো বলেন, বাংলাদেশের বড় শত্রু হয়ে উঠছে-এ দেশের উন্নয়ন। তাছাড়া জঙ্গি দমনে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অনেক প্রভাবশালী দেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এখন বিষয়টি সহ্য করতে পারছে না। বাংলাদেশকে জঙ্গি দেশে পরিণত করতে পারলে প্রভাবশালী দেশগুলো এখানে প্রবেশের সুযোগ পাবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, প্রভাবশালী দেশগুলো এই ইস্যুতে বড় রাজনৈতিক বিরোধী শক্তিকে ব্যবহারের চেষ্টা করবে। সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারের উচিত সবকিছু খোলাসা করা।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!