ঢাকা: রাজধানীর বনানী থেকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ ‘নিখোঁজ’ চার তরুণকে ঘিরে রহস্য আরো ঘনীভূত হচ্ছে। ‘নিখোঁজের’ ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও তাদের বিষয়ে কোনো ‘উল্লেখ করার মতো কিছু’ পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তারা স্বেচ্ছায় বাসা থেকে বেরিয়েছে, নাকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থা তাদের তুলে নিয়ে গেছে, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমনকি তাদের অপহরণ করা হয়েছে কি না, তা-ও জানাতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
যদি অপহৃতও হয়, তবে প্রাথমিক আলামত হিসেবে ‘অপহরণকারীদের’ পক্ষ থেকে পরিবারের কাছে মুক্তিপণও দাবি করেনি কেউ। ‘সন্দেহভাজন আসামি’ হিসেবেও তাদের গ্রেফতার করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থা। তবে কোথায় ‘লাপাত্তা’ হয়ে গেল এই চার তরুণ। তবে কি তারা স্বেচ্ছায় ‘জঙ্গি’ কার্যক্রমে অংশ নিতেই ‘লাপাত্তা’ হয়েছেন?
কোনও সমীকরণই মেলাতে পারছে না পরিবার ও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। পরিবারের সদস্য ও পুলিশ কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থায়ও খোঁজ নিয়েছে। এই চারজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে বলেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাদের এই হঠাৎ ‘নিখোঁজ’ হওয়ার খবরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
গত ১ ডিসেম্বর রাতে বনানীর কাঁচাবাজার এলাকার নর্দান ক্যাফে থেকে খাবার খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর একসঙ্গে ‘নিখোঁজ’ হন সাফায়েত হোসেন, জায়েন হাসান খান পাভেল, মোহাম্মদ সুজন ও মেহেদী হাসান নামের চার তরুণ। তাদের মধ্যে সাফায়েত ও পাভেল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
সাফায়েত সম্প্রতি লেখাপড়া স্থগিত রাখলেও পাভেল ইলেকট্র্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের শেষ সেমিস্টারের ছাত্র। আর মেহেদী গত ২৬ নভেম্বর চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। অন্যদিকে ‘নিখোঁজ’ সুজন নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকেরের এশিয়াটিকে কাজ করতেন।
নিখোঁজের ঘটনায় পরিবারের পক্ষে বনানী থানায় পৃথক দুটি জিডি হয়েছে। জিডির তদন্তকারী বনানী থানার এসআই সোহেল রানা বলেন, ঘটনার পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সর্বশেষ যেখানে তাদের একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল, সেই রেস্টুরেন্টের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। আশপাশে বিভিন্ন ভবনের ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। চারজনের মোবাইল ফোনের কললিস্ট টালি করা হচ্ছে।
রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য মিলিয়ে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, ঘটনাস্থলের আশপাশের আরো কিছু ফুটেজ সংগ্রহ হলে এবং তাদের কললিস্টের মাধ্যমে ‘নিখোঁজ’ রহস্যের উন্মোচন হবে শিগগিরই। এসআই সোহেল রানা আরো বলেন, রেস্টুরেন্টের যে ফুটেজ পাওয়া গেছে, সেখানে চারজনই খুব স্বাভাবিক ছিলেন। তারা সেখানে খেয়ে স্বাভাবিক মুডেই বেরিয়ে ছিলেন। একজনের কাছে একটি ব্যাকপ্যাক ছিল, অন্যরা খালি হাতেই ছিলেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চার তরুণের মধ্যে সাফায়েতের কর্মকা- দেখে তাকে জঙ্গিবাদে ‘র্যাডিক্যাল’ (উৎসাহী) মনে হয়েছে। তার মাধ্যমে অন্যরা ‘র্যাডিক্যালাইজড’ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চারজনের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে সাফায়েতের জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ার বিষয়ে সন্দেহ করছে পুলিশ। সাফায়েত বিতর্কিত ও সিরিয়াকেন্দ্রিক বিভিন্ন ইসলামি নেতার বয়ান ফেসবুকে শেয়ার করতেন।
