• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সেন্স ফিরে দেখি স্লিপিং ড্রেসে আমি তার বিছানায়


নিউজ ডেস্ক জানুয়ারি ৮, ২০১৮, ০৪:২৩ পিএম
সেন্স ফিরে দেখি স্লিপিং ড্রেসে আমি তার বিছানায়

ঢাকা: ‘মার খেয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। সুস্থ করার কথা বলে আমাকে ওষুধ খাওয়ায়, তারপর আর কিছু বলতে পারি না। পরদিন ১২টা বা ১টার দিকে সেন্স আসার পর দেখতে পাই আমি তার (ডিআইজি মিজান) বেডরুমে। আমার যে সালোয়ার-কামিজ পরা ছিল সেটা নেই। তার স্লিপিং ড্রেস পরা। বুঝতে পরি রাতে আমার সঙ্গে কিছু ঘটেছে।’ এভাবেই ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি) মিজানুর রহমানের কুকীর্তির কথা জানান তার স্ত্রী মরিয়ম আক্তার ইকো।

মরিয়মকে বিয়ে আগেই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসে নির্যাতন করে রাতে তার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করেন পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। 

দ্বিতীয় বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রী মরিয়ম আক্তারকে গ্রেপ্তার করান মিজানুর রহমান। তিন সপ্তাহ কারাভোগের পর সপ্তাহখানেক আগে মরিয়ম জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। নতুন করে তাকে মামলায় জড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে মরিয়মের পরিবার।

জানা গেছে, ব্যাংক কর্মকর্তা মরিয়ম আক্তারকে গত বছরের জুলাই মাসে বিয়ে করেন মিজানুর রহমান। ২০১৯ সাল পর্যন্ত সেই কথাটি গোপন রাখার শর্ত দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। মরিয়ম রাজি হননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি গত ১২ ডিসেম্বর পুলিশ পাঠিয়ে মরিয়মকে গ্রেপ্তার করান। মিজানুর রহমান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন, সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

ব্যাংকে চাকরির একটি ঝামেলা নিয়ে বান্ধবীর পরিচিত জনৈক নারীর মাধ্যমে মোবাইল ফোনে মিজানের সাথে প্রথম পরিচয় হয় মরিয়ম আক্তার ইকোর। এরপর থেকে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য প্রায়ই ফোন দিতেন মিজান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অশোভন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা এবং রহস্যময় আচরণে শুরু হলে পুলিশ কর্মকর্তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন মরিয়ম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতারণা ও জবরদস্তির আশ্রয় নেন মিজান।

ভুক্তভোগীর অভিযোগ, গত ১৪ জুলাই মিজান তাকে ফোন দিয়ে বলেন নিজের আচরণের জন্য তিনি খুবই দুঃখিত, ক্ষমাপ্রার্থী। মরিয়ম এতে ক্ষমা করে দিলে মিজান বলেন, তিনি একটিবার সাক্ষাৎ করে সরাসরি দুঃখ প্রকাশ করতে চান। এতে রাজি না হওয়ায় হুমকি দেয়া শুরু করেন পুলিশ কর্মকর্তা। 

জানান, সাক্ষাৎ করতে না এলে তিনি মরিয়মের বাসা আসবেন। ফোন ট্রাকিংয়ের মাধ্যমে মরিয়মের ব্যক্তিগত বিভিন্ন কথাবার্তা ও যাবতীয় তথ্য তার কাছে আছে বলেও ইঙ্গিত দেন।

বাধ্য হয়ে মরিয়ম পান্থপথের বাসা থেকে বের হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে দেখা করতে গেলে কৌশলে তাকে প্রাইভেট কারে উঠিয়ে পূর্বাচলে নিয়ে যান ডিআইজি মিজান। সেখানে ৩শ ফুট সড়কের পাশে নামিয়ে মরিয়মকে মারধর করা হয়। আহত অবস্থায় চোখ বেঁধে গাড়িচালক গিয়াস এবং দেহরক্ষী জাহাঙ্গীরের সহায়তায় বেইলি রোডের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চার মাস ধরে চলতে থাকে নির্যাতন।

মূল ঘটনার সংক্ষেপ
চাকরির জন্য বান্ধবীর পরিচয় সূত্রে এক নারীর মাধ্যমে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজানুর রহমানের সঙ্গে প্রথমে মুঠোফোনে পরিচয় হয় মরিয়ম ইকোর। এরপর তিনি তাকে ফোনে কথা বলার সময় অশোভন ইঙ্গিত দিতেন। বোঝাতে চাইতেন তার প্রথম স্ত্রী বিদেশে থাকেন। তাকে নিয়ে সংসার করবেন না। ইকোকে তার খুব পছন্দ ইত্যাদি। 

