• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
স্মরণ সভায় বক্তারা

সৈয়দ হক ছিলেন সাহিত্যের অমৃতপুত্র


সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিবেদক অক্টোবর ৯, ২০১৬, ১১:০২ পিএম
সৈয়দ হক ছিলেন সাহিত্যের অমৃতপুত্র

ঢাকা: ‘তোমার অসীম প্রাণমন লয়ে...’ এবং ‘জীবন মরণে সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে...’ রবীন্দ্রসংগীতের মধ্য দিয়ে দাঁড়িয়ে শুরু হয় কবি সৈয়দ শামসুল হককে স্মরণ পর্ব। বক্তারা কবিকে সাহিত্যের অমৃতপুত্র হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব সৈয়দ শামসুল হক সৃজনী উৎকর্ষে বাংলা সাহিত্যের সবগুলো শাখাকে সমৃদ্ধ করেছেন। নির্মাণ করে গেছেন আধুনিকতার পথ।

রোববার (৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘সৈয়দ শামসুল হক স্মরণসভায় এসে নানা স্মৃতিচারণায় তাকে স্মরণ করলেন বিশিষ্টজনরা। তাদের আলোচনায় উঠে আসে সৈয়দ হকের সাহিত্য জীবনের নানা ইতিবৃত্ত। উঠে আসে গদ্যের শৈলী, নাটকের সংলাপ ও কাব্য ভাষার কথা। তাদের মতে, সৈয়দ হক নিজ বৈশিষ্ট্যে বাংলা সাহিত্যকে ‘নবীন আবেগে দীপিত’ করেছেন।

সব্যসাচী লেখকের মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য ‘বিরাট ক্ষতি’ হিসেবে উল্লেখ করে তারা বলেছেন, সাহিত্যচর্চা সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির যে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ হল।

স্মরণসভার শুরুতে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বলেন, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সুহৃদ। সকল কর্মের সহযাত্রী। আমৃত্যু তিনি ছিলেন আমাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি ছিলেন বন্ধুর মতো, আমাদের অভিভাবক।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন সৈয়দ হককে ‘অমৃতের পুত্র’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি তখন। হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা সংকলনে তার একটি শিরোনামহীন কবিতাটি পড়লাম। সেই চিনলাম তাকে। তারপর তার ‘রক্ত গোলাপ’ ও ‘কবি’ গল্প দুটিতে শক্তিমান লেখক উদ্ভাসিত হলো আমার চোখে। ‘কবি’ গল্পে প্রতিরোধের সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। যে ধারা রচনা করেছিলেন, সেটি সঠিক পথ দেখিয়েছিলো জাতিকে। ‘রক্ত গোলাপ’ গল্পে জাদু বাস্তবতার এক অসাধারণ উদাহরণ। যা পাঠকের চিন্তার সুরঙ্গকে বিভিন্ন পথে পরিচালিত করবে।

সাতচল্লিশ পরবর্তী ধারায় যারা বাংলা সাহিত্যের শক্তি ও শিল্পমান প্রতিষ্ঠা করেছেন সাহিত্যের স্রোতধারায়, যারা জাতির দিক নির্ধারণ করেন তাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক অন্যতম’ বলেন তিনি। সেলিনা হোসেন মনে করেন, সৈয়দ হকের লেখার শিল্পমূল্যের জায়গা ‘বিশ্লেষণ’ করা প্রয়োজন। 

সৈয়দ হকের সান্নিধ্যকে ‘শোধ না হওয়া ঋণ’ হিসেবে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। তার ‘সীমান্তের আগ্রাসন’, ‘গেরিলা’, ‘কবি’, ‘খেলারাম খেলে যা’সহ নানা কবিতা ও গল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার সাহিত্যে ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। যেন এক খোলা তলোয়ার। এমনটি পুরো বাংলার রচনায় বিশেষ একটা দেখা যায় না। তার কবিতা, গল্পে উঠে আসে অসাধারণ নগর বন্দনা, তরুণ মনের আকুতি-দ্বন্দ্ব।

মফিদুল হক কবির স্মৃতিচারণ করে বলেন, হক ভাই আমাকে বলতেন, ‘আমাদের ভাষাবোধকে ধারণা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী প্রেক্ষাপট নিয়ে বলতেন, ‘ভাষা আন্দোলনের পর আমরা যে বাংলায় লিখলাম, তাও একটা যুদ্ধ।’ তার জীবন সাধনাই ছিল ভাষাবোধ, ভাষার ছন্দ নিয়ে লেখা।

সৈয়দ শামসুল হকের কালজয়ী মঞ্চনাটক ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ এর নির্দেশক ও প্রধান অভিনেতা স্মৃতিকাতর হয়ে বলেন, আমার অভিনীত ‘কোপিনিকের ক্যাপ্টেন’ মঞ্চ নাটকটি দেখে এসে তিনি একদিন আমার হাতে ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ এর চিত্রনাট্য তুলে দিলেন। বিশাল বড় সম্মান হাতে তুলে নিলাম হতভম্বের মতো। আমার কাছে মনে হয়, আসল নুরুলদীন ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক।

আলী যাকের তার বক্তৃতায় সৈয়দ শামসুল হককে বাংলার মঞ্চনাটকে দ্বিজ শিল্পকর্মের ‘জনক’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এই অভিনেতা সৈয়দ হকের ‘ঠাট্টা তামাশা’, ‘টেম্পেস্ট’ ও ‘ম্যাকবেথ’ নাটকগুলোতে প্রধান ও নামভুমিকা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আলী যাকের বলেন, প্রতিটি নাটকে আমি তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি। প্রতিটি নাটক রচনায় শুরু, অভিনয়ে  শেষ। তিনি এই সত্যিকে ধারণ করতেন। তিনি দেখতে পেতেন দিব্য চোখে, তাইতো তিনি এ ধরণের সংলাপ, নাটক তৈরি করেছেন অবলীলায়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, সৈয়দ হকের মূল পরিচয় তিনি সাহিত্যিক ছিলেন। সাহিত্যের প্রতি তার যে নিবেদন, তা খুব কম পাওয়া যায়। সারাক্ষণ অতৃপ্তিতে ভুগতেন তিনি, যা তাকে শুধু ব্যস্ত রাখত। তিনি বলেন, সৈয়দ শামসুল হক যা কিছু স্পর্শ করেছেন, তাই সজীব করে তুলেছেন। অত্যন্ত সাহসী মানুষটির সাহিত্যের প্রতি যে ভালোবাসা দেখেছি তাতে কোনো খাঁদ ছিল না। আচরণে তিনি ছিলেন আধুনিক। বিশ্ব ধ্রুপদী সাহিত্যকে তিনি নিয়ে এসেছেন আমাদের মাঝে। সাহিত্য- সংস্কৃতির পৃথিবীর পরিবেশ মোটেই অনুকূলে নেই যখন তখন শামসুল হক ‘বিরূপ ¯ স্রোতের বিরুদ্ধে’ দাঁড়িয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন এই প্রবীণ শিক্ষাবিদ।

স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বেঙ্গল ফউন্ডেশনের পরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। স্মরণ সভায় সৈয়দ হককে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া অনুষ্ঠানে নাট্যাভিনেত্রী ত্রপা মজুমদার পাঠ করলেন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’- এর ‘মাতবরের বউ’ চরিত্রটির সংলাপের অংশবিশেষ। হাসান আরিফ আবৃত্তি করলেন সৈয়দ হকের কবিতা।

সোনালীনিউজ/এমএন
 

Wordbridge School
Link copied!