• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কজুড়ে বিকল্প টার্মিনাল!


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ২৩, ২০১৭, ০৫:০৭ পিএম
সড়কজুড়ে বিকল্প টার্মিনাল!

ঢাকা: শনিবার রাত ৮টা। রাজধানীর পশ্চিম পান্থপথের রাসেল স্কয়ার মোড়। এস আলম পরিবহনের একটি দূরপাল্লার বাস (ঢাকা মেট্রো-ব ১১-০৬৬১) মোড় ঘুরানোর চেষ্টা করছে। বাসটি ইউটার্ন নেয়ার সময় অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হয়। টানা ১২ মিনিটের চেষ্টায় গাড়িটি ঘোরাতে সক্ষম হন চালক। এ সময় কর্তব্যরত একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট (হলুদ জ্যাকেট পরায় নামটি দেখা যায়নি) শুধু চেয়ে দেখছিলেন। যেন কিছুই করার নেই তার।

তবে এ অবস্থা শুধু এক দিনের নয়, কিংবা পান্থপথেরও নয়, প্রতিদিনই রাজধানীর ফকিরেরপুল, কমলাপুর, পান্থপথ, আসাদগেট, শ্যামলী, মিরপুর, উত্তরার আবদুল্লাহপুর, কল্যাণপুরে সড়ক দখল করে বাস রাখেন মালিকরা।

গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী এই চারটি প্রধান টার্মিনালের আশপাশের রাস্তাও থাকে দূরপাল্লার বাসের দখলে। দূরপাল্লার এসব বাস সার্ভিসের মধ্যে রাজারবাগে গ্রিনলাইন, গাবতলীতে হানিফ ও মালিবাগ লেভেলক্রসিংয়ের পাশে সোহাগ পরিবহনের নিজস্ব বাস টার্মিনাল থাকলেও আশপাশের রাস্তা থাকে তাদের দখলে। রাজারবাগে গ্রিনলাইনের টার্মিনালের পাশের রাস্তায় তাদের প্রায় ৬-৮টি গাড়ি প্রধান সড়কে অবস্থান করতে দেখা গেছে।

পান্থপথের কাউন্টারগুলোর সামনে সারিবদ্ধভাবে দূরপাল্লার ৭-৮টি বড় বাস দাঁড়িয়ে যাত্রীর অপেক্ষায়। ফলে যানজট সৃষ্টি হয়। পান্থপথে হানিফ পরিবহন, টিআর ট্রাভেল, শ্যামলী, সেন্টমার্টিন, সৌদিয়া, গ্রিনলাইন, বাগদাদ, ঈগল, সোহাগ, হানিফ, এস আলমসহ আরো বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার বাসের টিকিট কাউন্টার রয়েছে। দিনে কম থাকলেও সন্ধ্যার পর আসে বড় বাস। টিআর ট্রাভেলস (ঢাকা মেট্রো-ব ১১-৫০৭১) শ্যামলী পরিবহন (ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৬৩২৯), সৌদিয়া পরিবহন (চট্ট মেট্রো-ব ১১-০৬৯৬) সেন্টমার্টিন পরিবহন (ঢাকা মেট্রো-ব ১১-৬৫০৩) বাসগুলো যেন রাতে সড়কের রাজা(!)।

প্রাইভেট কার চালিয়ে পান্থপথ হয়ে মিরপুরের নিজ বাসায় ফিরছিলেন আবদুল ওয়াদুদ। তিনি জানালেন, প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর পান্থপথে যানজটের মুখোমুখি হতে হয়। সড়ক দখল করে বাস রাখার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।

টিআর ট্রাভেলসের পান্থপথ টিকিট কাউন্টারে কথা হয় সেলস এক্সিকিউটিভ মোহাম্মদ জিন্নাহর সঙ্গে। তিনি জানালেন, রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উদ্দেশে তাদের গাড়ি ছেড়ে যায়। এজন্য ৮-৯টায় গাড়িগুলো কাউন্টারের সামনে পার্কিং করা থাকে। একে ট্রাভেলসের ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৭১৪৯, ডলফিনের ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-১৪৪০, হানিফের ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-১৪৩৫, ঈগল পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৬৬৬০ নম্বর বাসও দেখা গেল। আসাদ গেট থেকে একটু সামনে নাবিল ক্লাসিকের ৮-১০টি গাড়িসহ এসবি পরিবহন, হক স্পেশাল, জবা পরিবহনের বেশ কিছু গাড়ি প্রধান সড়কে এলোপাতাড়িভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

নাবিলের ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৬৭৮৭ নম্বরের গাড়িটি ছিল। শ্যামলী স্কয়ার থেকে হকের গ্যারেজ পর্যন্ত শ্যামলী এন্টারপ্রাইজ, কেয়া পরিবহন, হানিফ, বাবলু, তাজ, ইকোনো ও রাজধানী এক্সপ্রেসের একাধিক বাস পার্কিং করা অবস্থায় দেখা গেছে।

