• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সূরা আসরের তাৎপর্য


প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল হালিম মে ২৯, ২০১৬, ০২:২৬ পিএম
সূরা আসরের তাৎপর্য

সূরা আসর পবিত্র কুরআনের অতি সংক্ষিপ্ত এক সূরা এর আয়াত সংখ্যা মাত্র তিন। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই সূরা অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত। সূরার অন্তর্নিহিতভাব এক দিকে মানুষের জন্য সুস্পষ্ট সতর্কবাণী অন্য দিকে সঠিক পথ তথা সত্য পথ প্রাপ্তির এক দিকনির্দেশনা। সূরার বাংলা অনুবাদ নিুরূপ :

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি
১. কসম যুগের, ২. নিশ্চিত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, ৩. কিন্তু, তারা নয় যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাগিদ করে সত্যের এবং তাগিদ করে সবরের।

৩ নম্বর আয়াতটি অপেক্ষাকৃত একটু দীর্ঘ তবে এর মধ্যে উল্লিখিত চারটি শব্দ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যথা আমানু : যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, আমলে সালেহাত : যারা সৎকর্ম করে; ... ...। আল-হাক্ক : সত্য এবং... সবর : ধৈর্য।

আয়াত নম্বর ১ কসম যুগের এই আয়াতে প্রথমেই একটা হোঁচট খেতে হয়। কারণ মানুষই সাধারণত কসম নেয় মহান আল্লাহর নামে।

যেমন বলা হয়, কসম আল্লাহর বা আল্লাহর কসম। কিন্তু এখানে আল্লাহ নিজেই কসম নিচ্ছেন তাও আবার যুগকে সম্বোধন করে। এর অন্তর্নিহিত অর্থ কী? আসলে আল্লাহ যখন কোনো বস্তু, বিষয় বা প্রাকৃতিক ঘটনা উল্লেখ করে কসম নেন তখন সেই নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপের জন্যই এরূপ করা হয়। মানব জীবনে যুগ বা কালের যে এক অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে তা নির্দেশ করতেই এই আয়াতে যুগ বা কালের শপথ নেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে এ ধরনের কসম পরিদৃষ্ট হয় এতে করে বিষয় বা বস্তুটির বিশেষত্ব প্রকাশ পায়।

যেমন : ‘... কসম ঝঞ্ঝা বায়ুর’ ৫১:১-২ ‘পথবিশিষ্ট আকাশের কসম’ ৫১:৭ ‘তারকারাজির অস্তাচলের শপথ করেছি’ ৫৬:৭৫ ‘শপথ করি সন্ধ্যাকালীন লাল আভার ও রাত্রির এবং তাতে যা সমাবেশ ঘটে এবং চন্দ্রের যখন তা পূর্ণরূপ ধারণ করে’ ৮৪:১৬-১৮ ‘শপথ গ্রহ-নক্ষত্র শোভিত আকাশের’ ৮৫:১ ইত্যাদি। এসব কসম বা শপথের উদ্দেশ্য হলো নির্দিষ্ট বস্তুটির ওপর গুরুত্ব আরোপ এবং এর অন্তর্নিহিত ভাব ও অর্থের অনুধাবন করা।

যুগ কথাটি অত্যন্ত অর্থবহ এবং খুবই তাৎপর্যমন্ডিত। প্রশ্ন জাগে : যুগ কী? যুগ বলতে কী বোঝায়? যুগ হলো কাল, সময় বা কালপ্রবাহ। পৃথিবীর তাবৎ ঘটনা যুগ বা কালে সংঘটিত হয় এমন কোনো বিষয় বা বস্তু পাওয়া যাবে না যা কালের অন্তর্গত নয়। যা কিছুই ঘটে তা কালপ্রবাহেই ঘটে এ যেন সৃষ্টির এক অমোঘ বিধান।

হজরত আদম আ:-এর দুনিয়ায় আগমন, নূহ আ:-এর প্লাবন, ইব্রাহিম আ:-এর অগ্নিকুন্ডে নিরাপদ অবস্থান, মূসা আ:-এর দরিয়া পার, ঈসা আ:-এর জন্মরহস্য এবং সর্বোপরি হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মিরাজ ঘটনা এবং মক্কা বিজয় সবই কালপ্রবাহে সংঘটিত। এর আগেও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আদ-সামুদ জাতির পতন এ যুগ বা কালেই ঘটেছে এক কথায় সমগ্র মানব জাতি-গোষ্ঠীর ইতিহাস কাল বা যুগেই আবর্তিত হচ্ছে, হবে। তাই কালপ্রবাহের সীমাহীন সাক্ষীকে গৌণ করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। আল্লাহ সে-ই গুরুত্বপূর্ণ যুগের কসম নিয়েই বলেন, ২ নম্বর আয়াত ‘নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।’

মানব জীবন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সব কাল বা যুগেই সে ক্ষতি ও বিপদসংকুল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। দু:খ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, বিপদ-আপদ দ্বারা সে জর্জরিত। মায়ের প্রসব যন্ত্রণা থেকে সৃষ্টি হয়ে শিশুর প্রতিটি ধাপ ও স্তর প্রতিকূলতার মুখোমুখি জীবন অস্থির, চঞ্চল, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ভরা, কোথাও শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। প্রতিনিয়তই সে ব্যক্তিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংগ্রামে রত মরণ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এ দুর্বিপাক ও রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে নিজ বুদ্ধি ও কৌশল প্রয়োগে।

