• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সেই ‘জজ মিয়া’ এখন...


সোনালী বিশেষ আগস্ট ২০, ২০১৭, ১০:০১ পিএম
সেই ‘জজ মিয়া’ এখন...

ঢাকা: ২১ আগস্ট এলেই গ্রেনেড হামলায় হতাহত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি আরেকটি নাম ঘুরে ফিরে আসে। তিনি নোয়াখালীর জজ মিয়া। এ ঘটনায় তদানীন্তন চার দলীয় জোট সরকার যে মামলা সাজায়, তাতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করা হয়েছিল তাকে। মামলাটির অন্যতম ‘আসামি’ ছিলেন তিনি।

মামলায় তাকে হামলায় অংশগ্রহণকারী হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু, এতবড় ঘটনাটি নোয়াখালীর একজন সাধারণ মানুষ কী করে বাস্তবায়ন করলেন সেই সূত্র না মেলায় গোয়েন্দা সংস্থার সাজানো এই চিত্রনাট্যটি গণমাধ্যমসহ সব মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

হামলার শিকার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলীয় রাজনৈতিক নেতারাও সাফ জানিয়ে দেন ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছেন জজ মিয়া। অবশেষে অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি পান জজ মিয়া, এখন এই মামলার অন্যতম সাক্ষীও তিনি। কিন্তু, মুক্তি পাওয়ার পর এখন কোথায় থাকেন জজ মিয়া।

অনুসন্ধান চালিয়েও তার খোঁজ মেলেনি। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে। তবে জজ মিয়াকে দেয়া কথা কেউ-ই রাখেননি। ঘটনার সঙ্গে জড়িত না হয়েও তিনি জেল খেটেছেন, হারিয়েছেন ভিটেমাটি, হয়েছেন নিঃস্ব।

আক্ষেপ ভরাকণ্ঠে করে রোববার (২০ আগস্ট) বলেন, ‘গ্রেফতারের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তিন কর্মকর্তা আমাকে বলেছিল, ‘আমরা তোকে রাজসাক্ষী বানাব। যেসব কথা শিখিয়ে দেব, আদালতে সেসবই বলবি। যাদের নাম বলতে বলব তারা বড় সন্ত্রাসী।

জেল থেকে বের হলে তারা তোকে মেরে ফেলতে পারে। তাই জেল থেকে বের হওয়ার পর তোকে সপরিবারে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেব। সেখানে তুই আরাম-আয়েশে থাকবি।’ তাছাড়া বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকেও আমাকে অনেক আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু কেউ-ই কথা রাখেনি। তাই এখন আমাকে একটি ভাঙাচোরা প্রাইভেট কার চালিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে।’

জজ মিয়া বলেন, ‘আমার পরিচয় জানার পর (জেল থেকে বের হওয়ার পর) কেউ-ই আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। সবাই মনে করে, সরকার বদল হলে আমাকে ফের জেলে যেতে হবে। বছরখানেক আগে পরিচয় গোপন করে চাঁদপুরে বিয়ে করি। কিন্তু আমি গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি ছিলাম- এটা জানার পর ৮-৯ মাস আগে স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

এখন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক এলাকায় পাঁচ হাজার টাকা ভাড়ায় একটি টিনশেড বাসায় থাকি। দুই রুমের এ বাসায় আমি ছাড়াও থাকেন ছোটবোন খোরশেদা (১৯), ছোটভাই সাইফুল ইসলাম (১৭) ও বৃদ্ধ মা জোবায়দা খাতুন।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিলেন দলীয় প্রধান ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। কিন্তু হামলাটি সফল না হওয়ায় অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে না পারায় মামলাটির তদন্তের নামে মূল আসামিদের দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা চালায় তদানীন্তন জোট সরকার।