ডিএমপির ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের উপকমিশনার লিটন কুমার সাহা বলেন, রাত সাড়ে ৯টার আগে ডিএমপি এলাকায় ট্রাক ও দূরপাল্লার বাস প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। রাত ১০টার পর রাজধানীতে গাড়ির চাপ কম থাকে, তাই বাস-ট্রাক ঢুকতে অনুমতি দেওয়া আছে।

রোববার রাত ৮টা। রাস্তার দুই পাশে টিআর এন্টারপ্রাইজ, এস আলম, ইকোনো, ঈগল, হানিফ, রিল্যাক্স, সোহাগ, গ্রিনল্যান্ড, ইউনিক, বিআরটিসি, মামুন পরিবহন, রূপসী বাংলা, সেন্ট মার্টিন সার্ভিস, একে ট্রাভেলস, সিলভার লাইনস, পিআর ট্রাভেল, এনা পরিবহনসহ প্রায় ১৫-২০টি দূরপাল্লার বাসের টিকিট কাউন্টার রয়েছে। এসব বাস সার্ভিসের গাড়িগুলো সন্ধ্যার পর থেকেই যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। এস আলমের ঢাকা মেট্রো-জ ১১-১৫৪৭, ইউনিক পরিবহনের ঢাকা-ক-১১-০১৫২, শ্যামলীর ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৪১৫২ নম্বরের গাড়িসহ প্রায় ১৬-১৭টি গাড়ি রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। এতে ফকিরেরপুল থেকে পল্টন ও মতিঝিলের রাস্তায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

সৌদিয়া বাস কাউন্টারের সেলস এক্সিকিউটিভ খালেদ হোসেন বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় তাদের বাস গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। রাত ৯টার আগে রাজধানীর প্রধান সড়কে গাড়ি রাখার কোনো নিয়ম নেই। তবু গাড়ি রাখা হয়। ফলে যানজটের তৈরি হচ্ছে। একই কথা বলেন ইউনিক সার্ভিসের কাউন্টার মাস্টার ফোরকান আলী, এস আলমের কাউন্টার ম্যানেজার আরিফ হোসেনসহ অনেকে।

রোববার রাত পৌনে ১১টা। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে পীরজঙ্গি মাজারের দিকে ৬ নম্বর গাড়ির দীর্ঘ লাইন। প্রতিদিন এখানে প্রায় ২০-২৫টি রাখা হয়। তিশা পরিবহনের ৮-১০টি বাসও রয়েছে। কমলাপুর ৬ নম্বর বাসস্ট্যান্ড নামে পরিচিত এটি। দিন কিংবা রাতে এসব গাড়ি এভাবেই ফুটপাতের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। এসব গাড়ির আড়ালে চলে গাঁজা সেবন, নিশিকন্যাদেরও আনাগোনা। সড়ক বাতিও অকেজো। রাস্তাজুড়ে অন্ধকার। বাসের ড্রাইভার, সুপারভাইজার ও হেলপাররাই এখানে মাদক সেবন করেন।

ভুক্তভোগী রিয়াদ মাহমুদ খান বললেন, কয়েকদিন আগে রাত ১০টায় অফিস শেষে মতিঝিল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। পীরজঙ্গি রোডে পৌঁছতেই কয়েকজন ছিনতাইকারী তার পথ আগলে দাঁড়ায়। তার কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন ও কিছু টাকা নিয়ে যায়। ওরা মাদকাসক্ত ছিল। ‘বাসার সামনে এভাবে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ব, ভাবতেই পারিনি’-বললেন রিয়াদ।

ডিএমপির ট্রাফিক পূর্ব বিভাগের উপকমিশনার মইনুল হক খান বলেন, এ বিষয়ে বাসমালিক ও ডিসিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। বাসমালিকরা তিন মাসের সময় চেয়েছেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ বাস-ট্রাক মালিক সমিতির কার্যনির্বাহীর এক সদস্য বলেন, রাস্তায় গাড়ি রাখার জন্য মালিক সমিতি কোনো অনুমতি নেয়নি। মালিকরা পুলিশ ও ডিসিসি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে প্রধান সড়ক দখল করে কাউন্টারের পাশেই গাড়ি রাখছে।

তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, সড়ক দখল করে অবৈধভাবে বাস টার্মিনাল বানিয়েছেন বাস মালিকরা। এসব নিয়ন্ত্রণ ও উচ্ছেদের দায়িত্ব পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের। এ নিয়ে বাস মালিকদের একাধিকবার নোটিস করা হয়েছে। কিন্তু দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা।

একই বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর প্রধান চারটি বাস টার্মিনাল এখন গ্যারেজে পরিণত হয়েছে। কেউ সেখানে বাস রাখে না।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!