কিন্তু এর মধ্যে কানাডা প্রবাসী এক ব্যক্তির সঙ্গে ইকোর বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক হয়ে যায়। টেলিফোনে আড়ি পেতে যার আদ্যোপান্ত জানতে পারেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজান। এরপর ক্ষমা চাওয়ার কথা বলে ১৪ জুলাই ইকোকে তাদের পান্থপথের বাসা থেকে এক রকম কৌশলে তার গাড়িতে তুলে জোরপূর্বক ৩০০ ফুট এলাকায় নিয়ে যান। 

সেখানে মারধর করে রাতে ইকোকে তার বেইলি রোডের বাসায় নিয়ে আসেন। সেখানে তাকে সুস্থ করার কথা বলে অসুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে ফেলেন। এ সময় সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের ডাক্তার বন্ধু বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন গাজী শামীম হাসান উপস্থিত ছিলেন। 

মরিয়ম ইকো পরদিন দুপুর ১২টার দিকে ঘুম থেকে জেগে দেখতে পান তার পরনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজানের স্লিপিং ড্রেস এবং তিনি তার বেডরুমে।

বুঝতে পারেন, তার সর্বনাশ হয়ে গেছে। এরপর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে আত্মহত্যা করবেন বলে দৌড়ে রান্নাঘর খুঁজতে থাকেন। এ সময় তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের দু’জন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী ও গাড়িচালক। ওদের ঠেলে ফেলে তিনি রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে ওড়নায় আগুন লাগিয়ে দেন।

আত্মহত্যার ভঙ্গিতে ডিআইজি মিজান

এ সময় খবর পেয়ে ডিএমপি কার্যালয় থেকে ছুটে আসেন মিজানুর রহমান। ইকোকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। আশ্বাস দেন তাকে দ্রুত তার বাসায় রেখে আসবেন। ইকোর প্রশ্নের মুখে তিনি আগের রাতে ড্রেস খুলে ফেলাসহ খারাপ আচরণের জন্য ক্ষমা চান। কিন্তু তাকে শান্ত করতে না পেরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলেন। এভাবে ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ৩ দিন মেয়েটিকে বাসায় আটকে রাখেন তিনি। 

ইকোর বাবা বেঁচে নেই। খবর দেয়া হলে বগুড়া থেকে তার মা কুইন তালুকদার ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় ডিআইজির বেইলি রোডের বাসায় এসে উপস্থিত হন। মেয়েকে কেন এভাবে আটকে রাখা হয়েছে জানতে চাইলে ডিআইজি মিজান ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখেন।

এরপর বলেন, এখান থেকে মুক্তির একটাই পথ আছে। তা হল আপনার মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। এতে মা-মেয়ে কেউ রাজি না হলে টেবিলে ব্যক্তিগত পিস্তল রেখে মা-মেয়েকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। অনেক বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ৫০ লাখ টাকা কাবিনে মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। বিয়ে পড়ানোর জন্য মগবাজার কাজী অফিসের কাজীকে ডেকে আনা হয়। বিয়ের উকিল বাবা হন তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক গিয়াসউদ্দিন। এছাড়া সাক্ষী করা হয় দেহরক্ষী জাহাঙ্গীরকে। বিয়ের পর ওই রাতে মা-মেয়েকে ছেড়ে দেয়া হয়।

পরে লালমাটিয়ায় ৫০ হাজার টাকার ভাড়া ফ্ল্যাটে নিয়ে গোপনে সংসার শুরু করেন ডিআইজি মিজান। ওই ফ্ল্যাটের নিচে সাদা পোশাকে সার্বক্ষণিক পুলিশের দু’জন সদস্যকে পাহারায় রাখা হয়। এর ফলে ইকো এক রকম গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। তার ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু ছিল না। অনেকটা জেলখানার মতো। অনেক চেষ্টা করেও নিজের ভাইকে ফ্ল্যাটে রাখার অনুমতি পাননি। কথায় কথায় তাকে মারধর করতেন ডিআইজি মিজান। এভাবেই কেটে যায় ৪ মাস। 

একদিন তিনি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজানকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দিয়ে অফিসে মুডে থাকা একটি ছবি ফেসবুকে আফলোড করেন। এতেই চরমভাবে ক্ষিপ্ত হন মিজানুর রহমান। এ ছবির বিষয়টি পুলিশের উপর মহলে জানাজানি হয়ে যায়। ফেসবুক থেকে দ্রুত ছবিটি সরিয়ে ফেলতে তিনি লালমাটিয়ার বাসায় ছুটে আসেন। সেখানে বিষয়টি নিয়ে স্ত্রী ইকো, শাশুড়ি কুইন তালুকদারের সঙ্গে তার চরম মাত্রায় বাকবিতণ্ডা হয়।