হাস্যকরভাবে প্রধান আসামি করা হয় জজ মিয়াকে। ঘটনার ১০ মাসের মাথায় ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কেশার পাড় ইউনিয়নের বীরকোট গ্রামের কালি মন্দির সংলগ্ন রাজা মিয়ার চা দোকান থেকে জজ মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।

এরপর আদালতে ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সে জবানবন্দিতে প্রধান কুশীলবদের নাম না আসায় দেশজুড়ে শুরু হয় নিন্দার ঝড়। গণমাধ্যম এটিকে ‘জজ মিয়া নাটক’ হিসেবে অভিহিত করে। ২০০৮ সালে তাকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। পরে আদালত এ মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। ২০০৯ সালে মুক্তি পান জজ মিয়া।

জজ মিয়ার পৈত্রিক ভিটার স্বজনরা জানান, বিনা দোষে টানা চার বছর জেলের ঘানি টানতে গিয়ে প্রচুর দেনা হয়ে যায় তার। অভাব অনটনের সংসারে যারা সহযোগিতা করেছিলেন তারা প্রদেয় অর্থ ফেরত চাইলে ২০০৯ সালে নিজের সাড়ে ৭ শতাংশ পৈত্রিক জমি দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাইদের কাছে ১ লাখ ৪২ হাজার টাকায় বিক্রি করে নোয়াখালী ছাড়েন জজ মিয়া। 

এখন প্রাইভেটকার চালিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন জজ মিয়া

তিনি কোথায় চলে গিয়েছেন-এই প্রশ্নের উত্তরে তার স্বজনরা জজ মিয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত কোনও তথ্য দিতে পারেননি। একই বাড়ির ইমাম উদ্দিন জানান, জজ মিয়া ছোটবেলা থেকে ঢাকায় থাকতেন। সেখানে তিনি কী করতেন তা আমরা জানি না। বর্তমানে জজ মিয়া কোথায় জানতে চাইলে ইমাম উদ্দিন জানান, শুনেছি ঢাকার নারায়ণগঞ্জ থাকেন। এখন কী করছেন তাও তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।

জজ মিয়ার সম্পত্তি ক্রেতা আলী আক্কাছের স্ত্রী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, মামলা মোকদ্দমায় পড়ায় দায় দেনা হয়ে পড়ায় সম্পত্তি বিক্রি করতে চাইলে আমার স্বামী, ভাসুর, দেবররা চার ভাই মিলে জজ মিয়ার সাড়ে ৭ শতাংশ সম্পত্তি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকায় কিনেছেন। জায়গা বিক্রি করে যাওয়ার পর জজ মিয়া আর বাড়িতে আসেনি। আমার শ্বাশুড়ি জজ মিয়ার কাছ থেকে কেনা জায়গার ওপরের কুঁড়েঘরে থাকেন।

জজ মিয়াকে যে দোকান থেকে আটক করা হয় সেই বীরকোট কালি মন্দির এলাকার চা দোকানদার রাজা মিয়া জানান, ‘জজ মিয়ার বাবা আবদুর রশিদ মারা যাওয়ার পর জজ মিয়া এলাকায় আসে। আসার কয়েক দিনের মধ্যে সে গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে খবরে শুনেছি সে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। এরপর এলাকায় এসে পৈত্রিক ভিটা বাড়ি বিক্রি করে ঢাকায় চলে যায়। এখন কী করেন কোথায় আছে আর জানি না।’

তবে এরপরেও আরও একবার এলাকায় এসেছিলেন জজ মিয়া। কেশার পাড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হক জানান,‘২০১৩ সালে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সরকারি নিবন্ধন শুরু হলে জজ মিয়া এলাকায় এসেছিল। সেও মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য আবেদন করতে ইচ্ছুক ছিল। কিন্তু, নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সে আর নিবন্ধন না করেই ঢাকা ফিরে যায়। এরপর আর এলাকায় আসেনি।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের চারশ’ নেতা-কর্মী।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/জেএ 

Wordbridge School
Link copied!