এই শোচনীয় দশার মূর্তিমান দৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলছেন : মানুষ সত্যিই বিপদগ্রস্ত-ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় পতিত হয়ে আছে তবে সব মানুষ নয়, এর ব্যতিক্রম আছে, এর ছাড় আছে। কারা সে-ই ছাড়পত্র পাওয়া মানুষ? এর উত্তর আগে উল্লিখিত ৩ নম্বর আয়াতে চার শব্দে ব্যাখ্যায়িত হয়। যেমন ক. আমানু, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে খ. আমেলু সালিহাত, যারা সৎকর্ম করে, গ. যারা আল-হাক্ক সত্যে তাগিদ দেয় এবং ঘ. সবর যারা ধৈর্য ধারণ করে।

প্রথম দু’টি যথা : বিশ্বাস ও সৎকর্ম হলো অনেকটা আসংশোধনমূলক বিষয়। অন্য দিকে সত্য ও সবর হলো হেদায়াত ও সংশোধন সম্পর্কিত। বিশ্বাস তথা ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো দৃঢ় বিশ্বাস। ইসলামের পরিভাষায় মুহাম্মদ সা: আল্লাহর তরফ থেকে যে কিতাব (আল কুরআন) প্রাপ্ত হন তার ওপর এবং মুহাম্মদ সা: যে পথ প্রদর্শন করে গেছেন এর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন হলো ঈমান। অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস মৌখিক স্বীকারোক্তি এবং সেই মোতাবেক সৎকর্ম পালন এ তিনের সমনয় হলো ঈমান। অর্থাৎ কথায়-বিশ্বাস-কাজের বাস্তব প্রতিফলন হলো ঈমান বা বিশ্বাস। বিশ্বাস হলো সব কর্মের মূল ভিত্তি এবং এর ওপরই নির্ভর করে কর্মের গ্রহণযোগ্যতা। যাদের ঈমান ও আমল পূর্ণতা লাভ করেছে তারাই সফলকাম ইসলামের ধারক ও বাহক। ঈমান অন্তর থেকে সূচিত এবং বাহ্যিক ক্রিয়াকর্মে এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে এবং পূর্ণতা লাভ করে। ঈমান ও আমল পূর্ণাঙ্গতা লাভ করলেই তা গ্রহণযোগ্য হয় বা অনুমোদন লাভ করে। প্রকাশ্য ক্রিয়াকলাপ আন্তরিক বিশ্বাসে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত তা গ্রহণযোগ্য হয় না।

আল-হাক্ক বা সত্যের তাগিদ দেয় সত্য কী! সত্যের অর্থ বিশুদ্ধ বিশ্বাস বা খালেছ বিশ্বাস। বিশ্বাস যেহেতু সৎকর্মকে অন্তর্ভুক্ত করে তাই সত্যের অর্থ হয় : বিশ্বাস ও সৎকর্মের যোগফল অর্থাৎ এ ঈমানেরই পরিপূর্ণ রূপ। প্রশ্ন জাগে : ঈমান বা বিশ্বাস কার ওপর? বিশ্বাস আল্লাহর ওপর, তাঁর কিতাবের ওপর, তাঁর প্রেরিত নবীর ওপর এবং তাঁর নির্দেশিত পথের ওপর। সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায়, ইসলামের ওপর। সূরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে এর একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যায়। যেমন উক্ত হয়েছে : ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং রাসূলগণের ওপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য।

আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে-রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণকারী তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী আর তারাই পরহেজগার।’ (বাকারা : ১৭৭) বর্ণনায় আল কুরআন এবং মহানবী সা: কর্তৃক অনুসৃত নীতিকেই সত্যের পথ বিশ্বাসের পথ বলে পরিব্যক্ত হয়েছে। এ বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়ে যদি সৎ-আমল করা হয় এবং বাস্তবে তা প্রতিফলন হয় তাহলে সফলতা আসে জীবন পূর্ণতা পায় এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা যায় এবং সঠিক পথের সন্ধান মিলে।

তবে বলা বাহুল্য যে, এ পথ মসৃণ নয় পদে পদে বাধা রয়েছে, প্রতিবন্ধকতা রয়েছে রয়েছে অসহনীয় যন্ত্রণাবোধ। শুধু কল্যাণেই মুক্তি নয়, বিশ্বাস ও সৎকর্মের বিস্তৃতি ঘটাতে হয় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। সত্যের প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও সহিষ্ণু বন্ধুর পথকে সুগম করে স্থির লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

মহাপুরুষদের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা সর্বদাই সত্যের পথে অটল ও অনড় থেকেছেন সব বিপদ-আপদ, দু:খ-বেদনা সবই অকাতরে সহ্য করে গেছেন এবং পরিণামে জয়ী হয়েছেন। হজরত নূহ আ:, হজরত ইব্রাহিম আ:, হজরত মূসা আ:, হজরত ঈসা আ:-এর ঈমানী দৃঢ়তা, সৎকর্মে নির্ভীকতা, সত্যের সুদৃঢ়তা এবং সবরের পরম সহিষ্ণুতা আমাদের জীবনে অনুকরণীয় আদর্শ তাঁরা এবং তাঁদের প্রকৃত অনুসরণকারীরা সূরা আসরের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা থেকে ছাড় পাওয়ার সেই অনন্য মহান ব্যক্তিত্ব।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, এমসি কলেজ, সিলেট

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!