এদিকে সেপ্টেম্বরের এ ঘটনার পর তাদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। ইকো সমাজিকভাবে ডিআইজি মিজানের স্ত্রী পরিচয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অটল থাকেন। এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় গোপন রেখে বাসা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলা করা হয়। এ মামলায় ইকোকে ১২ ডিসেম্বর পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ১৩ ডিসেম্বর আদালতে হাজির করার পর তার জামিন আবেদন নাকচ হওয়ায় তাকে কারাগারে যেতে হয়। পরে তার বিরুদ্ধে ভুয়া কাবিন করার অভিযোগ এনে আরো একটি মামলা করা হয়। 

আদালত সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদক ভুয়া কাবিননামার মামলাটি অনুসন্ধান করতে গেলে একে একে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার বিস্তারিত বেরিয়ে আসে। সূত্র বলছে, বিষয়টি আঁচ করতে পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মিজান প্রভাব খাটিয়ে কৌশলে তার জামিনের ব্যবস্থা করেন। ২১ দিন কারাভোগের পর তিনি ১ ডিসেম্বর জামিন পান। 

কিন্তু তাকে জামিন দেয়া হয় ভুয়া কাবিননামার মামলার বাদী কাজী সেলিম রেজার জিম্মায়। এর মধ্যে প্রতিবেদক তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিতে সক্ষম হন। তবে বর্তমানে ইকো কোথায় আছেন তা জানা সম্ভব হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে ডিআইজি মিজানের অবস্থান
ডিএমপি সদর দপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রোববার (৭ জানুয়ারি) সকালে সংবাদটি প্রকাশের পর অতিরিক্ত কমিশনার মিজানকে বেশ অস্থির মনে হয়েছে।

অভিযুক্ত ডিআইজি মিজান বলেন, তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ ‘পুরোপুরি মিথ্যা’, আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার ভালো বোঝাপড়া। আমরা পারিবারিক জীবনে সুখী। আমাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য স্বামী বানিয়ে মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে।

অভিযোগকারী নারীকে ‘প্রতারক’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ওই নারী ২০১৫ সালে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি জিডি করেছিলেন। সেই সূত্রে তার সঙ্গে পরিচয়।

ওই নারীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় ভাংচুরের মামলার বিষয়ে মিজান বলেন, গত বছরের ১৬ জুলাই এই নারী বেইলী রোডের তার ভাইয়ের বাসায় জোর করে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। তখন থানায় একটি মামলা হয়। অভিযোগপত্র দেওয়ার পর এটি এখন বিচারাধীন।

ওই নারী কেন ওই বাসায় ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি পুলিশ কর্মকর্তা মিজান। তিনি দাবি করেন, ওই নারী সেসব অভিযোগ করেছিলেন, তা ইতোমধ্যে প্রত্যাহারও করে নিয়েছেন।

তবে মিজানুরের দাবি যে অসত্য, তার প্রমাণ রমনা থানার এজাহার। ওই মামলাটি করেন মিজানুর রহমানের ভাইয়ের বাসার তত্ত্বাবধায়ক আসিফ আরেফিন। মামলার এজাহারে তিনি বলেন, গত ১৬ জুলাই মরিয়ম আক্তার তাঁদের বাসায় ঢুকে গ্যাসের চুলায় আগুন জ্বালিয়ে বাসা জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি দেন ও নিজের ওড়নায় আগুন ধরিয়ে দেন।

জানা গেছে, এই মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রমনা থানা থেকে বগুড়ার শাজাহানপুর থানা বরাবর পাঠানো হয়। সেখান থেকে মোহাম্মদপুর থানার সহযোগিতা চাওয়া হয়। ৫৪ ধারায় সেগুনবাগিচার সেগুন রেস্তোরাঁ থেকে পুলিশ মরিয়মকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।

মিজানের এই বিষয়টি নিয়ে বিভাগীয় কোনো তদন্ত হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশ সপ্তাহের পরে হয়ত এসব বিষয় নিয়ে কথা উঠতে পারে।’

তবে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পুলিশকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আইনের হাত অনেক লম্বা। কেউ অপরাধ করলে পার পাবে না।’ তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।

ভিডিও (দৈনিক যুগান্তর):

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এআই

Wordbridge School
Link copied!