আর যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থা তাদের তুলে নিয়ে থাকে, তাহলেও সাফায়েতের ফেসবুক কর্মকা-ের কারণেই তুলে নিয়ে গেছে। তার সঙ্গে থাকার কারণে অন্য তিনজনকেও তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, র্যাব এই নামে কাউকে আটক করেনি।
পুলিশের সন্দেহ, নিখোঁজ তরুণরা স্বেচ্ছায় কোনো ধর্মীয় উগ্রপন্থি সংগঠনের সঙ্গে যোগ দিয়ে থাকতে পারেন। কারণ গুলশান হামলার পর এ রকম অনেক ‘নিখোঁজ’ ঘটনায় দেখা গেছে, স্বেচ্ছায় পালিয়ে গিয়ে সেসব তরুণ জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, উগ্র-জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যারা ঘর ছেড়েছেন, তাদের বেশির ভাগই মাসের শুরুতে অথবা শেষে বাসা থেকে বেড়িয়ে যান। বনানীর চার তরুণও গত ১ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। এ কারণে তাদের উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। এমনকি নিখোঁজ হওয়ার আগের দৈনন্দিন কার্যক্রম সেই সন্দেহ আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ওই কর্মকর্তা জানান, গুলশানসহ অন্যান্য জঙ্গি আস্তানায় নিহত জঙ্গিদের সবাই স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলেন।
গুলশান হামলায় নিহত তাওসিফ ও নিবরাস ৩ ফেব্রুয়ারি একসঙ্গে ঘর ছাড়েন। আর ২৯ ফেব্রুয়ারি ঘর ছেড়েছিলেন মীর সামিহ মোবাশ্বের। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ঘর ছেড়েছিলেন রোহান ইমতিয়াজ। এরপর সর্বশেষ তাদের দেখা মেলে ১ জুলাই গুলশানের আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলায়। তারা সবাই যৌথ অভিযানে নিহত হয়।
এদিকে নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা বিশ্বাসই করতে পারছেন না, তারা স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে যেতে পারে কিংবা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। এ বিষয়ে তারা কোনো ধারণাও করতে পারছেন না। ‘নিখোঁজ’ পাভেলের বাবা ইসমাইল হোসেন খান রাসেল বলেন, পাভেলের সঙ্গে সাফায়েত ও সুজনের বন্ধুত্ব ছিল। সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাফেতে গিয়ে স্যুপ খেয়েছে। এরপর থেকে পাভেলের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি আরো জানান, তার ছেলে খুব বেশি ধার্মিকও নয়। উল্টো তিনি নিজে শুক্রবার জুমার নামাজে জোর করে নিয়ে যেতেন। ‘র্যাডিক্যাল’ হওয়ার কোনো লক্ষণও তিনি কখনো বুঝতে পারেননি। ‘নিখোঁজ’ সুজনের বড়ভাই সুমন বলেন, সুজন ছোটবেলা থেকেই আলী যাকেরের পরিবারের সঙ্গে বনানীর গলফ হাইটস ভবনে থাকত। ওই বাসাতেই সে বড় হয়েছে। কাজ করত আলী যাকেরের মালিকানাধীন বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকে। উত্তরার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আইটি বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছে। সুজন কখনোই নামাজ পড়ত না। ও ছিল সংস্কৃতিমনা। তাই সুজন জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকতে পারে না। ওকে কেউ (পুলিশ) তুলে নিয়ে থাকতে পারে।
আরেক ‘নিখোঁজ’ মেহেদীর চাচা মাহবুব হাওলাদার বলেন, মেহেদী বরিশালের বিএম কলেজে মাস্টার্স করছিল। গত ২৬ নভেম্বর সে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় এসেছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সে সুজনের সঙ্গে দেখা করতে বনানী গিয়েছিল। এরপর থেকেই সে নিখোঁজ রয়েছে। সাফায়েতের এক স্বজন জানিয়েছেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে বনানীর সি ব্লকের বাড়িতেই থাকত সাফায়েত। পাভেল সাফায়েতের বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই। তারা একসঙ্গে নর্থ সাউথে পড়ত। তবে সাফায়েত কেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছে, তা তিনি জানেন না।
সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি
আপনার মতামত লিখুন :