• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নপূরণে আর রাজধানীতে আসবেন না রাজীব


বিশেষ প্রতিবেদক এপ্রিল ১৮, ২০১৮, ০১:৪৩ পিএম
স্বপ্নপূরণে আর রাজধানীতে আসবেন না রাজীব

ঢাকা : অনেক স্বপ্ন নিয়ে রাজধানীতে এসেছিলেন ছেলেবেলায় মা-বাবা হারানো পটুয়াখালীর বাউফলের রাজীব হোসেন। করছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রম। সরকারি তিতুমীর কলেজে পড়ার পাশাপাশি কম্পিউটার কম্পোজ, গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ শিখছিলেন তিনি। ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে করছিলেন টিউশনিও।

কিন্তু ১৩ দিন আগে সার্ক ফোয়ারার কাছে দুই বাসের চাপাচাপিতে হাত হারিয়ে ও মাথায় আঘাত পেয়ে সে স্বপ্ন নিভু নিভু করছিল তার। সর্বশেষ গত সোমবার গভীর রাতে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সংগ্রামী এই তরুণের সব স্বপ্নই নিভে গেছে। দুর্ঘটনার একটা পর্যায়ে এমন পরিণতি হয়তো আঁচও করতে পেরেছিলেন তিনি। অনেক অভিমান করে হাসপাতালে একবার বলেছিলেন, ‘রাজীব কে? রাজীব তো মারা গেছে!’ তারপর খাওয়া-দাওয়া, কথাবার্তা সব বন্ধ সাত দিন। অভিমানী মুখ যেন বলতে চাইছিল- ‘আমি এক অসহায় দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দুই ছোট ভাইকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে আগাচ্ছিলাম। কী এমন অপরাধ করেছি যে আমার হাত কেড়ে নিলে।’

রাজীব আসলে কার সঙ্গে অভিমান করেছিলেন, সেটা আর কখনো জানা হবে না। গত সোমবার গভীর রাতে ছোট দুই ভাই মেহেদী ও আবদুল্লাহসহ কোটি কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। তারপর অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বস্তরে আলোচনার বিষয় ছিল- এমন অকালমৃত্যু কি থামবে না? অনেকেই বলছিলেন, এই শহর রাজীবের মতো তরুণের হাত নিল, প্রাণও নিল। শাস্তি হবে কি তার এমন মৃত্যুর জন্য দায়ী বেপরোয়া বাসচালকদের? এর আগে দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় রাজীবের হাত হারানোর ঘটনায়ও তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

এ ঘটনায় করা মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজীবের পরিবারের আবেদনে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে ৩০৪-এর খ ধারায় তদন্ত হবে। পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, তদন্তে ঘটনায় যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে দুর্ঘটনার পরদিন এক রিট আবেদনে রাজীবকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না-তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। তবে সেই রুলের নিষ্পত্তির আগেই তার মৃত্যু হলো। এ অবস্থায় রিট আবেদনটির ভবিষ্যৎ কী- জানতে চাইলে আবেদনকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল গতকাল জানিয়েছেন, রাজীবের মৃত্যু হলেও রিট আবেদনের নিষ্পত্তি হবে। আদালত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিলে সেটা তার পরিবারই পাবে।

গত ৩ এপ্রিল দুর্ঘটনার দিনই রাজীবের হাতটি আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার মামা মো. জাহিদ জানান, চিকিৎসকরা যখন দেখেছেন, রাজীবের হাত আর জোড়া লাগানো কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তখন এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ভাগ্নে আমার চলে গেল। আরো ছোট্ট দুটি ভাগ্নে এতিম হয়ে গেল।’

গতকাল শেষ আশ্রয়ের জন্য রাজীব চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। আর কখনো স্বপ্ন দেখার জন্য তাকে ফিরতে হবে না এ শহরে, ফেরা হবে না ছোট্ট দুই ভাইয়ের কাছেও। রাজীবের ছোট ভাই মেহেদী হাসান হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের মেডিকেল সংবাদদাতাকে বলেন, ‘বাবা-মা মারা গেলেও তাদের হারানোর কষ্ট বুঝিনি। ভাইয়াই ছিল আমাদের মা-বাবা। তিনিও চলে গেলেন। আপনারাই বলুন- আমরা এখন কী করব? কার কাছে যাব?’

রাজীবের এমন চলে যাওয়া মানতে পারছেন না তার চিকিৎসকরা। হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের প্রধান ও রাজীবের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক মো. শামসুজ্জামান সাংবাদিকদের সঙ্গে তার কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আপনারা একটু লেখালেখি করেন। এমন মৃত্যু ঠেকানোর দায়িত্ব আমার, আপনার, সমাজের, রাষ্ট্রের।’ তিনি বলেন, ‘রাজীব নেই। আমরা খুব কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু রাজীবের এ ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে ত্রুটির কারণে এমন মৃত্যু, সেই ত্রুটিগুলো সারানো দরকার।’

রাজীব তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় মা আকলিমা খানমকে হারান। বাবা সেই শোকে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন; ছিলেন নিরুদ্দেশ। ২০১১ সালে চট্টগ্রামে এক আত্মীয়ের বাসায় তিনি মারা যান। এর আগের তিন বছর তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। রাজীব ও তার ছোট দুই ভাই পটুয়াখালীর বাউফলে নানাবাড়ি ছিলেন। পরে ঢাকায় এসে পোস্ট অফিস হাইস্কুলে ভর্তি হন। খালার বাড়ি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর রাজীব যাত্রাবাড়ীর মেসে গিয়ে ওঠেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে কম্পিউটার কম্পোজ, গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ শিখছিলেন। করছিলেন টিউশনি। দম ফেলার ফুরসত পাননি মোটেই। লক্ষ্য ছিল একটাই, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, ভাই দুটির দায়িত্ব নেওয়া।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!